বৈশাখের ঝাঁজাল দুপুর! গনগনে রোদ আর হাঁসফাঁস গরমে অতিষ্ট হয়ে ওঠেছে প্রাণ! পিঠফাটা রোদ্দুরে পিপাসায় ককিয়ে ওঠেছে হাশেম! কাজ ছেড়ে নদীর পারে এসে দাঁড়াল ও। ফিনফিনে বাতাস বইছে, নদীর নতুন জলে হালকা ঢেউ ওঠেছে।
পাঁচ বছরের ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে কালী-মন্দির মেলায় যা”েছ রমিজ। হাশেম আলীর পাশ কাটিয়ে যাবার সময় মুচকি হেসে রমিজ বলে, কী হাশেম আলী, এইখানে বইসা আছো ক্যান, মেলায় যাইবা না..?
ওদিকে না তাকিয়েই ঝাঁজাল শব্দে হাশেম আলী বলে, না, মেলায় যামু ক্যান?
হেসে ওঠে রমিজ, বলে, এত রাগ দ্যহাও ক্যান! মেলায় আবার কী দোষ করল?
নিরুত্তর হাশেম আলী বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে- আনন্দমনে মেলায় যাতায়াতরত মানুষের দিকে! বাবার হাত ধরে হেঁটে-চলা শিশুদের দেখে, নিজের অলক্ষ্যে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেছে হাশেমের দুচোখ! বুকের ভেতরে হুঁকরে হুঁকরে কান্নার ঢেউ জেগে ওঠে!
অবারিত অশ্রু আর বুকভাঙা বেদনার ঢেউ তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে- কবেকার সেই বিষণ্ণ মেলার দিনের কথা...
সেটা ছিল এমনই এক বৈশাখি মেলার দিন! ছয় বছরের মেয়ে বিধুকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হয়েছিল কালী-মন্দির মেলায়।
নদীর পার দিয়ে যাবার সময় বিধু বলেছিল, ও আব্বা, শ্রীমদ্দি বটতলি আর কতদূর?
হেঁটে হেঁটে হাশেম আলী বলল, আইসা পড়ছি মা, নদীর ওই পাড়ের গেরামটাই শ্রীমদ্দি।
গাঙে তো মেলা পানি, পার হইবা কেমনে?
হেই চিন্তাই করতাছি। গোদার-ও দ্যহি না, কেমনে পার হই, ক তো দ্যহি! বেলা-ও ভাটি পইড়্যা আইত্যাছে। দেরি করন যাইব না। চল, কান্ধে ওঠ আমার!
মেয়েকে কাধে চড়িয়ে হাশেম আলী নদীর তীর থেকে নেমে যেতে থাকল... পানির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে লুঙ্গিটা গোছকাছা দিয়ে পানিতে নেমে গেল হাশেম আলী।
বাবার কাঁধে চড়ে নদী পার হতে গিয়ে আনন্দে নেচে ওঠে বিধু!
কোমরসম পনি পেরিয়ে তীরে ওঠে এসেই হাশেম আলী বলে, এইবার নাইম্যা যা বেটি।
বাবার চুলে মুঠি ধরে বিধু বলল, হাঁটতে হাঁটতে হয়রান হইয়া গেছি বাজান, আমারে কান্দে কইর্যা লইয়্যা যাও।
কাঁধ থেকে নামিয়ে হাশেম আলী বলে, তুই এহন বড় হইয়্যা গেছত, হাইট্যা-ই চল..
কাঁধ থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বিধু বলে, ‘আব্বা, মেলায় কী নাগর দোলা আইব না?
কেমনে কইতাম, আগে তো আইত!
নাগরদোলায় উঠতাম মন চায়!
তাই নাকি?
হ
তুই তো ডরাবি, নাগরদোলায় ওঠলে মাথা ঘোরে।
আমি ডরাই না, আমার সাহস আছে। আই”ছা আব্বা, মেলা থেইকা আমারে কাচের চুড়ি কিন্যা দিবা কইলাম।
দ্যমু-নে।
আতার লাইগা কি!‘ বাঁশি কিনন লাগব।
হেইতে কি বাঁশি বাজাইতে জানে?
জানে না দেইখা কি অইছে, আমি তারে শিখামু।
আই”ছা হেইডা পরে দ্যহা যাইবনে। আগে মেলায় যাই, তারপর...
বিধুর ছোটভাই আতাউল্লাহ্, আতা বলে ডাকে সকলে। ওর প্রতি অন্তরের গভীর টান বিধুর; নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে ওকে। সবসময় নিজের জন্য কিছু কিনলে, আতার জন্য কিছু না-কিনে বাড়ি ফেরে না। বাড়িতে ফেরিঅলা এলে আতাকে সঙ্গে নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
শিবপুরের ইব্রাহিম এই এলাকার শিশুদের সবচেয়ে পরিচিত ফেরিঅলা; মৌসুমি ফলের বিচিত্র স্বাদের আচার নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ও। হাশেম আলীর বাড়ির সামনে এসেই বিধুর নাম ধরে হাঁক দেয়...
পরিচিত কণ্ঠ শুনেই আতাকে সঙ্গে নিয়ে হুড়মুড় করে ইব্রাহিমের পসরার সামনে দাঁড়ায় বিধু। দু টাকার সন্দেশ কিংবা আচার কিনলে, আগে আতাকে না দিয়ে বিধু মুখে দেয় না।
দিনান্তের শেষ লগ্ন, মেলা জমে ওঠেছে। লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠেছে শ্রীমদ্দি বটতলির মেলা। বিচিত্র বাঁশির আওয়াজ, লোকের কোলাহলে মেতে ওঠেছে চারদিক।
প্রতি বছর বৈশাখের প্রথম মঙ্গলবার থেকে শেষ মঙ্গলবার পর্যন্ত এ মেলা চলতে থাকে। চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসে দলে দলে; সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা চলতে থাকে। বিধুর হাত শক্ত করে চেপে ধরে ঘুরে বেড়া”েছ হাশেম আলী।
আনন্দমথিত মনে মাটির পুতুল, কাঁচের চুড়ি, কপালের টিপসহ আরও কত কিছুই-না কিনেছে; রঙিন কাচের চুড়িগুলো দেখে বিধুর যেন আর তর সইল না; ঝটপট দুহাতে পরে নিল রঙিন চুড়ি।
আতার জন্য বেলুন, বাঁশি কিনেছে। ক্রয়কৃত পন্য-সামগ্রি নিজ হাতে নিয়ে বাবার পিছু পিছু হেঁটে চলেছে বিধু।
হরেক মানুষের ভিড়ে ঘুরতে ঘুরতে প্রকৃতির আঙিনায় সন্ধ্যা নেমে আসছে ধীরে ধীরে। মেলাঙ্গন থেকে বের হয়ে খোলা জায়গায় এসে হাশেম আলী বলে, চল, এইবার বাড়িত ফিইরা যাই। সন্ধ্যা ইহয়া আইতাছে।
চট করে বিধু বলল, মা’র লাইগা কিছু কিনবা না?
মুচকি হেসে হাশেম আলী বলে, তর মা বুড়া হইয়া গেছে, তার এহন আর কী শখ আছে ক তো দ্যহি?
না বাজান, মার লাইগা কিছু না কিনলে, আমি এইখান থেইকা যামু না।
ঈষৎ হাসি দিয়ে হাশেম আলী বলে, ক, তর মার লাইগা কী কিনতাম?
চুড়ি কিনবা, আলতা কিনবা, আরও কতকিছু আছে না...
এহন কী তর মা’র এইসব জিনিস ব্যবহারের বয়স আছে?
কেডায় কইছে, আমারে টেকা দেও, আমি গিয়া পছন্দ কইরা কিইনা আনমু।
একথা বলেই বিধু, বাবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বের করে হাতে নিয়ে দোকানের দিকে ছুট লাগায়...
হাশেম আলী কয়েক কদম মেয়ের পিছু পিছু হেটে একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে স্বগত: করেÑ মা’র লাইগ্যা কত দরদ! নিজের বউয়ের লাইগা আমার কী দরদ কম! কিš‘ টেকা-পইসার অভাবে পছন্দমতন কিছু কিইনা দিতে পারি না।
হাশেম আলী একজন গরিব কৃষক। কানি দুএকক জমিতে চাষাবাদ করে যা ফসল আসে, তা-ই দিয়ে কোনোমতে বেঁচেবর্তে আছেন। আয় করা দূরের কথা, প্রতি বছরই তার ঋণ করতে হয়; সরকারি ব্যাংকের কৃষিঋণের দশ হাজার টাকা ছয়বছর ধরে শোধ করতে পারছে না ও। ফসল বিক্রির টাকা আশপাশের লোকের ঋণ শোধ করতেই ফুরিয়ে যায়।
সংসারের বোঝা বহন করে কোনোমতে এগিয়ে চলছে এঁকেবেঁকে। ই”েছ থাকা সত্তে¡ও স্ত্রীকে পছন্দমতো কোনো কিছু কিনে দিতে পারে না হাশেম আলী। বিধুকে ছাড়া ওর সংসারে একমাত্র পুত্র আতা, বংশের একমাত্র প্রদীপ।
তার এমন নিঃশ্চুপ চিন্তিত অবস্থায় কে একজন পাশ কাটিয়ে যাবার সময় আচমকা ডেকে বলে, কী হাশেম আলী, অসময়ে এইখ্যানে বইসা কী চিন্তা করতাছো? বাড়িত যাইবা না? আসমান আন্ধার হইয়্যা আইত্যাছে। তুফান হইব মনে হয়!
আচমকা ওর ভাবনার শেকল ভেঙে গেল। মাথা তুলে তাকিয়ে পাশের বাড়ির তারা মিয়াকে দেখে, থতমত খেয়ে ওঠে হাশেম বলে, আরে তারা মিয়া ভাই...
সামনে এসে দাঁড়িয়ে তারা মিয়া বলে, এই সময়ে এইখানে বইসা রইছো ক্যান? একবার আসমানের দিকে চাইয়া দেখছো?
একথা বলেই স্থান ত্যাগ করে বাড়ির দিকে পা বাড়াল তারা মিয়া...
বিচলিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বগত করে হাশেম আলী, সর্বনাশ! আসমান ভার হইয়া গেছে, এহনি বুঝি ঝড়-বৃষ্টি শুরু হইয়া যাইব!
বসা থেকে ওঠে মেলার দিকে তাকিয়ে হাশেম আলী বলে, বিধু, বিধু গেল কই, এহনো মাইয়াডা আইতাছে না ক্যান!
দ্রুত মেলার দিকে ছুট লাগায় হাশেম আলী। মানুষের ভিড়ের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতে থাকল বিধুকে...
মেলার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সব দোকানে খুঁজে পাচ্ছে না ওকে! বিচলিত হয়ে ওঠে হাশেম আলী, মাইয়াডা গেল কই?
মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে আর দিগি¦দিক ছুটে বেড়াচ্ছে...
অল্পক্ষণের মধ্যেই উত্তর থেকে বাতাস বইতে শুরু করে; বাতাসের গতিবেগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ...
অল্প সময়ের মধ্যেই ধুলো উড়িয়ে দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। জোর বাতাস আর বৃষ্টি দেখে মেলা ছেড়ে লোকজন যে যার পথে ছুটতে থাকল হইচই করে। হাশেম আলী পাগল হয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে বিধুকে ডাকতে থাকল- বি..ধু.., ও বিধু..
মানুষের কোলাহল আর ছুটোছুটি ক্রমশ মিইয়ে যেতে থাকে ঝড়-বৃষ্টির ক্ষুদ্ধ আওয়াজে। মেলার আঙ্গিনায় সাজানো অস্থায়ী দোকানগুলো জোর বাতাসে উড়িয়ে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মানুষ হন্যে হয়ে দিগি¦দিক ছুটোছুটি করে আশ্রয় নিচ্ছে আশপাশের বাড়িঘরে। কি!‘ হাশেম আলী আশ্রয়ের আন্বেষণ ছেড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ঝড়ের মধ্যদিয়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়েই মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এদিকওদিক...
জোর তুফান ও বৃষ্টির তীব্রতায় টিকতে না পেরে, একসময় মন্দিরের বারান্ধায় গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় হাশেম আলী। মানুষের মুখের দিকে সজল চোখে তাকিয়ে ডুকরে কাঁদছে ও ...
কয়েক ঘণ্টা অবিরত ঝড়-বৃষ্টি গিয়ে থামে মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে।
ওই ঝড়ে শ্রীমদ্দির বহু বাড়ি-ঘর, গাছপাল ভেঙেচুড়ে কোথায় উড়িয়ে গেছে, কারো চোখই দেখেনি। কত যে গবাদি-পশু ও মানুষ মরেছে সে হিসাবে আর কে রাখে! চারদিকে চরম হা-হাকার! আহত ও জীবিত মানুষের কান্নার শোরগোলে আবেগঘন হয়ে ওঠে পরিবেশ!
ঝড় থেমে যাবার পর ভোরের দিকে গিয়ে বিধুকে খুঁজে পাওয়া গেল- শ্রীমদ্দি শ্বশানের পাশে! ভেঙে-চুড়ে মাটিতে আছড়ে পড়া বিশাল কড়ই গাছের নিচে পড়ে রইল বিধুর প্রাণহীন দেহ। সদ্য হাতেপরা কাচের চুড়িগুলোও বেশিরভাগ ভেঙে গেছে, দুএকটি চুড়ির ভেঙে ওর হাতের মাংসে ঢুকে পড়েছে। আত্মচিৎকার করে মেয়ের প্রাণহীন দেহটি জড়িয়ে ধরে হাশেম আলী!
আনন্দমনে মেলায় এসে আচমকা বৈশাখি বিপন্ন ঝড়ে সন্তানহারা বিষণ্ণ বেদনার হা-হাকার বুকে নিয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মেয়ের শব কাধে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরে গেল হাশেম আলী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন