ভূমি মানুষ ও রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বাসস্থান, কৃষিজমি, বনভূমি, নদ-নদীর বৈচিত্র্য নিয়েই আমাদের ভূ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ আবর্তিত। ক্রমবর্ধমান জনসখ্যার প্রেক্ষাপটে খাদ্য চাহিদা পূরণে কৃষিজমি বাড়ানোর সুযোগ না থাকা সত্তে¡ও উন্নত ও আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে গত চার দশকে দেশে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুনের বেশি বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এখন অতিকর্ষণের কারণে কৃষিজমির উৎপাদন সক্ষমতাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিজমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, হার্বিসাইড ও হাইব্রীড কৃষিবীজ ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিয়েছে। দেশের সব নদ-নদীর পানি এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। শিল্পকারখানার অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে কৃষিজমির মাটি এবং বায়ুমন্ডলে ভয়াবহ দূষণ দেখা দিয়েছে। এসব কারণে প্রতিবছর কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। একদিকে নদীভাঙ্গনের মত প্রাকৃতিক দুযোর্গ, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান আবাসন, নগরায়ণ, শিল্পায়ণ নতুন নতুন রাস্তাসহ অবকাঠামো নির্মানের ফলে বছরে অর্ধলক্ষাধিক হেক্টর কৃষিজমি স্থায়ীভাবে অকৃষিখাতে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বছরে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর কৃষিজমি আবাসন ও শিল্পায়নসহ অকৃষিখাতের দখলে চলে যাচ্ছে।
দেশের কৃষিজমি হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী কথা বলেছেন। গত মঙ্গলবার অর্থনৈতিকি পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি বলেছেন, আমাদের কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। কৃষি জমি রক্ষার তাকিদ দিয়ে তিনি বলেছেন, কৃষি জমিতে বসতবাড়ি ও শিল্পকারখানা স্থাপন করা যাবে না। তিনি নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, শিল্প এলাকায় কলকারখানা স্থাপন করতে হবে। আমরা ইকোনোমিক জোন করে দিচ্ছি। এসব স্থানে শিল্পকারখানা নির্মাণের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। যারা শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে চান, তারা এসব শিল্প এলাকায় যান। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, বাড়ির পাশের ধানের জমি নষ্ট করে শিল্প স্থাপন করবেন কেন? দেশের কৃষিজমি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ প্রনিধানযোগ্য। শুধু কৃষিজমি রক্ষাই নয়, প্রধানমন্ত্রী ইতোপূর্বে দেশের কোনো জমি যাতে অনাবাদি না থাকে এবং প্রতি ইঞ্চি জায়গায় কৃষিকাজ করা হয়, তার জন্য তাকিদ দিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অস্বাভাবিক হারে কৃষিজমি কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। যে জমি রয়েছে তার মাধ্যমেই কৃষক কঠোর পরিশ্রম করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছেন। এ প্রেক্ষিতে যদি বছরের পর বছর ধরে কৃষিজমি কমতে থাকে, তাহলে খাদ্যের এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। করোনার এই সময়ে যেখানে অধিক পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন জরুরি, সেখানে কৃষিজমি বৃদ্ধির বিকল্প নেই। একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অন্যদিকে কৃষিজমি কমে যাওয়া কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা অপরিহার্য। তবে তা কৃষিজমির ক্ষতি করে গড়ে তোলা বাঞ্চনীয় নয়। শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য ইতোমধ্যে সরকার একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি চালু হয়েছে। বাকিগুলো কয়েক বছরের মধ্যে চালু হবে। এ প্রেক্ষাপটে, শিল্পদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করাই সমীচিন। পাশাপাশি সরকারের উচিৎ শিল্পকারখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিল্পাঞ্চলগুলোতে প্লট বরাদ্দ ও ব্যাংক ঋণের সুবন্দোবস্ত করা। শিল্পদ্যোক্তারা যাতে শিল্পাঞ্চলগুলোতে গিয়ে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পান, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যা বিবেচনায় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষিজমি, বাস্তুব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ বিষয়টি বার বার তুলে ধরছেন। কৃষিজমি রক্ষায় তার নির্দেশনা বাস্তবানুগ এবং তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি ডিজিটাল ভূমি জোনিংয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য বাংলায় সব তথ্য লিপিবদ্ধকরণ ও সরক্ষণের উপর তাকিদ দিয়েছেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাপনা, শিল্পায়ন এবং নদীব্যবস্থাপনার একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা দরকার। নদীভাঙ্গনে প্রতিবছর হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি বিলীন হয়ে যাওয়া রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবী। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় কৃষিব্যবস্থায় ফসল উৎপাদনের বহুমাত্রিক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ধান, পাট, আলু ও রবিশস্যের পাশাপাশি অনেক অপ্রচলিত বিদেশি ফল ও সবজি উৎপাদন করে কৃষকরা কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। ধানের জমিতে উন্নতমানের অর্গানিক চা উৎপাদন করে সেই চা বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। আমাদের কৃষির বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং আগামী দিনের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষিজমির সর্বোচ্চ সংরক্ষণ এবং সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন