২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। অন্যান্য খাতের মতো যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের উন্নয়নেও কাজ হচ্ছে। সন্দেহ নেই, দেশ উন্নত হলে বৈদেশিক বাণিজ্য বা আমদানি-রফতানি এখনকার চেয়ে বাড়বে, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও পণ্যচলাচল বাড়বে। একই সঙ্গে জনচলাচল বৃদ্ধি পাবে। সে জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। যেসব দেশ উন্নত কিংবা উন্নত হতে চলেছে। তারা উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলাকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছে। দেখা গেছে, তারা সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগকে সমান গুরুত্ব দিয়ে উন্নত করেছে। এই ত্রিমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া কোনো দেশের পক্ষে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশে অতীতে সমানতালে ত্রিমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টিকে যথোচিত গুরুত্ব দেয়া হয়নি। একদা নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল এক নম্বরে। এখন তার অবনমন হয়েছে। স্বাধীনতার পর রেলের উন্নয়নে তেমন গুরুত্বই দেয়া হয়নি। ফলে রেললাইনের পরিধি কমেছে, গুরুত্ব কমেছে এবং সেবাও কমেছে। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বিকাশ ও সম্প্রসারণ ঘটেছে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার। দেশ জুড়ে অসংখ্য সড়ক-মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। তবে অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়কের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি সড়ক-মহাসড়ক নিত্য দুর্ভোগের কারণে পরিণত হয়েছে। নৌ ও রেলের উন্নয়নের পাশাপাশি উন্নত ও টেকসই সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
উন্নত ও টেকসই সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা বিনির্মাণে পরিকল্পনাগত ত্রুটি আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অতীতে আমাদের সড়ক-মহাসড়ক ছিল প্রধানত দুই লেনের। প্রয়োজনের বিশেষ তাকিদে কিছু সড়ক-মহাসড়ক ও তাদের অংশবিশেষ চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। অথচ দেশ যখন উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছাবে তখন চার লেন কমই কাজে আসবে। প্রয়োজন হবে অস্তত আট লেনের। তাই যদি হয় তবে এখনই চার লেনের জায়গায় আট লেনের বিষয়টি মাথায় রেখে অগ্রসর হওয়া নয় কেন? পরিকল্পনায় অন্তত রাখা যেতে পারে। চাইলেই সব সড়ক-মহাসড়ক বহু লেনে উন্নীত করা সম্ভব নয়। এজন্য সময় ও অর্থ দুই-ই প্রয়োজন। পরিকল্পনায় থাকলে ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে। এদিকে সরকারি সড়ক-পরিকল্পকদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। কীভাবে উন্নত ও টেকসই সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ নিশ্চিত করা যায় সেটাও সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। আমাদের সড়ক-মহাসড়কগুলো সাধারণভাবে নিম্নমানের, ভঙ্গুর এবং স্বল্পায়ূ। এর কারণ নিম্নমাণের সামগ্রী ব্যবহার। কী নিমার্ণে, কী সংস্কারে-কোথাও উন্নত মানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয় না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার অল্প দিনের মধ্যেই এর বিভিন্ন অংশে ভেঙ্গেচুরে খান্দ-খন্দের সৃষ্টি হয়। যান চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরে সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। এটা একটা নজির এবং এ ধরনের নজির প্রায় সারাদেশেই দৃশ্যমান। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেশের বিভিন্ন এলাকার সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থার খন্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, নিম্নমানসম্পন্ন বা ভেজাল নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার এবং নিকৃষ্টতম বিটুমিনে ঢালাইয়ের ফলে সড়ক-মহাসড়কের এই ভগ্নদশা হয়েছে।
বিশ্বের মধ্যে সড়ক নির্মাণব্যয় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। অথচ এখানে সড়কের স্থায়ীত্বকাল তুলনামূলকভাবে কম। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিযোগিতাসক্ষমতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সড়ক বাংলাদেশের। বিশ্বব্যাংকের যোগাযোগ অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৭ দেশের মধ্যে ১০৯তম। তাহলে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে এত ব্যয় কেন এবং ব্যয়িত অর্থ যাচ্ছে কোথায়? কারোই অজানা নেই, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা যোগাসাজস করে নির্ধারিত নির্মাণব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থ লুটপাট করছে। এটা কেবল মাত্র অনুমানের বিষয় নয়। বাস্তব প্রমাণও আছে অনেক। ঠিকাদারদের ব্যাপারে কথা আছে। সরকারি দলের লোকেরাই সাধারণত, ঠিকাদারি পেয়ে থাকে, তা তাদের অভিজ্ঞতা থাক বা না থাক। না থাকলে ঠিকাদারি হস্তান্তর হয়ে যায়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। কাজ ঠিকমত হয় না। কম দামের নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহৃত হয়। তত্ত্বাবধান বা তদারকির ব্যবস্থাও নেই। ফলে হচ্ছে যাচ্ছে তাই, চলছে হরিলুটের উৎসব। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কাজের মান নিয়ে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী দায় এড়াতে পারবে না। শুধু একথা বললেই হবে না, তাদের দায়বদ্ধ করতে হবে, জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক’দিন আগে টেকসই সড়ক নির্মাণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গ্রামীণসড়কও এমনভাবে টেকসই করতে বলেছেন, যাতে বড় বড় মালামালবাহী যানবাহন ওইসব সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টরা কি আদৌ সক্রিয় ও তৎপর হবে?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন