করোনাকালে যখন চারদিকে সমন্বয়হীনতার কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, তখন কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, না সমন্বয়হীনতা নয়, বরং সব কিছুই হচ্ছে সুসমন্বিতভাবে। সমন্বয় না থাকলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন এত নিখুঁতভাবে নিম্নমানের মাস্ক উচ্চমূল্যে ক্রয় করে চিকিৎসকদের জীবন কি ঝুঁকিতে ফেলতে পারতো? মোটেই পারতো না। সমন্বয়হীনতা থাকলে কি মিঠু সিন্ডিকেট তাদের অফিসে বসে সরকারি হাসপাতালের প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে ক্রয় করার ফরমায়েশপত্র তৈরি করে ক্রয়াদেশ নিতে পারতো? কোনভাবেই পারতো না।
সমন্বয় ছিলো বলেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০১৪ সালের পর থেকে রিজেন্ট হাসপাতালের অনুমোদন না থাকা সত্তে¡ও করোনা চিকিৎসায় সরকারি ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে এর কর্ণধারের সাথে চুক্তি করেছিল। সমন্বয় ছিলো বলেই সাহেদ ভুয়া কোম্পানির নামে খুব সহজেই নিম্নমানের পিপিই সরবরাহ করতে পেরেছিল। সমন্বয়হীনতা থাকলে কোনো না কোনো স্তরে আপত্তি নিশ্চয় উত্থাপিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মধ্যে একটা বোঝাপড়া ছিলো বলেই সাহেদের মতো মানুষ এতবড় জালিয়াতি করতে পেরেছিলো। সমন্বয় ছিলো বলেই ভুয়া করোনা টেস্ট করার মধ্যদিয়ে সাহেদরা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পেরেছে। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিভাগের যেসব দুর্নীতি ও ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে তার গভীরে গেলে দেখা যাবে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মধ্যে নিবিড় বোঝাপড়া ছিলো বলেই অন্যায় হচ্ছে জেনেও কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। সমন্বয়হীনতা থাকলে কি ভার্চুয়াল মিটিংয়ের আপ্যায়ন বাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা বিল করা যেত? মোটেই না। সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মধ্যে সমন্বয় আছে বলেই কিন্তু এখনো ১৫/১৬ শত টাকার করোনা টেস্টের কিট প্রায় দ্বিগুণদামে কেনা হচ্ছে। বাজারে দাম কম জানার পরও এটা সম্ভব হচ্ছে কেন জানেন? শুধুই সমন্বয়। সাহেদরা খুব কার্যকরভাবে সমন্বয় করতে পেরেছিলো বলেই তো প্রায় ৫০টি মামলার আসামী হওয়া সত্তে¡ও নির্বিঘেœ বঙ্গভবনে পৌঁছাতে পেরেছিলো। সমন্বয় ছিলো বলেই ৯ম শ্রেণি পাশ একজন প্রতারক কত সহজেই পৌঁছে গিয়েছিলে দেশের সেনাপ্রধান থেকে পুলিশ প্রধানের কাছে। অনায়াসে পৌঁছে গিয়েছিলো মন্ত্রী থেকে সচিব, ব্যবসায়িক নেতা থেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে। রাজনীতিবিদ থেকে টকশো পর্যন্ত। জানি না, এর দায় কার।
তবে এটা তো বলাই যায় যে, পারস্পারিক সমালোচনা ও কাদা ছোঁড়াছুড়ির অপরাজনীতিই এর জন্য বহুলাংশে দায়ী। অন্যদিকে সরকারের অতিমাত্রায় আমলা নির্ভরশীলতা অনেক সময় অনিয়ম ও দুর্নীতিকে উসকিয়ে দিচ্ছে। তবে কাদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ৫০ মামলার আসামী সাহেদ বঙ্গভবন থেকে শুরু করে মন্ত্রী-সচিব, সেনাপ্রধান, পুলিশ প্রধানসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান পর্যন্ত পৌঁছালো তাদের কি খুঁজে বের করা হবে? তাদের কি বিচারের আওতায় আনা হবে? তাদের নাম কি জাতির সামনে উন্মুচিত হবে? নাকি সে প্রত্যাশা অধরাই থেকে যাবে? যদি সাহেদ ও ডা. সাবরিনাদের গডফাদারদের বিচারের আওতায় আনা না যায় তা হলে সেটা হবে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বড় অন্তরায়। আর একটা জিনিস আমার মোটেই মাথায় ঢোকে না, তা হলো, দেশে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কেন সাহেদ, ডা. সাবরিনা ও মিঠুদের মতো স্বাস্থ্যখাতের বড় বড় দুর্নীতিবাজকে চিহ্নিত করতে পারে না? নাকি করতে চায় না?
স্বাধীনতার পর দেশ এতবড় সংকটে কোনদিন পড়েনি। গোটা বিশ্ব আজ যুদ্ধ করছে এক অজানা শত্রু র সাথে। আমরা সে যুদ্ধ থেকে কিন্তু মুক্ত নই। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। অর্থনীতি বাঁচানোর যুদ্ধ, কর্ম টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ, কল-কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার যুদ্ধ, হুমকিতে পড়া দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সচল করার যুদ্ধ, গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দেবার যুদ্ধ, ইতোমধ্যেই কর্মহীন হয়ে পড়া বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির যুদ্ধ। অথচ এমন এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েও সরকারি ও বিরোধীদল একটেবিলে বসতে পারলো না। যা দুঃখজনক। কোনভাবেই করোনার মতো জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা গেল না। প্রতিদিন একপক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দোষারোপের রাজনীতি করে যাচ্ছে। জাতীয়-দুর্যোগ দুর্বিপাকেও যদি আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারি তাহলে দেশে উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা সুদূরপরাহত হবে। দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে দেশের রাজনীতি বের হতে না পারলে সুশাসন ও টেকসই উন্নয়ন মোটেই সম্ভব নয়। দুর্নীতি মূলত সরকারের সকল অর্জনকে অনেকাংশেই ম্লান করে দিচ্ছে। সরকারের দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার প্রচেষ্টাকে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
এদিকে স্বাস্থ্য সেক্টরের স্বাস্থ্য মোটেই ভালো নেই। দোষারোপের এক ভয়াবহ খেলা চলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে। রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে চুক্তি নিয়ে অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চলছে কাঁদাছোড়াছুড়ি। বহু বিতর্কের জন্ম দেয়া সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া ডিজি বলছেন, যা কিছু হয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবের নির্দেশেই হয়েছে। সাবেক সচিব বলছেন, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। তিনি কাউকে কোনো নির্দেশ প্রদান করেননি। মন্ত্রী মহোদয় তো একধাপ এগিয়ে বলে দিলেন তিনি ডিজির দাওয়াতে চুক্তি সম্পাদন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মাত্র। তিনি চুক্তি পড়ে দেখেননি, তাছাড়া এমন চুক্তি নাকি মন্ত্রীরা পড়েও দেখেন না। এদিকে অখ্যাত জেকেজির কোরানা টেস্টের কেলেঙ্কারী নিয়ে চলছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দোষারোপের ভিন্ননাটক। স্বাস্থ্যবিভাগের হর্তাকর্তাদের সাথে সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে কাজ বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ ব্যাপকভাবে চাওড় হওয়া সত্তে¡ও তারা নিজেদের ধোয়া তুলশিপাতা সাজার প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মাঝেই উঠে এসেছে বেসরকারি খাতের সাহাবুদ্দীন মেডিক্যাল কলেজের দুর্নীতি। সমন্বয় করে অনিয়ম, দুর্নীতি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিভাগে হচ্ছে তা কিন্তু নয়। সমন্বয় করেই সম্রাটরা মসজিদের নগরীকে ক্যাসিনোর নগরীতে পরিণত করলেও এখাতের পৃষ্ঠপোষকরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনৈতিক ও দলীয় সমন্বয় ছাড়া পাপিয়ারা কোনভাবেই পাপের সম্রাজ্ঞী হতে পরতো না। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একজন শামীমের পক্ষে শত শত কোটি কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে টেন্ডার সম্রাট হওয়া সম্ভবপর হতো না। দুর্নীতি শুধুমাত্র এ সরকারের আমলেই হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। কমবেশি সব সরকারের আমলেই হয়েছে। তবে করোনাকালের দুর্নীতি মানুষের বিবেককে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে।
করোনা মহামারির সময় মানুষ ন্যায়-অন্যায়, সততা ও অসততা প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাজ করবে, সেটাই ছিলো জাতির প্রত্যাশা। কিন্ত না। একশ্রেণির মানুষের সীমাহীন লোভ ও লালসার এক নিকৃষ্টতম উদাহরণ প্রত্যক্ষ করছে গোটা জাতি। করোনা মহামারির সময় দেশবাসীর মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি, অনিয়ম ও অসততা থেকে তারা বিরত থাকবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল দেশবাসী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশবাসী করোনাকালে দুর্নীতি এবং তার বহুমাত্রিক ধরন প্রত্যক্ষ করে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। আজকে দেশের রাজনীতিতে এক বিশাল শূন্যতা বিরাজ করছে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পরিবর্তে করোনাকালীন দুর্যোগ সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে সচিবরা, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার সাথে বেমানান। এতে করে রাজনীতিবীদদের প্রতি দিন দিন সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। এ সংকট গণতন্ত্র, সুশাসন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য মোটেই সহায়ক নয়। আধুনিক ব্যবস্থাপনার মূলমন্ত্রই হলো একজন মানুষকে তার অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার কাম্যপদে পদায়ন করে কর্মসম্পাদন করা।
যোগ্য মানুষকে যখন তার নিজের ক্ষেত্র ছেড়ে অন্য ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হয় তখন দেশে সুশাসনের ঘাটতি প্রকটভাবে দেখা দেবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। বাস্তবে হচ্ছেটাও তাই। প্রশাসন ক্যাডারে বহুসংখ্যক মেধাবী ডাক্তার কর্মরত থাকা সত্তে¡ও কেন তাদেরকে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে পদায়ন করা হয় না, তা এক বিরাট রহস্য। তবে একেবারেই যে হয় না তা কিন্তু নয়। তবে তা খুবই নগন্য। যদি স্বাস্থ্য প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত চিকিৎসকদের নিয়োগ বা পদায়ন করা হতো তাহলে স্বাস্থ্যবিভাগে আজ এতবড় হযবরল অবস্থা বিরাজ করতো না। প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বড় বড় পদে আসীন থাকার কারণে একজন ডাক্তার যেভাবে সুচারুরূপে স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়নে কাজ করতে পারতেন সেটা কিন্তু অন্য ডিসিপ্লিন থেকে আসা একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার পক্ষে কোনভাবেই পালন করা সম্ভব নয়। তাই বলে আমি বলছি না তারা অযোগ্য। বিষয়টি সরকারের ভেবে দেখা উচিত।
যোগ্য লোককে তার যোগ্যতা, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং প্রাজ্ঞতা অনুযায়ী পদায়ন করা না গেলে তার কাছ থেকে প্রাপ্ত সহযোগিতা কোনভাবেই রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে কাজে আসবে না। এক্ষেত্রেও বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে সুকৌশলে বিভাজন তৈরি করে একটি পক্ষ রাষ্ট্রকে তার কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত করছে। দুর্নীতিবাজরা সব সময় বা সব আমলেই রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে সমন্বয় করেই দুর্নীতি করে থাকে। সমন্বয়হীনতা থাকলে শুধুমাত্র কাজের অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতি করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই সমন্বয়হীনতা নয়, বরং সমন্বয় করেই চলছে স্বাস্থ্যখাতসহ অন্যান্যখাতের দুর্নীতি। জাতি সকল প্রকার অনিয়ম, অবিচার ও দুর্নীতি থেকে মুক্তি চায়।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন