বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শাসকের অপরিহার্য কর্তব্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০২০, ১২:১০ এএম

আরবিতে ‘আদল’ বলতে ন্যায়বিচারকে বোঝায়। ন্যায়বিচারালয়ের নাম আদালত, যেখানে অন্যায়-অবিচারের সুযোগ নেই। এ বিচারকার্য সম্পন্ন করার নাম ‘ইনসাফ’ অর্থাৎ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ‘মুনসেফ’ নামে পরিচিত। যে কারো মধ্যে এ ন্যায় পরায়ণতা তথা সৎগুণ থাকতে পারে। বিচারকার্য পরিচালনার জন্য যারা এ বিভাগে সরকার কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে থাকেন তারা কাজী নামে পরিচিত। বাংলায় বলা হয় বিচারক, বিচারপতি এবং বিচারপতিদের প্রধানকে বলা হয় প্রধান বিচারপতি। বর্তমানে যেসব মওলানা, মওলভী, মুনশী, মোল্লা বিয়ে পড়িয়ে থাকেন, তারা কাজী নামে অভিহিত হয়ে থাকলেও বিচারক বা বিচারপতি বিষয়ে বিশেষায়িত নন। ইসলামে প্রথম ‘কাজিউল কোজাত’ বা প্রধান বিচারপতির অতি সম্মানিত সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করেছিলেন হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) এর প্রধান শাগরেদ এবং হানাফী মাজহাবেরই স্তম্ভ চতুষ্টয়ের প্রধান হজরত ইমাম কাজী আবু ইউসুফ (রহ.)। এটি আব্বাসীয় খেলাফত আমলের প্রথম দিকের কথা।

কোরআনের অসংখ্য আয়াতে ন্যায়বিচারের উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অসংখ্য হাদিসে ‘আদল’ ও ‘ইনসাফ’ তথা ন্যায়বিচারের বিবরণ রয়েছে। একটি বিখ্যাত হাদিসে কেয়ামতের দিন যে সাত শ্রেণির লোক আরশের তলে ছায়া পাবে বলে উল্লেখ আছে, তাদের মধ্যে একটি শ্রেণি হচ্ছে ‘ইমামে আদল’ বা ন্যায়বিচারক। সেদিন আল্লাহ ছাড়া আর কারো ছায়া থাকবে না বলে হাদিসের ভাষ্যে বিদ্যমান। অপর এক প্রসিদ্ধ হাদিসে রসূলুল্লাহ (সা.) অত্যাচারী সুলতানের সামনে সত্য কথা (কালেমাতু হাক্কিন) বলাকে উত্তম জেহাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

রসূলুল্লাহ (সা.) ‘আদল’ অর্থাৎ ইনসাফপছন্দ ও ন্যায়নীতির অনুসারী ছিলেন, যা তাঁর পূত পবিত্র জীবনের ছত্রে ছত্রে প্রত্যক্ষ করা যায়। তিনি তাঁর সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কেও মন্তব্য করতে গিয়ে তাদের প্রশংসায় বলেছেন যে, ‘তারা সবাই আদলুন অর্থাৎ- ন্যায়পরায়ণ এবং আকাশের তারকারাজির ন্যায় (উজ্জ্বল), তোমরা তাদের যে কারো অনুসরণ করবে, হেদায়েত প্রাপ্ত হবে।’

হুজুর (সা.) কর্তৃক প্রশংশিত সাহাবায়ে কেরামের যে কারো প্রতি কেউ কটাক্ষপাত করলে, গালমন্দ করলে, কিংবা লিখলে তার শাস্তির কথাও বলেলেছেন, ‘মান সাব্বা নাবীয়্যান, ফাকতুলুহু। অ মান সাব্বা আছহাবি ফাদরিবুহু’, অর্থাৎ- যে ব্যক্তি কোনো নবীকে গালমন্দ করে তাকে হত্যা কর। আর যে ব্যক্তি আমার আছহাবকে গালি দেয় তাকে প্রহার কর।’
হজরত আবদুর রহমান ইবনে মোগাফ্ফাল মুজানি (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার সাহাবা সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় কর, আমার পর তাদেরকে নিজেদের নিন্দা-সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে না।...’

সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য রসূলুল্লাহ (সা.) এর নবুয়াতি জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর ভ‚মিকা ছিল অতুলনীয়, যার প্রতিফলন দেখা যায় প্রত্যেক সাহাবির জীবনে ও কর্মে। তাই তিনি তাদেরকে ‘আদুল’ বা ন্যায়পরায়ণ বলে আখ্যায়িত করে নক্ষত্ররাজির মতো অতি উজ্জ্বল বলেছেন, এমনকি একজন বাদশাহর ন্যায়পরায়ণতার কথা শুনে তার মধ্যে দারুণ আবেগের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি ছিলেন ‘আদেল’ উপাধিতে ভ‚ষিত সম্মানিত বাদশাহ আবু খসরু আনওশিরাওয়ান। তাঁর যুগ ৫৩১ থেকে ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ৫৭০/৭১ সালে রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মেরও কয়েক বছর পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। তাঁর সময়ে ন্যায়বিচারের কাহিনী শ্রবণ করে রসূলুল্লাহ (সা.) গর্ববোধ করতেন তার যুগে তার জন্ম হওয়ার জন্য।

নওশিরাওয়ান আদেলের ন্যায় ও সুবিচারের নানা কাহিনীতে পারস্যের ইতিহাস পরিপূর্ণ। হজরত শেখ সাদী (রহ.) ও তার বিখ্যাত পুস্তক, ‘গুলিস্তানে’র শুরুর ভাগে নওশিরাওয়ান আদেলের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ এখানে আমরা খলিফা জাহের বি-আমরিল্লাহর কথা উল্লেখ করতে চাই। তিনি ইনতেকালের মাত্র কয়েকদিন পূর্বে তাঁর রাষ্ট্রের সকল শাসক ও পদস্থদের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ফরমান জারী করেন, যা নিম্নরূপ:
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, আমি তোমাদেরকে মুক্ত ছেড়ে দিয়েছি এবং তোমাদের গতিবিধি হতে চোখ বন্ধ করে রেখেছি। এর কারণ বেখবর থাকা ও বেপরোয়া থাকা নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে করেছি, যাতে অনুমান করা যায় যে, তোমাদের মধ্যে কার কর্মকান্ড পছন্দনীয়, তা যাচাই করা, পরীক্ষা করা। তোমাদের কৃত পূর্বের সকল গতিবিধি অর্থাৎ দেশের ধ্বংস, প্রজা সাধারণের গৃহ বরবাদ, শরীয়তের অবমাননা, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা দ্বারা সত্যকে গোপন করে প্রকাশ্যে বাতিলের প্রচার, ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অঙ্গীকার ও তদারকির চমৎকার শব্দাবলীর দ্বারা নির্মূল ও অভাবের ব্যাখ্যা ইত্যাদি যেগুলো তোমরা একটি গর্জনকারী বাঘের সামনে সাধন করেছ, ক্ষমা করে দেয়া হচ্ছে।

তোমরা সেই সিংহের আমানতদার ও আস্থাভাজন হও, এটা সত্তে¡ও তার মতামতকে নিজেদের আশা আকাক্সক্ষা অনুযায়ী এবং নিজেদের বাতিলকে (অন্যায়কে) তার পক্ষে মিশিয়ে দিতে চাও, সে তোমাদেরকে প্রদান করে এবং তোমরা তার নির্দেশ অমান্য কর এবং সে তোমাদের সাথে সহানুভ‚তি প্রদর্শন করে এবং তোমরা তাঁর সাথে শত্রু তা করতে বদ্ধপরিকর। এখন তোমাদের ভয়কে আল্লাহ নির্ভীক, তোমাদের অভাবকে প্রাচুর্যে এবং তোমাদের বাতিলকে হক (সত্য) দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে এমন একজন শাসনকর্তা দিয়েছেন যে, ভুলগুলো ক্ষমা করে দেয়, কেবল তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তারই প্রতিশোধ নেয়, যে বারবার পদস্খলনে স্থির থাকে। সে তোমাদেরকে ইনসাফ করার নির্দেশ দেয় এবং তোমাদের কাছ থেকে ইনসাফ প্রত্যাশা করে। সে তোমাদেরকে জুলুম করতে নিষেধ করে এবং তা তোমাদের জন্য মন্দ মনে করে, সে নিজেই খোদাকে ভয় করে এবং তোমাদেরকে শক্তি বলে তার ভয় প্রদর্শন করতে চায়। খোদার নিকট উত্তম রূপে আশাবাদী হওয়া এবং তার আনুগত্য লাভের প্রতি উৎসাহিত করে। সুতরাং তোমরা দুনিয়াতে আল্লাহর খলিফাদেরকে এবং তাঁর মাখলুকের আমিনদের আনুগত্য করলে উত্তম, নতুবা ধ্বংস হয়ে যাবে।’

এ ফরমানের সাথে খলিফা একটি মৌখিক বাণীও প্রেরণ করেন এবং তাতে বলেন, ‘এ ফরমানের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, লোকেরা কেবল মুখে এই কথা বলা যথেষ্ট মনে করবে যে, ফরমান জারি হয়েছে, বরং তার পূর্ণ প্রভাব এবং পূর্ণ পরিণতির কার্যকর অবস্থায় প্রকাশ পাওয়া উচিত। তোমাদের জন্য কথার ইমাম অপেক্ষা অধিক কর্মের সৌন্দর্যমন্ডিত ইমাম প্রয়োজন।’

ইবনে আসির লিখেছেন, ‘উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) এর পর জাহেরের ন্যায় বুদ্ধিমান, ন্যায়পরায়ণ এবং মোত্তাকি খলিফা উম্মতের নসিব হয়নি।’ আব্বাসীয় আমলের ৩৫তম খলিফা জাহের বি-আমরিল্লাই হিজরী ৬২২ সালে খেলাফত লাভ করেন এবং মাত্র ৯ মাস ১৪ দিন খলিফা থাকার পর, ১৪ রজব ৬২৩ সালে ইনতেকাল করেন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন