শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পেটে ঢুকেছে ৩৬৪ কোটি টাকা

রাজউক শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি এম এ মালেকের বিরুদ্ধ তদন্ত শুরু

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৩শ’ ৬৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি এম এ মালেকের বিরুদ্ধে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব এবং অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে কর্মচারীরা। ঘটনা তদন্ত শুরু করেছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ।
গতমাসে অবসরে গেছেন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ও রাজউকের সিবিএ নেতা এম এ মালেক। তারপরও সমিতির সভাপতির পদ ধরে রেখে এবং চুক্তিভিত্তিক চাকরি করার জন্য রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছেন। রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৩শ’ ৬৪ কোটি টাকা উদ্ধার এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল দাবি জানিয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষে লিখিত অভিযোগ করেছেন মো. শফিউল্লাহ বাবু নামে এক কর্মচারী।
জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. রেজাউল আহসান ইনকিলাবকে বলেন, রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ৩ শত ৬৪ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত করতে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে ৩শ’ ৬৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং আদালত থেকে ৯০ দিনের মধ্যে কমিটি গঠনের জন্য আদেশও দিয়েছে। আমরা কমিটি গঠন প্রক্রিয়া করার জন্য মাঠ কর্মীকে নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়া টাকা আত্মসাৎ ঘটনা তদন্ত শুরু হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ বলা হয়েছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সিবিএ নেতা এম এ মালেক গত মাসে অবসরে গেছেন। তার আগে মালেক হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরে পদায়ন হলেও কখনোই তিনি অফিস করেন না। মাস শেষে খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন তুলে নেন। তার স্ত্রীকেও কখনও অফিসে দেখা যায় না। মাস শেষে পিওনই বাসায় গিয়ে হাজিরা খাতায় তার স্ত্রীর স্বাক্ষর নিয়ে আসে। এমন ঘটনা রাজউকে হচ্ছে। যেন দেখার কেউ নেই। তার স্ত্রী সেলিনা আক্তারও রাজউকের উচ্চমান সহকারী।

১৯৮৩ সালে রাজউকে নিরাপত্তাকর্মী পদে চাকরি পান মালেক। পরে পিওন, নিম্নমান সহকারীর পদ পেরিয়ে বর্তমানে তিনি উচ্চমান সহকারী। রাজউকে চাকরি পাওয়ার পর তার বৈষয়িক উন্নতি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। রাজউকে এখন তার একচেটিয়া প্রভাব। কেউ অবাধ্য হলেই তার ওপর নেমে আসে মালেকের খড়্গ। রাজউকে তিনি যা বলেন, তা-ই হয়। প্লট বাণিজ্য, ফ্ল্যাট বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, কর্মচারীদের কোয়ার্টার বরাদ্দ বাণিজ্য, প্রবাসীদের প্লট গায়েব, নকশা জালিয়াতি, সমবায় সমিতির কোটি কোটি টাকা লুটপাট- এ রকম অসংখ্য অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছে মালেকের নাম। তবে মালেক সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। রাজধানীতে রয়েছে তার একাধিক বাড়ি, একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট, একাধিক গাড়ি, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি প্রভৃতি। দুদকে তার বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও রাজউক কর্তৃপক্ষও তাকে কখনও ঘাটাতে যায় না।

রাজধানীতেই মালেকের তিনটি বাড়ি রয়েছে। একটি আফতাবনগরের বি-ব্লকে, আরেকটি এফ-ব্লকে। বাড্ডার ডিআইটিতে আরেকটি। আটতলা ওই বাড়িতেই (প্লট-১৪, রোড-১২) থাকেন তিনি। বাকিগুলো ভাড়া দেয়া। উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে রয়েছে তিন কাঠার একটি প্লট। উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রাস্তার ৫২ নম্বর প্লটের মালিকও তিনি। উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর প্লট, ১১ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের ২১ নম্বর প্লটের মালিকও মালেক। আফতাবনগর আবাসিক এলাকার ডি-ব্লকের ২ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর প্লটের ৭তলা বাড়ির মালিকও তিনি। এ ছাড়া পূর্বাচল ও ঝিলমিলেও রয়েছে একাধিক প্লট। মালেকের নামে ভাটারায় রয়েছে এক বিঘা জায়গা। রয়েছে তিনটি গাড়ি (অ্যালিয়ন-ঢাকা মেট্রো গ-৩৯-১১০২, এক্সিও করোলা ঢাকা মেট্রো গ-২৮-৩১৪২ ও টয়োটা নোয়া ঢাকা মেট্রো চ-১৯-১১৬৮)।

রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান, মালেক তার মেঝ মেয়ে মাসুমার নামে মাসুমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট নামে একটি কোম্পানি খুলেছেন। একাধিক কর্মচারী জানান, রাজউকের ৩৭২ জন মাস্টাররোল কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করার জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছেন মালেক। কর্মচারীদের বলেছেন, আদালতে মামলা করে তাদের চাকরি স্থায়ী করার ব্যবস্থা করবেন। এভাবে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।

কর্মচারী অভিযোগে বলেন, রাজউকে যত ভুয়া নকশা অনুমোদন হয়, তার সঙ্গে জড়িত মালেক সিন্ডিকেট। তাদের কাছে রাজউকের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সব কর্মকর্তার সিল রয়েছে। নকশা পাস করিয়ে দেয়ার কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে জাল নকশা দিয়ে দেয় তারা। এ ধরনের ঘটনায় কয়েক মাস আগে কালাম শিকদার ও কাবুলকে ভ্রাম্যমাণ আদালত আটক করেন। পরে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে রাজউক। এ ছাড়া বাশার শরিফের কাছ থেকেও কয়েকটি ফাইল উদ্ধার করা হয়। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তারা সবাই মালেকের লোক হিসেবে রাজউকে পরিচিত।

রাজউক কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির নামে বরাদ্দ দেয়া উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ৭১ নম্বর হোল্ডিংয়ের দেড় বিঘা আয়তনের বাণিজ্যিক প্লটে ছয়তলা নকশা পাস করান মালেক। যার ফাইল নং- (রাজউক/ ন: অ: অ:/৩সি-১১৭০/২০০১/১৫৪, তাং ১/১১.২০১১ ইং।) সেই নকশা জালিয়াতি করে সেখানে ১১তলা কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। সমিতির সভাপতি হিসেবে অতিরিক্ত তলার স্পেস বিক্রি করে ২০ কোটি টাকা নিজের পকেটে ঢোকান মালেক। এ ছাড়া নকশাবহির্ভূত ১৭টি দোকান বসিয়ে সেগুলো বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। পাশে থাকা সমিতির একটি তেলের পাম্প মাসে দেড় লাখ টাকায় ভাড়া দিলে আয় দেখান ৭০ হাজার টাকা। বাকি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেন।

কর্মচারীরা জানান, ২০১৫ সালে রাজউক কর্মচারী সমিতির উত্তরা ভূতের আড্ডা মার্কেটের চতুর্থ তলায় ফ্লোর বিক্রি করেন চার কোটি টাকায়। ২০১৬ সালে আরও দুটি ফ্লোর বিক্রি করেন আট কোটি টাকায়। এই ১২ কোটি টাকা রাজউকের ১২৩০ কর্মচারীর সম্পদ। মালেক ওই টাকা সমিতিতে জমা না দিয়ে নিজ ব্যবসায় দুই বছর খাটান। এ নিয়ে সমিতির সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে তিনি ছয় কোটি পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। বাকি টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০১৫ সালে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে পাঁচ বিঘা আয়তনের ৪ নম্বর বাণিজ্যিক প্লটটি (মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের পাশে) রাজউক থেকে বরাদ্দ পায় সমিতি। ২০১৬ সালে সেখানে ১৫ তলা ভবন নির্মাণের জন্য বিএনএস প্রপার্টিজের সঙ্গে চুক্তি করে সমিতি। চুক্তি অনুযায়ী ভবনের মোট ফ্লোরের ৬২ শতাংশ পাবে ডেভেলপার। বাকি ৩৮ শতাংশ পাবে সমিতি। সমিতিকে ৩৫ কোটি টাকা সাইনিং মানি দিয়ে তিন বছরের মধ্যে শপিংমল তৈরি করবে বিএনএস প্রপার্টিজ। সমিতির সভাপতি হিসেবে এমএ মালেক ওই চুক্তি করেন।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজউকের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির। রাজউকে নবম থেকে বিশতম গ্রেড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, সাবেক চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
সমবায় সমিতির অর্থ আত্মসাৎ সম্পর্কে সিবিয়ে নেতা মালেক ইনকিলাবকে ফোনে বলেন, সমিতির নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে একজন দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি নির্বাচনে হারার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে এসব কথা ছড়াচ্ছেন। অথচ যিনি এসব ছড়াচ্ছেন রাজধানীতে তারও আটটি বাড়ি রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন