আমি একজন সাংবাদিকের মন্তব্য উদ্ধৃত করে আমার আজকের কলাম শুরু করছি। “.....এমন অবস্থা নিয়ে দেশ চলছে। ষোলো কোটি মানুষের দেশ, হাজারো সমস্যা এখানে। এ থেকে বেরিয়ে আসার লড়াইয়ে পথ দেখাবে কোন সেই সৎ ও সাহসী মানুষ। জনগণ এমন এক নেতৃত্বের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। আর এ কথা সত্য, এমন সৎ সাহসী মানুষ আকাশ থেকে নামবে না। আমাদের মধ্য থেকেই তারা আসবে। যারা ভালো কাজ করতে চায়, তারা কদাচিৎ যেচে এগিয়ে আসে, তাদের খুঁজে বের করতে হয়। সভ্য সমাজে এই খোঁজার প্রক্রিয়া হচ্ছে নির্বাচন।..... এ পর্যন্ত যারা দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সততা, নিষ্ঠা এবং যোগ্যতার বিপুল ঘাটতি ছিল তাদের। তারা ক্ষমতার চর্চা করেছেন। যারা তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতাসীন করেছে, তাদের কল্যাণে তারা মনোযোগী ছিলেন না। আগামীতে এমন... যারা ক্ষমতায় যাবেন, তারা কল্যাণের পথে অগ্রসর হবেন। যারা ভোট দিয়ে নেতা বানিয়েছে তাদের সজাগ থাকতে হবে।” উদ্ধৃতি শেষ। সজাগ থাকতে হবে কেন? যেন স্বাধীনতা অব্যাহত থাকে, যেন মানুষের নিরাপত্তা অব্যাহত থাকে। আরও একটি প্রশ্ন। এই দুশ্চিন্তা কেন? এই স্থানে এই কলাম লেখকের মন্তব্য : নেতা বেছে নেয়ার যেই প্রক্রিয়া পৃথিবীব্যাপী অনুসৃত, সেই প্রক্রিয়াটি আমাদের দেশের জন্য ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ আমরা আমাদের দুর্নীতিযুক্ত চিন্তা দিয়ে, আমাদের লোভী মানসিকতা দিয়ে জনগণকে প্রভাবান্বিত করি। এইরূপ কঠিন পরিস্থিতিতেও আমার মনের ভেতরের আশা এই : বাতাস আসবেই, সুবাতাসকে যদি বাধাগ্রস্ত করা হয় তখন ঘূর্ণিঝড় অবশ্যম্ভাবী হবে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসকে স্মৃতিতে আনছি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্য তখন সুবাতাস বইতেও পারত। কিন্তু তখনকার পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা সেই সুবাতাসকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। সেই বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ-এর রাত্রিতে হাজার হাজার তথা লক্ষের ওপরে বাঙালিকে এক রাত্রিতে হত্যা করা। তারা ২৫ মার্চের রাত্রিকে ‘কালরাত্রি’ বানিয়েছিল। এবং পরের দিনই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ঘূর্ণিঝড়’ আঘাত হেনেছিল। সেই আঘাত মুক্তিযুদ্ধ; সেই দিনের নাম স্বাধীনতা দিবস। আজ ২৬ মার্চ সেই স্বাধীনতা দিবসে, সকল শহীদকে স্মরণ করে এই কলামের বাকি অংশ লিখছি। আমি মনে রাখছি, পাঠকও মনে রাখবেন বলে বিশ্বাস করি যে, আজকের স্বাধীনতা দিবসটি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত।
স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। স্বাধীনতা রক্ষা করার অন্যতম পন্থা চির সচেতনতা তথা ইংরেজি পরিভাষায় : ইটারনাল ভিজিলেন্স ইজ দি প্রাইস অব লিবার্টি। পাঠক আজ ২৫ মার্চ ২০২০। গত ২৫ দিনে ধীরে ধীরে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ বাংলাদেশে এসেছে। ১৭ মার্চকে সামনে রেখে, ওই ১৭ দিন প্রচার এবং প্রচারণা কম ছিল। সরকার বহুবার বহু ভাষায় বহু কথনে বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার এই সঙ্কট মোকাবিলায় প্রস্তুত! বাংলাদেশে আসার আগে করোনা ভাইরাস নামক ভীতিকর মেহমানটি, বাংলাদেশকে অন্তত দুই মাসের ওয়ার্নিং টাইম বা গ্রেইস পিরিয়ড দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ প্রথম চীন-এ। চীন এই পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করল এবং সিরিয়ালভাবে অন্যান্য আক্রান্ত দেশগুলো কিভাবে কিভাবে মোকাবিলা করল, সেটা দেখা বা পর্যবেক্ষণের সুযোগ ছিল বাংলাদেশের; সেখান থেকে গঠনমূলক শিক্ষা নেয়ার সুযোগ ছিল বাংলাদেশ সরকারের। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার সেই সুযোগগুলো সদ্ব্যবহার পর্যাপ্ত করেননি। প্রবাসী ফেরতদের বিমানবন্দরে পরীক্ষা করার বন্দোবস্ত, আবার প্রবাসী ফেরতদোর হোম-কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনা করা, হাসপাতালে যথেষ্ট সিট ব্যবস্থাপনা করা, পরীক্ষার কীট ব্যবস্থাপনা করা, বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থাপনা করা, সরকারি কোয়ারেন্টাইন সৃষ্টি করা ইত্যাদি সবকিছুতেই একটা লুকোচুরি ভাব ছিল যেটা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পায় অবহেলা ও ব্যর্থতারূপে। সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য যথা- করোনা ভাইরাসের আক্রমণের শিকার কতজন বা কতজন এই আক্রমণে মারা যাচ্ছে, সেই তথ্যটি নিয়েও মানুষের মনে অনাস্থা আছে। বিলম্বিত পর্যায়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে, দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে কর্মটিকে আমরা স্বাগতম জানাই। এ প্রসঙ্গে সরকারের সমালোচনা আপাতত বন্ধ করছি। করোনা ভাইরাস আক্রমণ তথা সঙ্কটটি আওয়ামী লীগের সঙ্কট নয়; সকল রাজনৈতিক দলের এবং বাংলাদেশের সকল মানুষের। সরকারের ভুলগুলোকে নিম্নমাত্রায় (লো-প্রোফাইল) উল্লেখ রেখে, সকলের মেধা ও শক্তি প্রয়োগ করে এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে। করোনা ভাইরাসের কারণে স্বাভাবিক কর্মকান্ড ব্যাহত হতে বাধ্য। দুনিয়াবি যত চেষ্টা আছে, সেগুলো আমাদেরকে সব করতে হবে। সাথে সাথে মহান আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে।
স্বাধীনতার মাস মার্চ মাস। এই মাসের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি হলো, স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মহানায়ক-নায়ক-খলনায়কগদের কর্ম বিশ্লেষণ, স্বাধীনতার বর্তমান অবস্থা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা। বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগের বেশি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। অতএব তাদের উপকারার্থেই এ ধরনের আলাপ-আলোচনা বেশি বেশি প্রয়োজন। দেশবাসী সেই প্রয়োজনগুলো মিটানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। টেলিভিশনগুলো মাসব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা উপস্থাপন করে। পত্রিকাগুলো সারা মাসব্যাপী প্রত্যেক দিন প্রথম পৃষ্ঠায় বা অন্য কোনো পৃষ্ঠায় ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বরের ঘটনাবলির কোনো না কোনো স্মৃতি রোমন্থন করে। ২৫ এবং ২৬ মার্চ উপলক্ষে টেলিভিশন এবং পত্রিকাগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা বা রচনা উপস্থাপন করে; আগামীকাল ২৬ মার্চ ২০২০-এও করবে। মুক্তিযোদ্ধাগণ যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন এবং সক্ষম, তাঁরা ফেসবুকে তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ২৫-২৬ তারিখে বা তার আগেও দু-একদিন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়; এ সবই ভালো। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যতিক্রম ঘটছে। তবে সকল স্মৃতি রোমন্থন, ঘটনার পুনর্গঠন, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা সবকিছুর মধ্যেই একটা ‘কিন্তু’ আছে। ‘কিন্তু’টি হলো, লেখক বা উপস্থাপক বা আলোচকের দৃষ্টিভঙ্গি তথা তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। আক্ষরিক অর্থেই, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে, রাজনীতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো কিছু বলা বা লিখা বা উপস্থাপন করা কঠিন ব্যাপার; কঠিন ব্যাপার হলেও কেউ না কেউ এরূপ করার চেষ্টা করেছেন এবং করেই চলছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের তিনটি স্পষ্ট আঙ্গিক আছে। প্রথম আঙ্গিকটি হলো, মুক্তিযুদ্ধের অনেক বছর আগে থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক আঙ্গিক। দ্বিতীয় আঙ্গিকটি হলো, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক আঙ্গিক। তৃতীয় আঙ্গিকটি হলো, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের কর্মগুলো, যুদ্ধগুলো, ত্যাগগুলো, আত্মত্যাগগুলো। যত কিছুই বলি সকল ত্যাগের নির্যাস ছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করা বা স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপন করা। স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনের পর সকলের আগ্রহ ও চেষ্টার নির্যাস হলো সেই অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখা, অর্থবহ রাখা।
২০১৮-১৯ সালের বেশ কিছু কলঙ্ক বা কেলেঙ্কারির ঘটনা এবং বিশেষ করে ২০২০ সালের কিছু আর্থিক ও প্রশাসনিক কেলেঙ্কারির ঘটনা, আওয়ামী লীগের ভাবমর্যাদা ও সুনামের উপর কঠোর বাস্তবভিত্তিক নেতিবাচক আঘাত হানে। আজকের তারিখ থেকে পেছনের দিকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সর্বশেষ দুইটি ভারত সফরে, নয়াদিল্লিতে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ও কলকাতায় যুগপৎ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কূটনৈতিক সৌজন্য প্রদর্শনে গাফিলতি বা অবমূল্যায়ন, বাংলাদেশের মানুষকে আওয়ামী লীগের ভাবমর্যাদা নিয়ে এবং আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় সরকারের মধ্যে সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করে। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, বঙ্গবন্ধুর শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনায় বাধ সাধে। সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি হলো করোনাভাইরাসের আক্রমণ। ইংরেজি ভাষায় প্রবাদ বাক্য আছে ‘ম্যান প্রপোজেস অ্যান্ড গড ডিসপোজেস’। বাংলা ভাষায় এর ভাবসম্প্রসারণ হলো : মানুষ নিজের মনের খুশিতে বা নিজের প্রয়োজনে ভবিষ্যতের করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা করে, একজন আরেকজনকে জানায় কিন্তু চূড়ান্তভাবে মানুষের সকল কর্ম প্রসঙ্গে ফয়সালা প্রদান করেন (ইংরেজদের ভাষায় গড এবং) আমাদের ভাষায় ও বিশ্বাসে মহান আল্লাহ। করোনাভাইরাস এসে শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী লন্ডভন্ড করেনি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক কর্মকান্ড, পারিবারিক অনুষ্ঠানমালা, বিয়েশাদির অনুষ্ঠানাদি সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। যাহোক, করোনাভাইরাস নামক মহাবিপদ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে; এতদসত্তে¡ও আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছি। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, মানুষ বাঁচবে-মরবে, কিন্তু স্বাধীনতা যেন বাঁচে।
আজ থেকে সাত দিন আগে ছিল ১৯ মার্চ ১৯৭১। আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধের আগেই যুদ্ধ শুরু। তখন ছিল ঐক্য, এখন আছে বিভাজন। খুলে বলি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি বর্তমান গাজীপুর জেলার সদর দপ্তর যেখানে অবস্থিত সেই ভাওয়াল রাজাদের আবাস ভবনে (তথা ভাওয়াল রাজবাড়ীতে) স্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কনিষ্ঠতম অফিসার এবং কনিষ্ঠতম বাঙালি অফিসার ছিলাম। এখন ওই স্থানটি গাজীপুর জেলা সদর বলে পরিচিত। ১৯৭১ সালে এটা জয়দেবপুর থানা সদর বলে পরিচিত ছিল। আমাদের জন্য তথা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য, মুক্তিযুদ্ধ ১৯ মার্চ ১৯৭১ তারিখেই ধরা দেয়। সেই ১৯৭১ সালেও ১৯ মার্চ থেকে নিয়ে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ছিল উত্তেজনায় এবং অনিশ্চয়তায় ভরা, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আগ্রহে দীপ্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হাজারো বড়-ছোট ঘটনাবলি বা উপাখ্যানের মধ্যে, ১৯ মার্চের ঘটনা অবহেলিত, অবমূল্যায়িত। আমার মূল্যায়ন হলো : বঙ্গবন্ধু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় এবং নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধও গুরুত্বপূর্ণ; সেই মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের অংশগ্রহণকারীগণও গুরুত্বপূর্ণ। অতএব সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানো এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত রাখা, সরকারের দায়িত্ব। কথাগুলো বললাম এজন্য যে, বাংলাদেশকে এখন এমন একটি অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে তৃতীয় পক্ষ থাকার জায়গা নেই, যেখানে কোনো মধ্যম পক্ষ থাকার জায়গা নেই। এই বিভাজনটি বর্তমান বাংলাদেশ শাসনকারী রাজনৈতিক দলটিই করেছে। আমরা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলেও পারিনি এবং পারার কোনো লক্ষণ এখনও দেখছি না। এরূপ পরিস্থিতির নিকট আমরা সবাই জিম্মি।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল সবার, স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বও সবার। একটু ব্যাখ্যা এই স্থানে উপযুক্ত। ওপরের তিনটি অনুচ্ছেদের আলোচনা কেন করলাম? আলোচনাটি করলাম এ জন্য যে, সম্মানিত পাঠকের নিকট আমার মনের আকুতিটি যেন স্পষ্ট হয়। আকুতিটি হলো এই : মুক্তিযুদ্ধ ছিল সবার, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় হলো সবার, বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা হলো সবার এবং সেই স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বও সবার। আমরা মনে করি সবার শব্দটি বলতে সকল রাজনৈতিক দলের সদস্যরা শামিল, রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরের কোটি কোটি জনতা শামিল, সকল প্রকারের ছাত্র, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, পেশাজীবী সবাই শামিল তথা এটা সকলেরই দায়িত্বের আওতায় পড়ে। অতএব যদি স্বাধীনতার ওপর হুমকি আসতে পারে এমন কিছু মনে হয়, অথবা অর্থবহ-স্বাধীনতার অর্থকে যদি কেউ ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করে, তাহলে অবশ্যই আমাদের সাবধান সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ২৫ তারিখ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে গন্ডগোল হয়, একদিন পর থেকে নিপীড়িত নির্যাতিত রোহিঙ্গা মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে। বর্তমান রূপে ও আকারে রোহিঙ্গা সমস্যা, বাংলাদেশের গত ৪৯ বছরের মধ্যে মোকাবিলা করা অন্যতম বড় সমস্যা। তাই শিরোনামে ২০১৭ সাল লিখেছি। ২০২০ সাল এখনও শেষ হয়নি তবে শুধু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আনুষ্ঠানমালা নয়, শুধু করোনাভাইরাস নয়, আরো অনেকগুলো কারণে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এ বছর। তাই ২০২০ সাল লিখে রেখেছি। আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিতে এই চারটি বছর, বাংলাদেশের জন্য একাধিক আঙ্গিকের দ্ব›েদ্বর বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। ওই দ্ব›দ্বগুলোর সাথে, অবশ্যই আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পড়ে না এমন অনেক কিছুই জড়িত বা সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি মাত্র আঙ্গিক উল্লেখ করছি। এক. আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর রাজনীতিতে (ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স) ছোট দেশগুলোর ভূমিকা জড়িত; দুই. আঞ্চলিক রাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নামক অঞ্চলে আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর আন্তঃদেশীয় রাজনীতির (রিজিওনাল পলিটিক্স) আঙ্গিকে বাংলাদেশের অবস্থান জড়িত; তিন. আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির দ্ব›দ্ব (কালচারাল কনফ্লিক্ট) জড়িত। অতএব, বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে বা বাংলাদেশের কোন দিকে যাওয়া উচিত বা বাংলাদেশকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধান করা সকল সচেতন নাগরিকের জন্যই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এই অনুচ্ছেদে যেই তিনটি আঙ্গিক উল্লেখ করলাম, তার সম্পূরক কিছু বক্তব্য নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে উপস্থাপন করলাম।
২০১৮ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশে একজন নতুন চীনা রাষ্ট্রদূত এসেছিলেন যার নাম ছিল ঝ্যাং জুয়ো (ঢাকা মহানগরীতে বর্তমান চীনা রাষ্ট্রদূতের পূর্বসূরি)। ওই নবাগত রাষ্ট্রদূত মহোদয় ২১ মার্চ ২০১৮ তারিখে সংবাদ সম্মেলনে যা যা বলেছিলেন, সেটি এখনও প্রণিধানযোগ্য এবং এখনও প্রাসঙ্গিক। ওই সময় বাংলাদেশ প্রতিদিন নামক পত্রিকায় খবরটি যেমন উদ্ধৃত হয়েছিল, তেমনটিই আমি এখানে হুবহু উদ্ধৃত করছি। উদ্ধৃতি শুরু। ‘রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান হবে না। ঢাকায় চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ঐতিহাসিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সব বিষয় মিলিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটটি এতটাই জটিল যে, তার আশু কোনো সমাধান নেই। খবর বিডিনিউজের। সংবাদ সম্মেলনে এসে বাংলাদেশের ওই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট নিয়ে রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো তার দেশের এ মনোভাবের কথা জানিয়েছিলেন। নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেইজিং গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখছে বলেও চীনের প্রতিনিধি জানিয়েছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টিতে নজর রাখার কথা জানিয়েছিলেন চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো। তিনি বলেছিলেন, আমরা আপনাদের অবস্থান সম্পর্কে জানি, আপনাদের উদ্বেগও বুঝি। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এর একটি সমাধান খুঁজে নেবে। রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো বলেছিলেন : রোহিঙ্গা সঙ্কটে চীনের কোনো স্বার্থ নেই। ঢাকায় চীনের দূতাবাসে দোভাষীর মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যেন সমস্যার সমাধান করতে পারে, সে বিষয়ে সহযোগিতা করছে তার দেশ। এ প্রসঙ্গেই তিনি বলেছিলেন : তবে আমরা দেখছি যে, রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সমাধানের আশু কোনো উপায় নেই; কারণ এটা একটি জটিল সমস্যা; ঐতিহাসিক, জাতিগত এবং ধর্মীয় বিষয় এতে জড়িত। উদ্ধৃতি শেষ। এ পর্যায়ে কলাম লেখক সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের মন্তব্য : সম্ভবত কূটনৈতিক সৌজন্যের কারণেই, সেই ২০১৮ সালের মার্চ মাসে মাননীয় চীনা রাষ্ট্রদূত যেটা বলেননি, সেটা হলো এই : এই সমস্যা সমাধানের জন্য একদিকে ভারত ও বাংলাদেশ এবং অপরদিকে চীন ও বাংলাদেশ এই উভয়ের সম্পর্কের সমীকরণ প্রয়োজন। আরও যেই কথাটি তখনকার রাষ্ট্রদূত বলেননি যে, রোহিঙ্গাবিহীন রাখাইনে চীনের স্ট্র্যাটেজি বা কৌশলগত স্বার্থ জড়িত এবং কৌশলগত অর্থনৈতিক বিনিয়োগের নিরাপত্তা জড়িত। চীনা রাষ্ট্রদূত মহোদয় যেমন বলেননি, কোনো কূটনীতিবিদই হয়তো বলতেন না। কারণ, রাষ্ট্রদূতগণ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া ব্যতিক্রম। শনিবার ১৭ মার্চ ২০১৮ তারিখের ‘বণিকবার্তা’ নামক বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ক প্রখ্যাত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার কালো হরফের বড় শিরোনাম ছিল এইরূপ : ‘বাংলাদেশে চীনের কৌশলগত বিনিয়োগগুলো প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে’। বাংলাদেশের চীনা বিনিয়োগের বর্তমান (২০২০) অবস্থা এবং চীন-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সিরিয়াস মূল্যায়নের দাবি রাখে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা আলোচনা করতে গেলে অবশ্য অবশ্যই ভারতের সংশ্লিষ্টতা আলোচনা করতেই হবে। তবে এ আলোচনায় অনেকগুলো আঙ্গিক আছে যথা রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক। এই আঙ্গিকগুলো আলোচনা করতে গেলে আওয়ামী দলীয় বা আওয়ামী মনোভাবাপন্ন আলোচকের মূল্যায়ন এবং অন্যদের মূল্যায়নে মৌলিক বা বড় পার্থক্য পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ দলীয় মূল্যায়নে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রধান এবং অলংঘনীয় নোঙর হলো ১৯৭১। আওয়ামী লীগ দলীয় মূল্যায়নে বাংলাদেশ ভারতের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ, অসীম কৃতজ্ঞ; এবং এই কৃতজ্ঞতাবোধ অব্যাহতভাবে, নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশযোগ্য ও প্রকাশতব্য। অন্যদের মূল্যায়নে, ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবেই তবে সেটা অসীম হওয়া সমীচীন নয়; ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে ১৯৭১ ব্যতীত আরো নোঙর আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও, বাস্তবতার নিরিখে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করতে গিয়ে একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। চ্যালেঞ্জটি হলো, কৃতজ্ঞতাবোধের সীমারেখা কোথায়? আমি শনিবার ২৪ মার্চ ২০১৮ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর প্রথম পৃষ্ঠার সবার উপরে ডান দিকে প্রকাশিত একটি ছবিসহ সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ওই সংবাদটির উৎস হচ্ছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি, প্রখ্যাত চিকিৎসক-মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী। প্রকাশিত সংবাদ পুরোটা উদ্ধৃত করলাম না, স্থান বাঁচানোর জন্য। চারটি বাক্য উদ্ধৃত করছি। উদ্ধৃতি শুরু। “বাংলাদেশের সব সমস্যার জন্য দায়ী হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে। এটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে বিএনপিকে মাশুল দিতে হবে। ভারতকে চিনতে ব্যর্থ হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।” উদ্ধৃতি শেষ। ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে, এই কলামের লেখকের আজকের তারিখের মন্তব্য : মাশুল শুধু বিএনপিকেই দিতে হবে না, পর্যায়ক্রমে সকল রাজনৈতিক দলকেই দিতে হবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এ কথাটি আজও প্রযোজ্য।
চীন এবং ভারত প্রসঙ্গে একাধিক সংবাদ উপরে উদ্ধৃত করলাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সফররত ভারতীয় রাজনীতিবিদ বা ঢাকায় অবস্থিত কূটনীতিবিদগণের পক্ষ থেকে সম্মানিত বাংলাদেশিগণকে প্রায়ই বলা হয় যে, ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব নয়, বন্ধুত্ব হবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। এরকম একটি ক্লারিফিকেশন বা ব্যাখ্যা দেয়ার পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ হলো, বাংলাদেশের মানুষ, সকল রাজনৈতিক দলের মানুষ বিশ্বাস করে যে, ভারতের কারণেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে এবং ভারতীয় বুদ্ধি-পরামর্শেই সরকারের আইন-শৃঙ্খলা ও গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীসমূহ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের জনগণের একটা বিশাল অংশ সন্দেহ করে যে, ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় যেই অভিনব পদ্ধতিতে গভীর রাতে ভোট ডাকাতি হয়েছে, সেটিতেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা সমর্থন ছিল। জনগণের মধ্যে যারা সচেতন, তারা মনে করেন যে, সাধারণ জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব নেতাদের। জনগণের দায়িত্ব নেতা বেছে নেয়ার। এটা হচ্ছে পারস্পরিকভাবে অনুঘটকের ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে তথা নেতা প্রসঙ্গে উপরের অনুচ্ছেদে অন্য একজনের কথা তুলে ধরেছিলাম।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন