শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা.)

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৫:৩৯ পিএম, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৮

সামাজিক আচার আচরণ ও মেলামেশা মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ন্যায়বিচার হলো সামাজিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলার সোপান। ন্যায়বিচারের মাধ্যমেই সমাজবদ্ধ জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। যে দেশ ও সমাজে মজলুম মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় সেখানে আল্লাহর আজাব ও আসমানী গজব নাজিল হয়। আখলাকুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা নবীচরিত্র একটি সামগ্রিক বিষয়। বিচারকার্যে নবীর চরিত্র বা আখলাক তারই একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নবুওয়তির ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মিশন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে পূর্ণতা লাভ করে। তাঁর মিশনের লক্ষ্য ছিল জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা। দীর্ঘ ২৩ বছরে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন সার্থকভাবে। তাঁর উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থা মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বদিক দিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিয়ামক ও চালিকা শক্তি। পবিত্র কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, “মহান আল্লাহ সব নবী ও রাসূলকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের বিধান এবং তা কার্যকর করার দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন।” [সূরা হাদিদ : ২৫]
পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো দ্বারা মনোনীত বিচারক ছিলেন না। তাঁকে বিচারক হিসেবে মনোনীত করেছিলেন স্বয়ং আহকামুল হাকিমিন আল্লাহ তা‘আলা। আলকুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘‘(হে নবী)! আমি সত্যসহকারে আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যাতে আপনি আল্লাহর দেখানো মুক্তির আলোকে বিচার-আচার করতে পারেন।’’ [সূরা নিসা : ১০৫]
মক্কার কাবা ঘর। যাকে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলা হয়। প্রাচীন কাল হতেই এ ঘরটি সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অতি পরিচিত। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন এই ঘরের সংরক্ষক। প্রতিটি মুসলমান পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময় কাবা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। আমাদের মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আবির্ভাবকালে কাবা ঘরের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিলো। কাবা ঘরের চারপাশে প্রাচীর-বেষ্টিত না থাকায় বর্ষার সময় ভেতরে পানি ঢুকে পড়ত। তাছাড়া উপরে কোন ছাদ ছিলনা বলে সময়ে সময়ে উহার আসবাবপত্রও চুরি যেত। এসব কারণে কোরেশগণ অনেক দিন যাবৎ কাবা ঘর মেরামতের জল্পনা-কল্পনা করে আসছিলো। এমন সময় আরবের জেদ্দা বন্দরে হঠাৎ একখানি জাহাজ নষ্ট হলে কোরেশদিগের কাবা ঘর মেরামতের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। জাহাজের তক্তাগুলি তারা সস্তাদরে কিনে আনলেন এবং তা দিয়ে মেরামতকার্য আরম্ভ করলেন। কোরাইশ দলপতিগণ সবাই মিলেমিশে কাজ করছিলেন, কিন্তু হঠাৎ একটি ঝামেলা বাজলো। কাবা ঘরের ভেতরে যে হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) টি ছিলো, তা তুলে এনে নির্দিষ্ট স্থানে কারা স্থাপন করবে, এ বিষয়ে দলপতিগণের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলো। হাজরে আসওয়াদের সাথে সামাজিক ও বংশগত মর্যাদার বিষয় জড়িত ছিলো। কাজেই প্রত্যেক গোত্রই ইহা তুলবার আগ্রহ দেখাল। প্রথমে তর্ক-বিতর্ক তারপর তুমুল দ্বন্ধ-কোলাহলে লিপ্ত হলো। চারদিন এভাবে কেটে গেলো। কিন্তু কোনই মিমংসা হলো না। অবশেষে প্রথানুসারে সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। যুদ্ধ যখন একেবারে অনিবার্য হয়ে উঠলো, তখন জ্ঞানবৃদ্ধ আবু উমাইয়া সবাইকে আহŸান করে বললেন, “ক্ষান্ত হও, আমার কথা শোন। সামান্য কারণে কেন রক্তপাত করবে? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর। আমার প্রস্তাব : যে ব্যক্তি আজ সর্বপ্রথম কাবা ঘরে প্রবেশ করবে তার উপরেই বিবাদের ফায়সালার ভার অর্পণ করা হোক। সে যে সিদ্ধান্ত দিবে, তাই আমরা মেনে নিবো। এতে তোমরা রাজি আছো? বৃদ্ধের প্রস্তাবে সবাই সম্মত হলেন। সবাই প্রথম আগন্তকের প্রতীক্ষায় উদগ্রীব। প্রত্যেকের মনে কত চিন্তার উদ্রেক। যে আসবে সে কেমন লোক হবে, কোন পক্ষে সে রায় দিবে, তাঁর সিদ্ধান্ত যদি সবার মনঃপূত না হয়, তখন কি ঘটবে ইত্যাদি নানা চিন্তা সবার মনে খেলতে লাগলো। এমন সময় সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, “এই যে আমাদের ‘আল-আমীন’ আসছেন। আমরা তাঁর সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই মেনে নিবো।” মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তরুণমাত্র। কিন্তু তবুও মক্কাবাসীদের কী অগাধ বিশ্বাস ছিলো তাঁর উপর! মুহাম্মাদ আসলে সবাই তাঁকে সমস্ত ব্যাপার বুঝিয়ে বললো। তখন তিনি বললেন, “বেশ, ভাল কথা। যে সকল গোত্র হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) তুলবার দাবী করছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নিজেদের মধ্য হতে এক একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত করুন।” তাই করা হলো। তখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিনিধিদেরকে সঙ্গে নিয়ে কালো পাথরের কাছে গেলেন। একখানি চাদর বিছিয়ে নিজে সেই পাথরখানা উহার মাঝখানে রাখলেন। তারপর প্রতিনিধিদেরকে বললেন : “এইবার আপনারা সবাই এই চাদরখানার এক এক প্রান্ত ধরে পাথরখানাকে যথাস্থানে নিয়ে চলুন।” সবাই তাই করলেন। গন্তব্য স্থানে উপনীত হলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় পাথরখানা নিজ হাতে তুলে যথাস্থানে রাখলেন। এই বিচারে সবাই সন্তুষ্ট হলেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিচক্ষণতায় সবাই মুগ্ধ হলেন। বেঁচে গেলো আরবভূমি একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হতে।
জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফের গুরুত্ব অপরিহার্য। কারণ ন্যায়বিচার ছাড়া মানব জীবনের কোনো ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম আদর্শ পুরুষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহান রাব্বুল আলামীন নির্দেশ করে বলেছেন, “বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি।” [সূরা শুরা : ১৫]
আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজে ন্যায়বিচারের মানদন্ড সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। জাতি-ধর্ম, বর্ণ-শ্রেণি, পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ধনী-দরিদ্র, প্রভু-ভৃত্য সবাইর ক্ষেত্রে বিচার সমান, এখানে বিন্দুমাত্র হেরফেরের অবকাশ ছিল না। দয়া বা পক্ষপাতিত্ব আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। ‘আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজস্ব ব্যাপারে কারো নিকট হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি।” [হাফিজ আবু শায়খ ইসফাহানি, আখলাকুন নবী (সা:), পৃ. ১৯]
তিনি বিচারকাজে সর্বপ্রকার স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থাকতেন। তিনি বলতেন, আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করে তবে আমি নির্দ্বিধায় চুরির শাস্তি হিসেবে তার দু’হাত কেটে দেবো। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষদানকারী হিসেবে সদা দন্ডায়মান হও। কোন কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” [সূরা আল-মায়িদা : ৮] আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন, “আর যখন তোমরা মানুষের কোনো বিচার মীমাংসা করতে আরম্ভ করো তখন ইনসাফের সাথে বিচার মীমাংসা করো।” [সূরা নিসা : ৫৮] হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও একে হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’’ [মুসলিম : ৬৭৪০]
হাফিজ ইবনে কাইয়্যিম রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, “আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্য হলো জনগণের মাঝে ইনসাফ কায়েম করা এবং জনগণকে ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখা।” [হাফিজ ইবনে কাইয়্যিম আলামুল মুকিইন]
ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিচারকাজ পরিচালনা না করা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আউফা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা একজন বিচারকের সাথে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ তিনি বিচারকাজে জুলুম-অত্যাচারের ঊর্ধ্বে থাকেন, যখন তিনি জুলুম ও বেইনসাফি করেন তখনই আল্লাহ তার থেকে পৃথক হয়ে যান এবং শয়তান এসে তার সাথী হয়ে যায়।” [তিরমিজি, ইবনে মাজা]
আব্দুর রহমান ইবনে আবী বাকরা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিচারক ও ন্যায়বিচারের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বলেছেন, “রাগান্বিত অবস্থায় যেন কোনো বিচারক দু’জন বিবদমানের মধ্যে বিচার ফায়সালা না করেন।’’ [বুখারি, মুসলিম] কারণ ক্রদ্ধাবস্থায় মানুষের অবস্থা স্বাভাবিক থাকে না। মেজাজ ঠিক থাকে না। ফলে সঠিক রায় ও ন্যায়বিচার তার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশ কয়েকটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত তিনি অর্থসম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালান। সমকালীন দুনিয়া বিশেষত প্রাক- ইসলামি সমাজে ধন-সম্পদ ছিল আভিজাত্যের মাপকাঠি, কামিয়াবির নিদর্শন, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। তাই মানুষ হন্যে হয়ে অর্থ ও সম্পদ অর্জনের পেছনে ছুটেছে সারা জীবন। বৈধ-অবৈধ, হালাল-হারাম, ন্যায়নীতি, পাপ-পুণ্য এসব ধার ধারেনি। এভাবে মানুষ হয়েছে অর্থ-সম্পদের দাস, আর অর্থ-সম্পদ হয়েছে তাদের প্রভু। মানুষে মানুষে রক্তপাত, হানাহানি, যুদ্ধংদেহী মনোভাবের সূত্রপাত সম্পদকে কেন্দ্র করেই হয়। সে জন্যই ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে হালাল উপায়ে রুজি করার। হালাল রুজির মূল উদ্দেশ্যই হলো সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার করো, যেগুলো আমি তোমাদের রুজি হিসেবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগি করো।’’ [সুরা বাকারা : ১৭২ বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের লক্ষ্যে ওয়াহি নির্ভর যে দর্শন পেশ করেন, তা হলো মানব জীবনে অর্থ-সম্পদ অপরিহার্য। জীবন ও জীবিকার তাগিদে অর্থ-সম্পদ অর্জন করতে হয়, কাজে লাগাতে হয়, কিন্তু তা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। অর্থ ও ধনসম্পদসহ দুনিয়ার সব কিছুই মানুষের সেবক ও খাদেম। “পৃথিবীর বস্তু নিশ্চয় মানুষের জন্য সৃষ্টি।” [সূরা বাকারা : ২৯]
মানুষ ও মানুষের সব কর্মকান্ড কেবল আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিবেদিত। সুতরাং অর্থ-সম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয় করতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত পথে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে আহার করে, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত নয়।’
হালাল উপার্জন মানেই সুষ্ঠুভাবে বণ্টন। হালাল উপার্জন ছাড়া কখনো সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই তো আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করবে, আমরা আল্লাহর রাস্তায় কি পরিমাণ ব্যয় করব, আপনি বলে দিন যা উদ্বৃত্ত।” [সূরা বাকারা : ২১৯]
আর আল্লাহর রাস্তা তো ঐ রাস্তা, যেখানে মানবতার কল্যাণ সাধিত হয়, যেখানে এতিম, মিসকিন, গরিব ও দুঃখীদের তাদের হক দেওয়া হয়। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ কুরআনে সুরা মাউন নাযিল করেছেন, যেখানে আল্লাহ এতিম, মিসকিন ও গরিবের হক আদায় করতে ব্যর্থ মুসল্লিকে ওয়াইল নামের দোজখে নিক্ষেপ করার কথা বলছেন।
সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনগণকে নীতি ও বিধিসম্মতভাবে অর্থ-সম্পদ অর্জন করার এবং জাকাত ও সাদকার মাধ্যমে সে অর্জিত সম্পদের কিয়দংশ দুঃখি ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের নির্দেশ দেন। অধিকন্তু রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদে জনগণের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছয় প্রকার রাজস্ব প্রবর্তন করেন। এগুলো হলো- ০১. আল-গণিমাহ বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি, ০২. জাকাত বা ধনীদের দেয়া দরিদ্র কর, ০৩. খারাজ বা অমুসলিম কৃষকদের ভ‚মি কর, ০৪. জিজিয়া বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা কর, ০৫. আল-ফে বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, ০৬. সাদকা বা স্বেচ্ছাধীন দান।
এসব খাতে সংগৃহীত রাজস্ব নির্ধারিত হারে জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হতো। এ ব্যবস্থা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদীনা জীবনে এবং পরবর্তীতে খুলাফায়ে রাশিদুনের শাসনামলে জনগণের সামাজিক জীবনে আশানুরূপ সুফল বয়ে আনে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশ কৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, আরবের উপর অনারবের, অনারবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ একে অপরের ভাই। সব মানুষ আদমের বংশধর আর আদম মাটি হতে তৈরি। [আহমদ ইবনে হাম্বল, মুসনাদ, ৫ খ., পৃ. ৪১১; জাহিজ, আল বয়ান ওয়াত তিবঈন, ২ খ., পৃ. ৩৩] ‘‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যার মধ্যে খোদাভীতি প্রবল।’’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ ঘোষণা ছিল তৎকালীন সমাজের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ও দ্রোহ। কারণ বংশ কৌলিন্য ও রক্তের মর্যাদা ছিল সামাজিক আভিজাত্যের ভিত্তি। তিনি ঈমানদারদের সুভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুদৃঢ় করে এক অখন্ড দেহ সত্তায় পরিণত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সকল মু’মিন এক মানব দেহের মতো, যদি তার চোখ অসুস্থ হয়; তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর যদি তাঁর মাথা ব্যথা হয়; তখন তার সমস্ত দেহই ব্যথিত হয়।” [মিশকাত আল মাসাবিহ, ৯ খ., পৃ. ১২৮]
পক্ষপাতিত্ব, প্রভাবিত, আবেগতাড়িত হয়ে কোন বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন এমন একটি ছোট্ট ঘটনাও তার বিচারপতি জীবনের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। তিনি ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করতে গিয়ে কোনদিন নিজের আহাল, আত্মীয়-পরিজন ও জলিল-কদর কোন সাহাবীর পক্ষও অবলম্বন করেননি। এ জন্য তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠতর মহামানবের সাথে সাথে একজন শ্রেষ্ঠ প্রধান বিচারপতিও বটে। তাঁর এ ন্যায়বিচারের কারণেই হাজরা মাউত থেকে সান’আ পর্যন্ত সুন্দরী তনয়া, মূল্যবান অলঙ্কার পরিহিতা, একাকিনী দিনে রাতে পথ চলছে কেউ তাকে জিজ্ঞেস করবে তো দূরের কথা তার দিকে চোখ তুলে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করতো না।
এই পৃথিবীতে সব মানুষই যে আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান, কৃষ্ণ-শ্বেত, ধনী-নির্ধন সকলই যে আল্লাহর সৃষ্ট মানুষ, সব মানুষই যে পরস্পর ভাই ভাই, ধর্মীয় ও কর্মীয় অধিকার যে সব মানুষেরই সমান- এ কথা বলিষ্ট কণ্ঠে ঘোষণা করেন এবং স্বীয় কর্মে ও আচরণে প্রমাণ করেন ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন মানুষের মুক্তি-বাণী। সারা জীবনের সাধনায় তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন এমন এক সমাজ, যে সমাজে মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়, ব্যক্তি ও জাতি-গোত্র পায় পূর্ণ স্বাধীনতার আস্বাদন। মানুষ সমাজের বুকে মানুষ রূপে শির উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ লাভ করে।
সমাজ জীবনে মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই পারস্পরিক সহানুভ‚তি, ভ্রাতৃত্ব, সমঝোতা প্রভৃতি সদাচরণ সমাজে অন্যায় ও জুুলুমের অবসান ঘটায় এবং ক্রমান্বয়ে মানবসভ্যতাকে গতিশীল করে তোলে। তাই দেখা যায়, মানুষ যখন পারস্পরিক সমঝোতা ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে অখন্ড ভ্রাতৃসমাজ গঠন করেছে তখন তারা অগ্রগতি ও শান্তির উচ্চমার্গে পৌঁছে গেছে। আর যখনই বিভেদ মাথাচাড়া দিয়া উঠেছে, তখন পতন হয়েছে অনিবার্য পরিণতি। ইতিহাসের ঘটনা পরস্পরা এইরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্তে ভরা। সমাজের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক দয়া, সৌহার্দ ও সৌজন্য সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। সহমর্মিতাসুলভ গুণাবলি মানুষকে একে অপরের নিকটে নিয়ে আসে। হিংসা-বিদ্বেষ বিভেদের বীজ বপিত করে। যার ফলশ্রুতিতে সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যার ভিত্তি ছিল পারস্পরিক সম্মানবোধ, ন্যায় বিচার ও মানবিকতাবোধ। [আল হায়সামি, কাশফুল আসতার, ২ খ., পৃ. ৩৫] আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার এক প্রতিবেশী আমাকে পীড়া দেয়। তিনি বললেন, যাও, তোমার গৃহ-সামগ্রী গিয়ে রাস্তায় বের করে ফেল। সে ব্যক্তি তখন ঘরে গিয়ে তার গৃহ-সামগ্রী রাস্তায় বের করে ফেলল। ফলে লোকজন জড় হয়ে গেল। তারা জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হলো? সে ব্যক্তি বলল, আমার একজন প্রতিবেশী আমাকে পীড়া দেয়। আমি তা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ব্যক্ত করি। তিনি বললেন, যাও, ঘরে গিয়ে তোমার গৃহ-সামগ্রী রাস্তায় বের কর। তখন তারা সেই প্রতিবেশীটিকে ধিক্ দিতে দিতে বলতে লাগলো-“আল্লাহ! উহার উপর তোমার অভিসম্পাত হোক। আল্লাহ, উহাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত কর! এই কথাটি সেই প্রতিবেশীটির কানেও গেল এবং সে সেখানে এসে উপস্থিত হল। সে তখন বলল- “তুমি তোমার ঘরে ফিরে যাও। আল্লাহর কসম! আর কখনো আমি তোমাকে পীড়া দিব না।” [আল-আদাবুল মুফরাদ : হাদীস নং : ১২৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শতাব্দীর এমন এক ক্রান্তি কালে নতুন সমাজ গড়ার প্রয়াসী হন যখন গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে বর্ণপ্রথা, বর্ণবৈষম্য, বংশ কৌলিন্য ও আভিজাত্যের দম্ভ মানুষকে গৃহপালিত জন্তু অথবা বিশেষ বৃক্ষের চেয়ে হীন পর্যায়ে নিয়ে আসে। জন্তু বিশেষ ও বৃক্ষবিশেষকে পবিত্র জ্ঞানে অর্চনা করা হতো তখন। সাধারণ মানুষের তুলনায় এসব জন্তু-বস্তুর মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মনন ও মানসিকতায় এ কথা চিত্রায়িত করতে সক্ষম হন যে, সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান, সম্মানের যোগ্য ও ভালোবাসার পাত্র হলো মানুষ। [সায়্যিদ আবুল হাসান ‘আলী নদভী, নবীয়ে রহমত, ২ খ., পৃ. ২২০]
(চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Mohiuddin ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩৫ পিএম says : 0
Thanks
Total Reply(0)
Mohiuddin ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:৩৫ পিএম says : 0
Thanks
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন