সাত বছর ধরে সদস্যদের সঞ্চয় ও আমানত সংগ্রহের পর অফিসে তালা ঝুলিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা নিয়ে উধাও হওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ‘গ্রামীণ সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা মিললেও অফিস তালাবদ্ধ থাকায় সমিতির সদস্য সংখ্যা এবং তাদের গচ্ছিত সঞ্চয় ও আমানতের সঠিক পরিমাণ বলতে পারেননি পাঁচবিবি উপজেলা সমবায় সমিতি। তবে সদস্যদের আমানত ফেরত প্রদানে সহায়তার জন্য সমিতির অফিস কক্ষের তালা ভেঙ্গে রেকর্ডপত্র উদ্ধারে প্রশাসনিক সহযোগীতার জন্য জেলা সমবায় অফিসের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
পাঁচবিবি উপজেলা সমবায় অফিস ও সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিজেদের মধ্যে ৬ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে ‘গ্রামীণ সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নাম দিয়ে ২০১৩ সাল থেকে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রলাল রবিদাস। সমিতির সভাপতি চন্দ্রলালের স্ত্রীর বড়ভাই হরেন চন্দ্র। অন্যান্য সদস্যও একে অপরের আত্মীয়। এজন্য তারা উপজেলা সমবায় অফিস থেকে নিবন্ধনও করেন। যার নিবন্ধন নম্বর ৫৪৯/১৩। সাইনবোর্ড টানিয়ে পাঁচবিবি পৌর সদরের প্রধান সড়কের তিনমাথায় একটি পাকা ভবনের দোতলায় অফিসও করা হয় সমিতির। উচ্চ সুদে মুনাফা দেওয়ার কথা বলে বিগত সাত বছর ধরে তারা পাঁচবিবি উপজেলার আট শতাধিক সদস্যদের প্রায় দুই কোটি টাকার সঞ্চয় আদায় করেন। একই সাথে প্রতিমাসে লাখে দেড় হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে শতাধিক সদস্যদের কাছ থেকে কোটি টাকার স্থায়ী আমানতও সংগ্রহ করেন। সমিতির কার্যক্রম শুরুর পর মানুষের কাছে বিশ^স্ততা অর্জনে বিগত কয়েক বছর মুনাফার টাকা তারা সদস্যদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছেও দেয়। কিন্তু দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর থেকে সমিতির কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। মাঠকর্মীদের বেতনও বন্ধ করা হয়। এ অবস্থায় গত ১৫ নভেম্বর থেকে সমিতির অফিস কক্ষে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রলাল রবিদাস। এ পরিস্থিতিতে সমিতির সদস্যগণ তাদের গচ্ছিত আমানত ও সঞ্চয়ের টাকা লোপাটের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। প্রতিদিন তারা খোঁজ নিতে আসছেন অফিসে।
সমিতির মাঠকর্মী জাহাঙ্গীর আলম বলেন,সমিতির সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রলাল রবিদাসকে দুই লাখ টাকা জামানত দিয়ে সাত হাজার টাকা মাসিক চুক্তিতে তিনি সমিতিতে মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। মাঠ থেকে তিনি সদস্যদের সঞ্চয় সংগ্রহ করে অফিসে জমা দিতেন। গত ২ মাস থেকে তিনি বেতন পাননি। ১৫ নভেম্বর থেকে অফিস বন্ধ রয়েছে।
পাঁচবিবির দানেজপুর গ্রামের নেপাল চন্দ্র বলেন,তার স্ত্রী শেফালী রাণীর নামে ৬ লাখ টাকা তিনি গত বছরের ৫ ফেব্রæয়ারী সমিতিতে জমা দেন। তার স্ত্রীর ডিএসএ (ফিক্সড ডিপোজিট) নং ৮৮১। বিনিময়ে সমিতি তাকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিমাসে ৯ হাজার টাকা মুনাফা দেয়। এরপর থেকে কোন টাকা তিনি পাননি। কাশপুর গ্রামের নাজিউল হক বলেন,বাবার পেনশনের ৬ লাখ এবং নিজের সঞ্চয়ের ৭৯ হাজার টাকা তিনি ওই সমিতিতে জমা দিয়েছেন। উত্তর দানেজপুর গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসন্তী কেরকেটা বলেন,দুই শতক জমি বিক্রি ও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তিনি ৪ লাখ টাকা আমানত রাখেন সমিতিতে। লাভের টাকা না নিয়ে তিনি নিজে সহ স্বামী ও ছেলে-মেয়ের নামে আলাদা চারটি সঞ্চয়ও করেন। কিন্তু এখন সবকিছুই তার শেষ হয়ে গেল। পশ্চিম বালিঘাটা গ্রামের রোজি আক্তার বলেন, তিন মাস আগে এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা তিনি ওই সমিতিতে রেখে ১হাজার ৪০০ টাকা পেয়েছেন। পরে টাকা ফেরত নিতে গেলে সমিতির সম্পাদক চন্দ্রলাল তাকে যমুনা ব্যাংক পাঁচবিবি শাখার একটি চেক দেয়। কিন্তু টাকা না থাকায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে চেক ফেরত দেয়। শুধু রোজি বা বাসন্তী নয় সঞ্চয় ও আমানতের প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাত করে পালিয়ে যাওয়ার এমন অভিযোগ ওই সমিতির কয়েক’শ সদস্যের।
পাঁচবিবি উপজেলা সমবায় কর্মকতা লুতফুল কবীর সিদ্দিকী বলেন,‘সমিতির একজন মাঠকর্মীর মাধ্যমে অভিযোগ পেয়ে ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত করা হয়েছে। অফিস বন্ধ থাকায় সমিতির গ্রাহক সংখ্যা এবং সঞ্চয় ও আমানতের টাকার পরিমাণ নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এ বিষয়ে বড় ধরণের তদন্তের মাধ্যমে সমিতির ধার-দেনা ও গ্রাহকের ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পাঁচবিবি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরমান হোসেন প্রতারিত সদস্যদের মামলা করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন