শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

বর্তমান সময়ে করোনা ও আমাদের কুরবানি

মুফতী মোঃ আব্দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০২০, ১২:০২ এএম

(এক)
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানী করা বিধিবদ্ধ করেছেন; যেন তারা তাঁরই প্রদত্ত চতুষ্পদ জন্তু আল্লাহর নামে কুরবানী করতে পারে। তাঁর প্রিয় হাবীব (স) এর প্রতি, তাঁর আল, আসহাব ও আহলে-বায়ত-এর প্রতি অগণিত দুরূদ ও সালাম, যাঁর মাধ্যমে এ কুরবানী করার মাহাত্ন, আদর্শ, বিধি-বিধান, কল্যাণ, পন্থা-পদ্ধতি শেখার, আমল করার সৌভাগ্য আমরা পেয়েছি।
কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ভোগের মানসিকতা পরিহার করে ত্যাগের মহিমায় অভ্যস্থ হওয়ার জন্য এটি একটি শিক্ষামূলক ইবাদত। স্বভাবগতভাবে আমরা সব সময় নিজের ভোগ-বিলাসের চিন্তায় মগ্ন থাকি। যে-কারণে ত্যাগের অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামী শরীয়ত ‘কুরবানী’র বিধান বিধিবদ্ধ করেছে। পশু জবাই এর মাধ্যমে একদিকে আমরা আমাদের সম্পদ তাঁর রাহে ব্যয় করার এবং অপরদিকে আমাদের সত্তার মাঝে লুকিয়ে থাকা পাশবিকতা, দোষ-ত্রু টি, পশু-প্রবৃত্তি বিসর্জন দিতে শিখবো; তাতেই আমাদের কুরবানী সফল ও স্বার্থক হবে।
করোনা ও কুরবানী: গত কয়েকদিন ধরে আলেম ও গর-আলেমসহ বেশ কয়েকজন জ্ঞানী-গুণী মানুষ বর্তমান করোনা মহামারির এ পরিস্থিতিতে, ‘এ বছর কুরবানী না করলে হয় না’? -মর্মে আমাকে প্রশ্ন করেছেন। এমনকি তাঁদের কেউ কেউ বর্তমান পরিস্থিতিতে কুরবানী করার প্রশ্নে অর্থাৎ না-করার পক্ষে নেতিবাচক অনেক যুক্তি, ওযর-আপত্তিও ব্যাখ্যা করতে চেষ্টায় ক্রুটি করেননি। যে-কারণে মনে হল, এমন দৃষ্টিভঙ্গি তো আরও অনেকেরও হয়ে থাকবে! তাই, ভুল বুঝাবুঝি দূরিকরনার্থে, লেখাটি প্রস্তুত করার এ প্রয়াস।
কুরবানী একটি ওয়াজিব আমল। করোনা’র ভয়ে বা তেমন সন্দেহ-সংশয়ের কারণে কুরবানী করা বাদ দেয়া যাবে না। যেমন কারও সন্দেহ জাগলো যে, ‘কুরবানী’র জন্য যে-পশুটি ক্রয় করবো, তা-ও যদি করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে?’ অথবা ‘আমি যদি কুরবানী’র জন্তুটি ক্রয়ে বাজারে যাই, আর আমাকেও যদি করোনা রোগে পেয়ে বসে?’ অথবা ‘যাদের দ্বারা কুরবানী’র জন্তুটি কাটা-ছেঁড়া করাবো, তাদের কেউ যদি করোনা রোগে আক্রান্ত রোগী হয়ে থাকে; তবে তো আমাদেরও করোনা হতে পারে!’ -ইত্যাদি সন্দেহ বা শঙ্কা বা আশঙ্কা’র কারণে কুরবানী’র ওয়াজিব আমল ছেড়ে দেয়া যাবে না বা কুরবানী রহিত বা মাফ হয়ে যাবে না। তবে হ্যাঁ, অপরাপর কাজ, হাট-বাজার বা অফিস-আদালত আমরা যেভাবে সতর্কতা অবলম্বন করে সম্পন্ন করে থাকি; স্বাস্থ্য-বিধি ও সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ রাখি -সেভাবেই আমাদের কুরাবানীসহ সবকিছু করে যেতে হবে।
তার কারণ:
১। শরীয়তে কেবল ‘শঙ্কা’ বা ‘আশঙ্কা’ বা ‘ধারণা’ বা ‘সন্দেহ-সংশয়’ এর কোন মূল্য নেই। কেননা, তেমন শঙ্কা, সংশয় ও সন্দেহ তো জাগতিক সর্বক্ষেত্রেও হয়ে থাকে বা থাকতে পারে। যেমন মনে করুন! আপনি রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় তো শঙ্কা জাগতে পারে যে, ‘পার্শ্ববর্তী দেয়ালটি না আবার ভেঙ্গে আমার মাথার ওপর পড়ে যায়!’ রেল-বাস-লঞ্চ বা বিমানে চড়তে গিয়ে সংশয় বা সন্দেহ জাগলো, ‘আরে! বাস-বিমান আবার দূর্ঘটনা কবলিত হয় কি না?’ অথবা ‘লঞ্চটি আবার ডুবে যায় কি না!’ এসব সন্দেহের কারণে কি আমরা জাগতিক কর্মকান্ড ছেড়ে দেই? কক্ষণও না।
২। অবশ্য শরীয়তে ‘প্রবল সন্দেহ বা শঙ্কা’র মূল্যায়ন আছে। অর্থাৎ যা বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে বা পাওয়া যাচ্ছে বা ঘটে যাচ্ছে এবং তার ‘আলামত-নিদর্শন-সংকেত’ বিদ্যমান। যেমন কিনা ‘পরিস্থিতি বিপদ-সঙ্কুল’ বা ‘আব-হাওয়া মারাত্নক খারাপ’ মর্মে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে বলা হচ্ছে -সেক্ষেত্রে আপাতত লঞ্চ ছাড়বে না এবং বিমান উড্ডয়ন করবে না। তেমন পরিস্থিতিতে বরং বিকল্প চিন্তা করা হবে, আপাতত যাত্রা স্থগিত করা হবে; কিন্তু প্রয়োজনীয় যাত্রা বা সফর একেবারে বাদ দেয়া হবে না।
অর্থাৎ কেবল সাধারণ ও স্বাভাবিক সন্দেহ-সংশয় এর কারণে, প্রয়োজনীয় কাজ, যাতায়াত, বা ইবাদত ইত্যাদি বাদ দেয়া যাবে না। এমনকি ‘প্রবল সন্দেহ-আশঙ্কা’র ক্ষেত্রেও তা পরিহার করা যাবে না। একইভাবে কুরবানী’র পশুটি যদি অসুস্থ মর্মে দেখা যাচ্ছে বা তেমন কোন রোগের আলামত পাওয়া যাচ্ছে; কিংবা যারা কাটা-ছেড়া করতে এসেছে তাদের কারও আলামত-সংকেত দেখা যাচ্ছে, যেমন প্রচন্ড হাঁচি-কাশি বা জ্বর -সেক্ষেত্রে তেমন কাউকে মজদুর হিসাবে নেয়া যাবে না; কাজে লাগানো হবে না। কারণ, এক্ষেত্রে ‘কেবল সন্দেহ’ নয় বরং ‘প্রবল সন্দেহ’ ও সম্ভাবনা বিদ্যমান; তাই শরীয়তেও তার মূল্যায়ন আছে। যে-কারণে দেখে-শুনে ও সতর্কতা রক্ষা করে কুরবানী করতে হবে; কিন্তু একেবারে বাদ দেয়া যাবে না; যেমন কিনা অপরাপর কর্মকান্ড বাদ দেয়া হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, শরীয়তের উক্ত বিবেচনা ও মূল্যায়নকে সামনে রেখেই দেশের বিজ্ঞ আলেম ও মুফতীগণ আলোচ্য ‘করোনা’ এর প্রারম্ভিক কালে নামায-জামাত-জুমু‘আ ইত্যাদি একেবারে বাদ বা বন্ধ করার নির্দেশনা প্রদান করেননি; বরং সাবধানতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সতর্কতা অবলম্বন করে সম্পাদন করতে বলেছেন মাত্র।
৩। আরেকটি ‘পরিস্থিতি বা অবস্থা’ এমন যা ‘নিশ্চিত’ (তায়াক্কুন বা ইয়াকীনী) ও ‘অবশ্যাম্ভাবী’। অর্থাৎ ‘নিশ্চিত আমি মারা যাব’ বা ‘নিশ্চিত যে, আমার ‘করোনা’ হবেই’; যেমন-‘নিশ্চিত যে, ‘মসজিদে গেলে আমার করোনা হবেই’; কিংবা ‘নিশ্চিত যে, মসজিদের উদ্দেশে বের হলেই পথিমধ্যে শত্রু আমাকে হত্যা করবেই’; কিংবা ‘এমনকি এ মুহূর্তে বা অমুক নির্দিষ্ট দিনে বা স্থানে বা সময় পর্যন্ত যদি আমি নিজ বাসা-বাড়ি-দোকানেও নামাযে দাঁড়াই, তা হলেও শত্রু অবশ্যই আমার ওপর হামলে পড়বে’ (জানা আছে বা গোপন খবর আছে)। এমন সব নিশ্চিত পরিস্থিতির ক্ষেত্রে শরীয়তেরই নির্দেশ বা নির্দেশনা হবে, “আপনি মসজিদে যাবেন না; জামাতে অংশগ্রহণ আপনার জন্যে নয়; এমনকি তেমন পরিস্থিতিতে আপনি বাসা-বাড়িতেও সালাত আদায় করবেন না”। তবে হ্যাঁ, পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক ও শান্ত হবে তখন আপনি সেই নামায/ আমল যদি ফরয বা ওয়াজিব স্তরের হয়; তা কাযা করে নেবেন। আর তা যদি সুন্নাত-নফল স্তরের কোন আমল হয়, তা হলে সেটি আর কাযাও করতে হবে না এবং তাতে কোন পাপও হবে না।
এখন বলুন তো, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে, উক্তসব অবস্থায় বা এমনিতেই আপনার করোনা-রোগ হবে? অথবা ‘করোনা রোগ’ হলেই, আপনি কি নিশ্চিত যে, আপনি অবশ্যই মারা যাবেন?’ না, না তেমনটি কারও বেলায়ই ‘নিশ্চিত’ নয়; বরং ‘সম্ভাব্য’ অথবা ‘অনেকটা সম্ভাব্য’। সুতরাং শরীয়া আইন গবেষণা’র উক্ত নিয়ম-বিধি অনুযায়ী তিনটি পরিস্থিতি অর্থাৎ ‘সম্ভাব্য বা শঙ্কা-আশংকা’র কোন মূল্য নেই; তাই বিধি মোতাবেক যাদের ওপর ওয়াজিব, তাদেরকে কুরবানী অবশ্যই দিতে হবে। আর যাদের সঙ্গত কারণে তেমন ‘প্রবল আশঙ্কা’ হবে, তাঁদেরও কুরবানী দিতে হবে। তবে হ্যাঁ, সার্বিক সতর্কতার প্রতিও যত্নবান থাকতে হবে; স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলতে হবে। আর আইন-বিধানের তৃতীয় ‘নিশ্চিত’ অবস্থা বা পরিস্থিতি যেহেতু আমাদের ‘করোনা’ পরিস্থিতির ব্যাপারে বলা যাচ্ছে না বা প্রযোজ্য বা প্রয়োগ করা যাচ্ছে না; তাই তেমন চিন্তা-কল্পনাও বাতিল, অবান্তর।
তথ্যসূত্র
১। আল-কাওয়াইদুল ফিকহিয়্যা: মুফতী আমীমুল ইহ্সান র.: পৃ-৭৫, ৮৮, ১০৭, ৬৫, ৬১, ৫৯, ১১৪; আশরাফী বুক ডিপো, দেওবন্দ, ইউ.পি. ভারত।
২। আল-আশবাহ ওয়ান-নাযায়ের: পৃ-১২, ১৩, ইত্যাদির বিধান চয়ন সংক্রান্ত নীতি-মূলনীতিগুলো দ্রষ্টব্য।
৩। ‘হাফতে আখতার’: হযরত শাহ আশরাফ আলী থানভী র.তা. বি. এইচ. এম. সাঈদ কোং, করাচী: (মূল গ্রন্থের ১৯৮-২২০ পর্যন্ত হজ ও কুরবানী বিষয়ে অনুরূপ মৌলিক ও আধ্যাত্নিক আলোচনা স্থান পেয়েছে এবং ইফা’র মূফতির গ্রন্থটির কৃত বঙ্গানুবাদে তা ১৯১-২২০পৃ- পর্যন্ত দেখা যেতে পারে)।
(দুই)
কুরবানীর অর্থ: আরবী ‘ক্বুরবান’ ও ‘ক্বুরবাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নৈকট্য লাভ করা, হোক তা পশু কুরবানীর দ্বারা বা অন্য কোনভাবে। একইভাবে ‘কুরবাতুন’ যেসব নেক আমল দ্বারা মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা হয় যেমন ইবাদত-আনুগত্য, কল্যাণকাজ ইত্যাদি (আল-মুসত্বালিহাত ওয়াল-আলফায়ুল-ফিকহিয়্যা: খ-৩, পৃ-৮০, দারুল-ফাযীলাহ, কাহেরা, মিসর)। বাংলা ভাষায় ‘কুরবানী’ মানে ত্যাগ, উৎসর্গ করা, পশু কুরবানীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তবে হাদীস, ফিকহ-ফাতাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থে ‘কুরবানী’ এর পরিবর্তে ‘উদ্বহিয়্যা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
পারিভাষিক অর্থে, “আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনকল্পে কুরবানীর দিনে যে পশু জবাই করা হয়, তারই নাম‘কুরবানী’। একই কারণে কুরবানীর দিনকে ‘ইয়াওমুল-আদ্বহা’ ও কুরবানীর ঈদকে ‘ঈদুল-আদ্বহা’ বলা হয়।” (কাওয়াইদুল-ফিকহি: মুফতী আমীমুল ইহসান র.পৃ-১৮২)।
ফাযাইল: (১) মহানবী (স) ইরশাদ করেন:
“ঈদুল-আযহা’র দিনগুলোতে মহান আল্লাহর কাছে আদম-সন্তানদের সর্বাধিক প্রিয় আমল হচ্ছে, তাদের পশু কুরবানী করা। আর এ পশুর শিং, লোম ও খুর কিয়ামত দিবসে তার পক্ষে (সাক্ষী হিসাবে) উপস্থিত হবে। এ কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই, আল্লাহর কাছে কবূল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানী করো (তিরমিযি ও ইবনে-মাজা)।
(২) আরেকটি হাদীসে এসেছে:
“সাহবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স)! এ কুরবানী’র স্বরূপ কি? মহানবী (স) উত্তরে বললেন, “এটা হচ্ছে তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ)-এর সুন্নাত-আদর্শ।” সাহাবাগণ পুনঃ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স)! এতে আমাদের কি লাভ হবে? নবীজী (স) উত্তরে বললেন, “তার প্রত্যেকটি লোমের বিনিময়ে এক-একটি করে পুণ্য রয়েছে”। তাঁরা পুনঃ আরজ করলেন, পশমের (ভেড়া ও দুম্বা) ক্ষেত্রেও? তিনি জবাব দিলেন, এগুলোরও প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে” (মুসনাদে আহমদ ও ইবনে-মাজা)।
(৩) মহানবী (স) আরও ইরশাদ করেন:
“যার কুরবানী করার সামর্থ থাকা সত্তে¡ও সে কুরবানী না করে, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে” (তারগীব/মুসতাদরাকে হাকিম)।
(৪) হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) বলেছেন:
“ঈদুল-আযহা দিবসের পরেও আরও দু‘দিন কুরবানী করা যায়। একই রকম বর্ণনা হযরত আলী (রা)-সূত্রেও বিদ্যমান” (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)।
(তিন)
কুরবানী’র নিয়ম বা মাসাইল:
কুরবানী কার জন্য ওয়াজিব? যাদের ওপর যাকাত/ফেৎরা ওয়াজিব হয়ে থাকে তাদের ওপর কুরবানীও ওয়াজিব। তবে পার্থক্য শুধু এটুকু যে, যাকাতের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ সম্পদ সারা বৎসর হাতে থাকা শর্ত; আর ফেৎরা ও কুরবানী’র ক্ষেত্রে যথাক্রমে ঈদুল-ফিতরের দিন এবং কুরবানী’র তিনদিন ওই পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই, ফেৎরা ও কুরবানী ওয়াজিব হয়ে থাকে।
কুরবানীর সময় : ১০ই যিলহাজ্জ ফজরের পর হতে ১২ই যিলহাজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত, এ তিনদিন কুরবানী করার সময়। তবে প্রথমদিনে বেশী সওয়াব পাওয়া যায়।
বিধি মোতাবেক যেখানে জুমু‘আ ও ঈদের সালাত জরুরী হয়ে থাকে সেখানে ঈদের সালাতের পূর্বে কুরবানী করা বৈধ নয়। আর যেখানে বিধি মোতাবেক ঈদের জামাত জরুরী হয় না সেখানে ফজরের পরেই কুরবানী করা যায়।
নিজের কুরবানীর পশু নিজহাতে জবাই করা উত্তম; তবে মেয়েলোক হলে অথবা অন্য কোন কারণে অপর কাউকে দিয়ে জবাই করলেও বাধা নেই।
কুরবানীর পশু জবাই করার সময় মুখে নিয়ত করা বা দু‘আ উচ্চারণ করা জরুরী নয়; করলে ভালো। তাই কেবল অন্তরে নিয়ত রেখে মুখে সশব্দে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলেই কুরবানী সহীহ-শুদ্ধ হয়ে যায়।
কুরবানী শুধু ব্যক্তির নিজের ওপর ওয়াজিব হয়। পুত্র-কন্যা বা স্ত্রীর কুরবানীযোগ্য নিজস্ব সম্পদ থাকলে, তাদের কুরবানী পৃথকভাবে তাদের ওপর ওয়াজিব হবে। তাই পূর্ব-আলোচনা ব্যতীত এবং একে-অপরকে দায়িত্ব বা অনুমতি প্রদান ব্যতীত কুরবানী করলে তা শুদ্ধ হবে না। সন্তান নাবালক হলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। সুতরাং নাবালকের সম্পদ থাকলেও তা থেকে কুরবানী করা বৈধ নয়। একইভাবে যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব সে নিজের ওয়াজিব পরিহার করে স্ত্রী/বাবা-মা বা অন্য কারও নামে কুরবানী করলে তাও শুদ্ধ হবে না। সঠিক নিয়ম হল, যাদের একাধিক পশু বা সাতজন শরীক হতে পারে এমন বড় একটি পশুর একাধিক শেয়ারের সক্ষমতা রয়েছে; তাঁরা প্রথমে নিজের ওয়াজিব পালনে একটি পশু বা একটি শেয়ার প্রদানের পর অবশিষ্ট পশু বা শেয়ারগুলো স্ত্রী / পুত্র / কন্যা / বাবা-মা / দাদা-দাদী / শ্বশুর-শাশুড়ী / পীর-উস্তাদ এবং রাসূল স. এর নামেও কুরবানী করতে পারেন।
সুতরাং, নিজের ওয়াজিব পালনের পাশাপাশি সামর্থ থাকলে, নফল হিসাবে মহানবী (স)-এর নামে, জীবিত বা মৃত পিতা-মাতা, দাদ-দাদী, শ্বশুর-শাশুড়ী, পীর-উস্তাদ প্রমুখের পক্ষেও কুরবানী করা উত্তম। এতে তাঁদের আমলনামায়ও বিশাল অঙ্কের সওয়াব যোগ হবে। উদাহরণত, যারা এককভাবে এক বা একাধিক পশু বা একাধিক অংশ কুরবানী করেন, তাঁরা একটি বা এক নাম নিজের ওয়াজিব হিসাবে দিয়ে অবশিষ্ট অংশে পিতা-মাতা, স্ত্রী প্রমুখের নামে দিতে পারেন।
উল্লেখ্য, ‘নামে’ বলতে অনেকে আবার প্রশ্ন করেন, ‘কুরবানী তো একমাত্র আল্লাহ্র নামেই হওয়ার কথা?’ তার জবাব হল, আসলে সাধারণ জনগণের বোঝার স্বার্থে বলা হয়ে থাকে, ‘অমুকের নামে’; কিন্তু মূলত তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, ‘অমুকের পক্ষে বা পক্ষ থেকে’ কুরবানী করা হচ্ছে। আর ‘আল্লাহ্র নামে’ বলতে, ‘তাঁর উদ্দেশ্যে বা তাঁকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে’। মনে রাখা চাই যে, শরীয়া আইন গবেষণা’র মূলনীতিতে বলা হয়েছে-
অর্থাৎ “সর্ব-সাধারণ, জনগণ যেসব শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে এবং কথা বলে থাকে; তাতে তাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কী? -শরীয়া আইনের বিবেচনায় সেটাই ধর্তব্য; তারা মুখে শব্দ বা বাক্য কি বললো, তা ধর্তব্য নয়”। সুতরাং এসব নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অবকাশ শরীয়তে নেই।
কুরবানীর পশু : ছাগল, খাসী, পাঠা, দুম্বা, ভেড়া নর-মাদী জন্তুতে শুধু একজন বা এক নামেই কুরবানী করা বৈধ হয়। আর গরু, মহিষ ও উট-এ তিন প্রকারের জন্তুতে এককভাবে অথবা সর্বোচ্চ সাতজনে মিলে কুরবানী দেয়া বৈধ হয়। তবে শরীকদের কারও অংশ এক-সপ্তমাংশের কম হলে কুরবানী শুদ্ধ হবে না। আবার শরীকদের কারও অংশ যদি পশুটির অর্ধেক হয় বা এক-তৃতীয়াংশ হয় অর্থাৎ দু’জনে বা তিনজনে সমান হারে কুরবানী দিচ্ছেন তাতেও কোন সমস্যা নেই; বরং ভালো। মোটকথা একজন শরীকের অংশ যেন এক-সপ্তমাংশের কম না হয়; সেটাই মূল বিবেচ্য ও ধর্তব্য।
কুরবানীর জন্তু ক্রয় থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ, ঘাস খাওয়ানো, জবাই, বন্টণ ইত্যাদি সর্বপ্রকার যৌথ খরচ, দায়-দায়িত্ব আনুপাতিক হারে সকল অংশীদারকে বহন করতে হবে; নতুবা কুরবানী সহীহ হবে না। অংশ অনুপাতে সমান হারে গোশত ইত্যাদি বন্টণ করতে হবে; তবে সম্মতি সাপেক্ষে পায়া/মাথা/ভুড়ি কোন শরীক যদি না নেয় বা কম নেয়, তাতে কোন সমস্যা নেই।
কুরবানীর গোশত: কুরবানীর গোশত কুরবানীদাতা, ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ সকলেই খেতে পারে। এমনকি অমুসলিমদেরও তা প্রদান বা আহার করা বৈধ। তবে যাকাত, ফেৎরা ও কুরবানীর চামড়া ইত্যাদি বাধ্যতামূলক দানগুলো অমুসলিমদের প্রদান বৈধ নয়। সুতরাং কুরবানী’র গোশত কোন অমুসলিমকে প্রদান বৈধ হয় বিধায় তার ওপর ভিত্তি করে কোন অমুসলিমকে যাকাত ইত্যাতি প্রদান বৈধ মনে করা যাবে না।
তা ছাড়া, কুরবানীর গোশতের ক্ষেত্রে সাধারণ বিধান হচ্ছে, তা তিন ভাগ করে একভাগ নিজে, একভাগ স্বজনদের এবং একভাগ গরবিদের প্রদান ‘মুস্তাহাব’ তথা ভালো। কিন্তু প্রয়োজনে তার ব্যতিক্রম বা কমবেশী করলেও কোন পাপ হবে না। অবশ্য, যত বেশী পরিমাণ গরীবদের দেয়া হবে ততবেশী উত্তম ও অধিক সওযাব পাওয়া যাবে।
মান্নতের কুরবানী, ওসিয়্যত পালনের কুরবানী এবং যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল কিন্তু বিশেষ কোন কারণ বশত কুরবানীর সুনির্দিষ্ট তিনদিনে তা পালন করতে না পারায়, পরে তা কাযা করছেন- সেক্ষেত্রে এ তিন প্রকার কুরবানীর গোশত নিজে বা ধনী কাউকে দান বা আহার বৈধ নয়। তা কেবল গরীবদের মাঝেই বন্টণ করতে হবে।
কুরবানী+আকীকা: “ছেলে সন্তান হলে আকীকায় দু’টি ছাগল বা দু’টি ভেড়া ইত্যাদি; আর মেয়ে হলে একটি ছাগল বা একটি ভেড়া জবাই করার নিয়ম। কিংবা কুরবানী’র গরু ইত্যাদির মধ্যে ছেলের আকীকার জন্য দু’অংশ আর মেয়ে’র আকীকার জন্য এক অংশ নিতে পারে। তেমন সচ্ছল না হলে বা সামর্থে না কুলালে ছেলের জন্যও একটি ছাগল বা কুরবানীতে এক অংশও নিতে পারে”। তবে কুরবানী যাদের ওপর ওয়াজিব বলে গণ্য; তারা কুরবানী বাদ দিয়ে আকীকা করলে, তা শুদ্ধ হবে না। কারণ, আকীকা ওয়াজিবও নয়, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাও (গরীবদের জন্য) নয়; বরং তা সুন্নাতে গায়রে-মুয়াক্কাদা’ পর্যায়ের। যে-কারণে অসমর্থ কেউ আকীকা না দিলে, তার কোন পাপ হয় না (রাদ্দুল মুহতার: খ-৫, পৃ-৩১৫(পুরাতন ছাপা), ইত্যাদি)।
কুরবানীর চামড়া: কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রয়ান্তে তা কেবল ফকীর-মিসকীনের হক হয়ে যায়। যে-কারণে চামড়ার মূল্য একমাত্র তাদেরকেই দেয়া যাবে যারা বিধি মোতাবেক যাকাত, ফেৎরা গ্রহণ করতে পারে। কোন ধনী বা সচ্চল ও অমুসলিম ব্যক্তিকে যেমনিভাবে যাকাত, ফেৎরা দেয়া যায় না; কুরবানীর চামড়াও এদের কাউকে দেয়া যায় না। একইভাবে তা ব্যাপক জন-কল্যাণমূলক যৌথ কোন কাজে বা প্রতিষ্ঠানের কাজে লাগানোর জন্যেও প্রদান করা জায়েয নয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠান বা সমিতি-সংস্থার তত্ত্বাবধানে যদি কোন গরীব-দরিদ্র লোকজন বা ছাত্র-শিক্ষার্থী থাকে তাদেরকে প্রদান করা জায়েয; এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অর্থাৎ যারা দরিদ্র অথচ ধর্মীয় কাজে বা শিক্ষায়রত তাদেরকে তা প্রদান করা উত্তমও বটে। উদাহরণত, মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, হাসপাতাল বা কোন সমিতি, সংস্থাকে তাদের নির্মাণ-কাজ বা বেতন ইত্যাদি বাবদ দেয়া যাবে না। কেননা, এসব ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক সুনির্দিষ্ট বৈধ ব্যয়খাত হিসাবে সংশ্লিষ্ট গরীব অসহায়দের সরাসরি মালিক বানিয়ে দেয়ার যে-শর্ত অবশ্য পালনীয়; তা পালিত হয় না এবং সম্ভবও হয় না। অবশ্য মাদরাসা বা এতিমখানার গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের, গরীব শিক্ষক/ ইমাম/ মুয়াযযেন/ খাদেম প্রমুখকে প্রদান করা বৈধ হয়। কিন্তু এদের কাউকেও তা বেতন বা পারিশ্রমিক বিবেচনায় প্রদান করা জায়েয নয়।
কুরবানীর পশু জবাই করার নিয়ম: কুরবানী করার নিয়ম হচ্ছে, জন্তুটিকে কিবলামুখী শায়িত করে যথাসাধ্য অধিক ধারালো চুরি/চাকু দ্বারা জবাই করবে।‘ইন্নি ওয়াজ্জাহতু.........’ আরবী দু‘আটি পাঠান্তে, কার কার বা কয়জনের পক্ষে কুরবানী হচ্ছে তা পূর্বে জেনে নিয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করবে। জবাই-পূর্ব মুহুর্তে যেমন মনে থাকবে, “হে আল্লাহ! আপনিই এ পশু সম্পদ দিয়েছেন এবং আপনার নামেই তা কুরবানী করছি”। একইভাবে জবাই শেষে বলবে, “হে আল্লাহ! এ কুরবানীকে সেভাবে কবূল করে নিন, যেভাবে তা আপনার হাবীব হযরত মুহাম্মদ (স) ও আপনার খলীল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পক্ষ থেকে কবূল করেছিলেন।”
মহান আল্লাহ আমাদের জেনে-শুনে, নিষ্ঠাপূর্ণ ও সহীহভাবে কুরবানী করার তাওফীক দিন। আমীন !
(তথ্যসূত্র : আল-বাহরুর রায়িক : খ-৯, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ ,ভারত ; আলমগীরী ; ফাতাওয়া শামী : খ-৯, যাকারিয়া বুক ডিপো , দেওবন্দ , ভারত , ইত্যাদি।)
লেখক: মুফতী ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন