শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

গাউসে জমান সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.)

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২০, ১২:০৩ এএম

আমাদের প্রিয়নবী তাজেদারে মদীনা সরওয়ায়ে কায়েনাত হুজুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রবর্তিত ও প্রচারিত মানবমুক্তির একমাত্র হাতিয়ার দ্বীন ইসলাম’র রক্ষণ ও হেফাজতের দায়িত্ব পালন করছেন পরম শ্রদ্ধাষ্পদ আওলাদে রসূল ও নায়েবে রসূলগণ।

এরই ধারাবাহিকতায় গাউসে জমান, আওলাদে রসূল (৩৯তম) আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহে আলায়হির আবির্ভাব ঘটে দ্বীন মাযহাব মিল্লাতের প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যে।

জন্ম : পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (খাইবার পাখতুন খাওয়া) হাজারা জিলার সিরিকোট শরীফের নবী বংশে (১৯১৬ খ্রি.) গাউসে জমান তৈয়্যব শাহ্ (রা.) শুভাগমন করেন পিতা আওলাদে রসূল আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.) ও মাতা সৈয়্যদা খাতুনের ঔরসে।

পিতা কুতুবুল আওলিয়া ও আনজুমান ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠাতা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আফ্রিকায় দ্বীন-ইসলাম প্রচার ও ব্যবসা শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। একদা বিশ্বের অদ্বিতীয় ত্রিশ পারা দুরূদ শরীফ প্রণেতা ইলমে লাদুন্নবীর প্রস্রবণ খাজা আবদুর রহমান চৌহরভীর হাতে বায়আত গ্রহণ করে পীরের খিদমতে নিবেদিত হন। এমতাস্থায় একদিন হুযূর চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রিয় শীর্ষ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্’র শাহাদাত আঙ্গুলি নিজের পিঠে ঘর্ষণ করে বলেন, ‘‘ইয়্যে পাক সিজ তুমনে লেলো’’ (এ পবিত্র জিনিস তুমি নিয়ে নাও)। পরবর্তীকালে হুযূর তৈয়্যব শাহ্’র জন্ম হলে (১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে) নাম রাখা হয় তৈয়্যব শাহ্। সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘‘তৈয়্যব মাদারাজাত ওলী হ্যায়, উসকা মকাম বহুত উঁচা হ্যায়।’’
এতে বুঝা যায় পবিত্র আমানত এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হবার প্রক্রিয়া অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক পন্থায় হয়ে থাকে। লক্ষ করলে দেখা যায় বহু শতাব্দী পূর্বে এ রকম আরেকটি কারামতের অবতারণা হয়েছিল। শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা মহিউদ্দিন ইবনুল আরবী (রহ.)’র জন্মপূর্ব ঘটনাটিও ছিল অবিকল এ রকম। সন্তান প্রার্থীর পিঠের সাথে নিজের পিঠ ঘর্ষণ করে গাউসুল আযম মীর মহিউদ্দিন সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি যে সন্তান দান করেছিলেন সে মহান ব্যক্তিত্ব ইবনুল আরবী বিশ্বে সুফীবাদ ও আধ্যাত্মিক সোপানের উঁচু স্তরের মর্যাদায় আসীন হন।

জন্মের কয়েকমাস অতিবাহিত হলে শিশু তৈয়্যবকে শিরনী খাওয়ানোর জন্য (আমাদের দেশেও প্রচলিত) হযরত চৌহরভীর দরবারে নিয়ে যান আম্মাজান। খলিফায়ে শাহে জিলান হযরত চৌহরভী বাচার মুখে শিরনী তুলে না দিয়ে শিশুর উদ্দেশে বলেন, তৈয়্যব তুম নেহী খাতেতো, ম্যায় ভী নেহী খায়েঙ্গে। কথা শেষ হতে না হতেই মাদারজাত ওলী শিশুটি গরম শিরনীতে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। মাতা পিতাসহ উপস্থিত সকলেই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে কারো বুঝতে বাকী রইলো না যে, এ শিশু ভবিষ্যতে উঁচু দরজার ওলী হবেন। মাতৃদুগ্ধ ছাড়ার কাছাকাছি সময়ে শিশু তৈয়্যবকে নিয়ে হুজুরের দরবারে যান আম্মাজান। ক্ষুধার্ত শিশু দুধপান করার জন্য মায়ের কোলে ছট্ফট্ করছেন দেখে হুজুর চৌহরভী বললেন, ‘তৈয়্যব তুম বড়া হো গায়া, দুধ মত পিয়ো’। দুগ্ধপোষ্য শিশু সাথে সাথে স্থির হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে আম্মাজান দুধ পান করানোর শত চেষ্টা সত্তে¡ও শিশু তৈয়্যবকে দুধ পান করাতে পারেননি। বেশী সাধাসাধি করলে বলতেন, বাজি-নে মানা কিয়া, দুধ নেহী পিয়োঙ্গা’ সুবহানাল্লাহ্। কারামতের প্রকাশ শুরু হলো শিশু বয়স থেকে।

হুজুর কেবলার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি আব্বাজান-আম্মাজানের নিকট। অতি অল্প বয়সে তিনি কুরআন হিফয করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভীর প্রতিষ্ঠিত হরিপুর মাদরাসায়ে রহমানিয়ায় খ্যাতনামা উস্তাদদের নিকট হতে বিশেষ করে প্রখ্যাত আল্লামা সরদার আহমদ লায়লপুরীর বিশেষ তত্ত্বাবধানে কুরআন-হাদিসসহ অনেক বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করার সুযোগ পান।

শরিয়ত শিক্ষার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক বিষয়ে তিনি দীক্ষিত হন যুগশ্রেষ্ঠ ওলী পিতা হযরত সিরিকোটির হাতে ‘বাইআত’ গ্রহণ করে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে খেলাফতপ্রাপ্ত হন। কাদেরিয়া সিলসিলার কার্যক্রম শুরু করেন তখন থেকেই। তিনি হরিপুর রহমানিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করে অধ্যক্ষ পদে আসীন হন।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে শাবান মাসে হুযুর তৈয়্যব শাহ্ প্রথম চট্টগ্রাম আসেন। হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.) রেঙ্গুনের মিশন শেষ করে চট্টগ্রামে ঐ সময় থেকে স্থায়ীভাবে শরিয়ত, তরিকত তথা সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার মিশন শুরু করেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ভবনে খানকাহ স্থাপনের মাধ্যমে। চট্টলার কৃতি সন্তান হুযূর কেবলার খলিফা, দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসের মালিক আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আবদুল খালেক (রহ.) এর অনুরোধে হুজুর এখানে অবস্থান করতেন। এতদঞ্চলে সিলসিলার প্রচার প্রসার মূলত এখান থেকেই শুরু হয়। হুজুর তৈয়্যব শাহ্ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে খতমে তারাবীহ্র ইমামতি করেন।

উল্লেখ্য, হযরত সিরিকোটি (রহ.) বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) শেষ সফরের সময় (১৯৫৮খ্রি.) তৈয়্যব শাহ্কে ‘খিলাফত প্রদান ও দরবারের সাজ্জাদানশীন পীর মনোনীত করেন। আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের গঠনতন্ত্র সংশোধনের দায়িত্ব অর্পণ করে আনজুমান ট্রাস্টে অভিষিক্ত করেন এই বছরেই। তাঁর এদেশে আগমনের মাধ্যমে সুন্নীয়তের প্রচার প্রসার আরো গতিশীল হয়ে উঠে। ১৯৭৪ সালে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন উপলক্ষে ‘জশনে জুলুস’ বের করার নির্দেশ দেন আনজুমান কর্তৃপক্ষকে। সে বছর প্রথম জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী বের হয় তৎকালীন আনজুমান নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে। এর উত্তরোত্তর ব্যাপকতা ও শ্রীবৃদ্ধি যুগশেষ্ঠ সংস্কারকের অমূল্যবাণী শাশ্বত রূপ পরিগ্রহ করেছে আজ। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে হতে হুজুর তৈয়্যব শাহ্ ও ১৯৮৭ খ্রি. হতে সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ এ জুলুছের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা ইউনিয়ন ওয়ার্ড প্রত্যন্ত অঞ্চলে আনজুমান ট্রাস্টের প্রত্যক্ষ মদদে ও গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র সহযোগিতায় এ জুলুছ ব্যাপকভাবে পালিত হয়ে আসছে।

হুজুর ক্বেবলা তৈয়্যব শাহ্ ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আনজুমান ট্রাস্টকে সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক পত্রিকা বের করার নির্দেশ দেন। হুযূরের নির্দেশ মোতাবেক ‘তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ নামক একটি মাসিক পত্রিকার যাত্রা আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে অদ্যবধি চলমান। হুজুর কেবলা বলেছেন, ‘ইয়ে তরজুমান বাতিল কেলিয়ে মউত হ্যায়। কিয়ামত তক ইয়ে তরজুমান রেহেগা।’

ফজরের নামাজান্তে হুজুর কেবলার দরসে কুরআন যারা শুনেছেন তারা কোনদিন ভুলতে পারবেন না। শান-এ নুযুলসহ আয়াতে করীমার অর্থ ও ব্যাখ্যা শুনে আলেম-ওলামাগণ তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে যেতেন।

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে গাউসে পাকের নির্দেশে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। হুজুর কেবলার অমীয় বাণী ‘দ্বীন কো বাচাও, ইসলামকো বাচাও সাচ্চা আলেম তৈয়ার করো’ এ নীতির উপর ভিত্তি করে আনজুমান ট্রাস্ট ও অঙ্গ সংগঠন গাউসিয়া কমিটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে করোনা ভাইরাসকালে মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফনে সহযোগিতা করে গাউসিয়া কমিটি দেশে-বিদেশে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছে। ১৯৯৩ সালের ১৫ জিলহজ্ব হুযূর কেবলা ওফাত বরণ করেন।
আমরা যেন হুজুরের নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালিত করে রেজামন্দি হাসিল করতে পারি- এ হোক আমাদের শপথ।

লেখক: প্রচার সম্পাদক আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Monjur Rashed ৪ আগস্ট, ২০২০, ১:৩২ পিএম says : 0
Masha Allah, Great contributor in propagating Sufism in subcontinent
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন