শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

নামাজ কবুল না হওয়ার কারণ

মাও মোহাঃ আসাদুজ্জামান আসাদ | প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

মৌলিক ইবাদতের মধ্যে সালাত অন্যতম একটি ইবাদত। সুনিদিষ্ট কার্যবলী ও আরকানের নাম সালাত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র মিরাজের রাতে উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর সালাত ফরজ করেন।সালাত শব্দের শাব্দিক অর্থ দয়া,আনুগ্রহ,ক্ষমা প্রার্থনা করা,তাসবিহ পাঠ করা,সোজা করা ইত্যাদি। সালাতের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে,‘কিছু নিদিষ্ট কাজ ও আরকানের সমষ্ঠির নাম সালাত। সালাতের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে-‘হে রাসুল!আপনি বলে দিন, আমার বান্দাদেরকে,যারা ইমান এনেছে তারা যেন সালাত প্রতিষ্টা করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশে ব্যয় করে’।

আমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের স্বভাব বৈশিষ্ট অনুযায়ী সালাত একমাত্র উপযোগী এবাদত। আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত বান্দার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার,বিশ্বাসের দলীল এবং সর্বোত্তম ইবাদত। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সু-নিবিড় সর্ম্পক গড়ে তোলার জন্য নামাজ অন্যতম সেতু বন্ধন। যে ব্যক্তি সালাত পরিহার করল সে কবীরাহ গুনাহ করল এবং যে ব্যক্তি অস্বীকার করল সে কাফির। বিশ^ নবী (দ) বলেন,‘মুমিন ও কাফিরের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হল সালাত। মুমিন গণ সালাত আদায় করে কাফিরগণ সালাত আদায় করে না’। তিনি আরো বলেন,‘সালাত হলো দ্বীনের খুটি! সুতুরাং যিনি সালাত কায়িম করলেন তিনি যেন দ্বীনকেই কায়িম রাখলেন। যে নামাজ পরিত্যাগ করল সে যেন দ্বীনকেই পরিত্যাগ করল’।সালাতের মাধ্যমে ব্যাক্তি,সমাজ ও রাষ্ট জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করা সম্ভব। মহান স্রষ্টা আল্লাহর দরবারে নিজেকে বিলীন করে দেয়া সম্ভব তখনই, যখন মানুষের সহজাত দুর্বলতা,অক্ষমতা,ক্ষুদ্রতা,সহায় সম্বলহীনতা রবের জন্য প্রকাশ করা সম্ভব হয়। তাই মানব আত্মার শাশ্বত দাবি মিটানোর জন্য আল্লাহর রহমত হিসাবে সালাতের বিধান আদায় করা ফরজ করেন। এরশাদ হচ্ছে,‘জেনে রাখ,কেবল আল্লাহর স্বরনেই আত্মা শান্তি লাভ করে’।

মহান আল্লাহ তাআলা বিশ^ নেতা হযরত রাসুল (দ) কে সালাত আদায়ের জন্য বিশেষ ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।মহা গ্রন্থ আল কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, “আমার বান্দাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে তাদেরকে নামাজ কায়েম করতে বলুন’।অন্যত্র বলেছেন,‘হে যারা ইমান এনেছ,তোমরা রুকু কর,সিজদা কর এবং তোমাদের রবের ইবাদত কর ও সৎ কাজ কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’।সালাত এমন একটি শরয়ী ইবাদত, যার সফল ভাবে পালন করবে তার জন্য কোন প্রকার ভাবনা থাকবে না। আল্লাহ সফলতার উপকরন হিসাবে বান্দার উপর সালাত কায়েম করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষনা করেন,‘ইমানদারগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছে যারা নিজেদের নামাজে বিনয় নম্র’। মহান আল্লাহ আরো বলেন ‘সফলকাম ব্যক্তি সেই যে পবিত্রতা অর্জন করেছে। আপন প্রতিপালকের নাম স্বরন করেছে এবং নামাজ আদায় করেছে’। আল্লাহ বলেন,‘আর আপনার পরিবারবর্গকে নামাজের আদেশ দিন এবং আপনি নিজেও এতে অবিচল থাকুন’।দুনিয়ার জীবন শেষ হলেই পরকালিন জীবন শুরু।মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন বান্দার কাছ থেকে সর্ব প্রথম সালাতের হিসাব গ্রহন করবেন।‘হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন,নবী (দ) বলেছেন,কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম মুসলমান বান্দার যে আমলটির হিসাব নেয়া হবে সেটি হচ্ছে ফরজ সালাত। অতএব কোন ব্যক্তি যদি তা যথাযথ ভাবে আদায় করে তাহলে তো ভালো কথা। অন্যথায় ফেরেস্তাদেরকে বলা হবে,দেখতো তার কোন নফল সালাত আছে কি না ? যদি তার আমল নামায় নফল সালাত থাকে তাহলে এ নফল নামাজ তার ফরজের ঘাটতি পুরন করবে। সব ফরজ ইবাদতের বেলায় এইরুপ হিসাব করা হবে’। মহান আল্লাহ তাআলা যাদের নামাজ কবুল করবেন,তাদের জন্য মহা পুরুস্কারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সেখানে শুধু,সুখ আর শান্তি।হযরত উসমান গনি (রা) বলেন,যে ব্যক্তি সময়ের প্রতি খেয়াল রেখে গুরুত্ব সহকারে নামাজ আদায় করেন আল্লাহ পাক তাকে নয়টি জিনিস দিয়ে সম্মানিত করবেন।যথাঃ ১.আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন।২.তাকে সুন্দর স্বাস্থ্য দান করেন।৩.ফেরেস্তা তাকে হেফাজত করেন।৪.তার ঘরে বরকত দান করেন।৫. তার চেহারায় নুর ফুটে উঠে ৬. তার অন্তর নরম হয়ে যায়। ৭. সে পুলসিরাতের উপর বিজলীর মত পার হয়ে যাবে। ৮. আল্লাহ পাক তাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দান করবেন। ৯. সে জান্নাতে নবী,রাসুল ও নেক বান্দাদের প্রতিবেশী হবেন।

আমরা মুসলমান মোমিন বান্দারা সালাত আদায় করি। কিন্তু সব সালাত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। যাদের নামাজ কবুল হয় না সে সর্ম্পকে বিশ^ নবী (দ) এর অনেক হাদীস রয়েছে। হযরত আবু উমামা বাহেলী (রা) বলেন,হযরত রাসুল (দ) বলেছেন,তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের কানের সীমা অতিক্রম করে না। ১.পলাতক দাস, যে ফিরে না আসে। ২. যে নারী রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী তার উপর অসন্তুষ্ট এবং ৩. যে ব্যাক্তি লোকদের ইমাম হয়েছে অথচ লোকেরা তাকে পছন্দ করে না’।(তিরমিযি)। হযয়ত উমর (রা) বলেন,হযরত রাসুল (দ) বলেছেন,তিন ব্যক্তির নামাজ কবুল হয় না। ১.যে ব্যক্তি লোকদের ইমাম হয়েছে অথচ তারা তাকে পছন্দ করে না। ২. যে নামাজ পড়তে আসে নামাজের উত্তম সময় চলে যাবার পর এবং ৩.যে কোন স্বাধীন নারী বা পুরুষকে দাস-দাসীতে পরিনত করে।(ইবনে মাজা) ।হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন,হযরত রাসুল (দ) বলেছেন,তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপর অর্ধ হাতও উঠানো হয় না। ১.যে ব্যক্তি লোকদের ইমামতি করে অথচ তারা তার উপর অসন্তুষ্ট। ২.যে স্ত্রী লোক ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি যাপন করে অথচ তার স্বামী তার উপর অসন্তুষ্ট এবং ৩. সে দুই ভাই যারা পরস্পরে বিছিন্ন। (ইবনে মাযা)।এমনি ভাবে বে-নামাজী ব্যক্তির মৃত্যুর সময় তিন প্রকার শাস্তি ভোগ করবে।যথা ঃ ১.অপদস্ত হয়ে মত্যু বরন করবে।২.ক্ষুর্ধাত অবস্থায় মারা যাবে।৩.পিপাসার যন্ত্রনায় মারা যাবে। এখানেই শেষ নয়, বে-নামাজীর কবরে তিন প্রকার শাস্তি প্রদান করা হবে।যথা ঃ ১.কবর সংর্কীর্ণ হবে এক দিকের পাজরের হাড় অন্য দিকে ঢুকে যাবে। ২.তার কবরে আগুন জে¦লে দেয়া হবে।৩.কবরে তার উপর এমন ভয়ংকর আকৃতির একটি সাপ নিযুক্ত করা হবে যার চোখ গুলো আগুনের, নখগুলো লোহার। উহার দৈর্ঘ্য তিন দিনের পথের সমান,আওয়াজ বজ্র্যের মত। সে বলবে আমর রব, তোমাকে কোন কঠিন শাস্তি দেয়ার জন্যেই আমাকে নিযুক্ত করেছেন। ফজরের নামাজ বরবাদের জন্য জোহর পর্যন্ত,জোহরের নামাজের জন্য সুর্যাস্ত পযন্ত,মাগরিবের নামাজ বরবাদ করার জন্য এশা পর্যন্ত। এশার নামাজ বরবাদ করার জন্য ভোর পর্যন্ত তোমাকে দংশন করতে থাকব। যখন সে তাকে একবার দংশন করবে তখন মৃত ব্যক্তি সত্তর হাত মাটির নীচে চলে যাবে। এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে শাস্তি দেয়া হবে। আবার কবর থেকে উঠার পর তিন প্রকার শাস্তি ভোগ করবে হবে। যথাঃ ১.তার হিসাবে কঠিন ভাবে নেয়া হবে।২.তার উপর আল্লাহর ক্রোধ থাকবে।৩.তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। মুমিন বান্দার জন্য সালাত হলো নিরাপদ আশ্রয়। সুখ-শান্তির মহা সাগর। সব প্রতিকুলতার মুখে সর্বাপেক্ষা কার্যকর হাতিয়ার। দুঃখ-কষ্টে,আপদে-বিপদে,আঘাতে বেদনায় প্রশান্তির বারি ধারা,সুখ-শান্তি,কল্যাণ-সফলতার নিশ্চিত যামানত। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,‘হে ইমানদাররা যারা ইমান এনেছ,সবর ও নামাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চিত আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’। প্রত্যেক মুমিন মুসলমান দৈনিক পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। আমরা কি নামাজের নিয়ম-কানুন,বিধি-বিধান সঠিক ভাবে পালন করি? আসলে, আমরা নামাজ যথাযথ ভাবে আদায় করতে পারি না। নানা কারনে নামাজ নষ্ট হয়।নামাজ নষ্ট হওয়ার কারন হলো-নামাজের মধ্যে কথা বলা,সালাম দেয়া ও উত্তর দেয়া,হাচির জবাব দেয়া,নামাজের বাইরে দোয়া হলে আমীন বলা,দুঃসংবাদ শুনে ইন্নালিল্লাহ বলা,সুসংবাদ শুনে আল হামদুলিল্লাহ বলা,নামাজ রত অবস্থায় সুবহানাল্লাহ বলা,নামাজে দেখে কোরআন পাঠ করা,আমলে কাছীর করা,ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কোন বস্ত খাওয়া ও পান করা,লাহনে জলি পড়া,কিবলা মুখী না হওয়া,পুর্ণ সিজদায় উভয় পা মাটিতে না রাখা,স্ত্রী নামাজে থাকা অবস্থায় স্বামী তাকে চুম্বন করা,ইমামের আগে দাড়ানো,ইমামের পুর্ণ আনুগত্য না করা,নামাজের মধ্যে অট্রহাসি হাসা,তায়াম্মুম কারী পানি ব্যবহারে সক্ষম হওয়া ইত্যাদি। তাকবীর তাহরিমা,সুরা- কিরাত,রুকু সিজদা,তাশাহুদ বিশ^ নবী (দ) এর নির্দেশ মত আদায় না করা। অতি দ্রুততার সহিত নামাজ শেষ করা
পরিশেষে বলতে চাই,নামাজের বিধি বিধান যথাযথ ভাবে সবাইকে পালন করা উচিৎ। যদি শরীয়ত নিধারিত নিয়ম কানুন যথাযথ ভাবে পালন করে সালাত আদায় করি অবশ্যই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। আর যদি বিধি বিধান যথাযথ ভাবে পালন না করি,তবে সেই সালাত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। মহান আল্লাহ তাআলা সফল নামাজী ব্যক্তিকে বিনিময়ে দিবেন প্রবাহমান জান্নাত। সালাতের প্রতি অবহেলা,অবজ্ঞা,আলসতামী পরিহার করি। আল্লাহ ও রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে সালাত আদায করি। এই তাওফিক আল্লাহ দান করুক। আমিন।
লেখকঃ গ্রন্থকার, প্রভাষক(আরবী)

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন