নির্ধারিত সময়ে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই শেষ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা। এক বা একাধিকবার মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে, বাড়ছে উন্নয়নের নামে ভোগান্তি। স¤প্রতি এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভবিষ্যতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে না বলে তিনি নির্দেশনাও দেন। দেশের চলমান প্রকল্পের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে কমপক্ষে ৮টি প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি, ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে, কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনকে ঘিরে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব নির্মাণ, বৃত্তাকার সড়ক ও রেলপথ প্রকল্প, হাইস্পীড ট্রেন, বিমান বন্দর গোলচত্ত¡রে আন্ডারপাস প্রকল্প ইত্যাদি।
এসব প্রকল্পের কোনোটা চলমান, কোনোটার ধীরগতি, আবার কোনোটা শুরু হচ্ছে হবে করে হয়নি। মোটকথা এক দশকে কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন হয়নি। তার মধ্যে ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমে আরও একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এ জন্য ‘ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এসব প্রকল্পের নামে উন্নয়নের চাপে ঢাকা ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। ভোগান্তিতে গতিহীন হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। উন্নয়ন দেখেই চলেছে একটার পর একটা জেনারেশন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে একেকটা সংস্থা একেকটা কাজ করে। তবে সমন্বয় দরকার। সেই সমন্বয়টা মাঝে মধ্যে ঘাটতি হচ্ছে। দেখা যায়, বিআরটিএ সাথে এমআরটির একটা সংঘর্ষ। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত মেয়রের বড় একটা ইউনিট থাকে। পরিকল্পনা যে করে সে উন্নয়ন করে না। আমাদের মেয়ররা শুধু মেইটেনেন্স করেন, ডেভলপমেন্ট করেন না, অপারেশনটাও করেন না। আমাদের এখানে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোন মডেল নেই। পরিকল্পনা ছাড়াই আগে কাজে নেমে যাওয়ার প্রবণতা বেশি বলে মনে করেন এই নগর বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, আগে হলো কাজে নেমে যেতে হবে, কনফ্লিক্ট হলে যেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী যত জাদরেল হবে সেই কাজটাই আগে হবে। বিআরটি ক্যাজুয়ালটি হলো না এমআরটি হলো, কোন বাদবিচার নেই। অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, মএকসাথে ৭-৮টা প্রতিষ্ঠান ডেভলোপমেন্ট করতেই পারে। কিন্তু সমন্বয়ের দায়িত্বটা বিশেষ করে আরবান এলাকায় মেয়রের হাতে থাকা উচিত। আর সিস্টেমের ডেভলপমেন্টের সমন্বয়টা করে পরিকল্পনা কমিশন। ওখানে রোড প্রজেক্টও যায়, রেল প্রজেক্টও যায়, নৌ প্রজেক্টেও যায়, বিমান প্রজেক্টও যায়!
জানা গেছে, ঢাকার প্রবেশমুখে যানজট কমাতে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য ২০১২ সালের ডিসেম্বরে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-বিমানবন্দর) অনুমোদন করে সরকার। তবে আট বছরে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৩৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। পরে তা বেড়ে হয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তবে ডিজাইন সংশোধনের কারণে এ ব্যয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আট বছর ধরে চলমান বিআরটি প্রকল্পের ধকলে টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে শুধুই ভোগান্তি। ধুলায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এই ১৩ কিলোমিটার এলাকার লাখ লাখ মানুষ কয়েক বছর ধরেই অতিষ্ঠ। এর প্রভাব এসে পড়েছে রাজধানীতেও। বিমান বন্দর সড়কে একই সাথে চলছে বিআরটি, মেট্রোরেল, ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। একই সাথে বিমানবন্দরে আন্ডারপাস নির্মাণের কাজও শুরু হচ্ছে। এ ছাড়া, বিমান বন্দর রেলস্টেশনকে ঘিরে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব নির্মাণ করা হবে।
এদিকে, উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ। এই অংশটি আবার কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। সে কারণে ভাঙা হবে কমলাপুর স্টেশন। কমলাপুরে মেট্রোরেলের স্টেশনসহ মাল্টিমোডাল হাব নির্মাণ করা হবে। মেট্রোরেল সূত্র জানায়, দুই ভাগে চলছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। এর মধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি হয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। আর আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের অগ্রগতি প্রায় ৫০ শতাংশ।
খুব ধীরগতিতে চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পের কারণে কয়েক বছর ধরে উত্তরা থেকে মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেইট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, মতিঝিল এলাকার রাস্তায় খোড়াখুড়ি লেগেই আছে। এ পথে ভয়াবহ যানজট বহু পুরনো ঘটনা। এতে অতিষ্ঠ মানুষ। ভুক্তভোগিদের প্রশ্ন এভাবে উন্নয়নের ধকল আরও কতোদিন?
এদিকে, প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েটি শুরু হয়েছে বিমানবন্দর গোলচত্বরের দক্ষিণ পাশ থেকে। এ প্রকল্পের কাজও ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা।
আবার বিমানবন্দর গোলচত্বরের উত্তর পাশ থেকে শুরু হবে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত করে দেয়া হবে। আর দুই এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগস্থল হবে বিমানবন্দর গোলচত্বর। ২০১০ সালে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু করে সেতু বিভাগ। চালু হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে।
নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২ সাল পর্যন্ত। রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকারের নেয়া মেগাপ্রকল্পগুলোর অন্যতম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। যানজট নিরসনতো দুরে থাক নির্মাণের ধীর গতির কারণে গত ১১ বছর ধরে এটি নগরবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয় হচ্ছে করে এখনও শুরু হয়নি। জি-টু-জি ভিত্তিতে বিশাল এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ও চীন সরকার। ১৬ হাজার ৯০১ কোটি ৩২ লাখ টাকার প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন হচ্ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে।
অন্যদিকে, ঢাকার উপর গাড়ির চাপ কমাতে ঢাকার চারিদিকে আউটার রিং রোড ও সার্কলার রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে আউটার রিং রোড বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ১৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ ৮ লেনের রিং রোড নির্মাণে আগ্রহী জাপান। পিপিপিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জাপানের সঙ্গে জি টু জি চুক্তি করেছে সরকার। সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৮ সালের মধ্যে এ সড়ক চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, রাজধানীর যানজট কমাতে সার্কুলার রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চায় সরকার। মেগা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ৬ বছর লাগবে এবং সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৮ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। সার্কুলার রেললাইন রাজধানীর চারপাশে রিং আকারে হওয়ার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জকে যুক্ত করে এর দৈর্ঘ্য হবে ৮০ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে।
এ ছাড়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে হাইস্পীড ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা করেছে রেলওয়ে। এ সংক্রান্ত প্রাথমিক সমীক্ষার কাজও শেষ। এভাবে একটার পর একটা প্রকল্প নেয়া হলেও ১১ বছর আগে নেয়া প্রকল্পও এখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি। এমনকি তা কবে বাস্তবায়ন করা যাবে তাও অনিশ্চিত। তারপরেও নতুন করে আরও একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। ‘ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট জাতীয় মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।
এর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা যানবাহন পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং চট্টগ্রাম-সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলে চলাচল করতে পারবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এটি নির্মাণ করবে। ইতোমধ্যেই সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) কাছে।
ভুক্তভোগীদের মতে, এমনিতেই চলমান প্রকল্পগুলো নানাভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছে নগরবাসিকে। ধূলা ও দূষণে ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের সেরা। ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে রাজধানী। তার উপর নিত্যনতুন প্রকল্প নেয়া কতোটা জরুরী তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, পুরো পৃথিবী পরিকল্পনা করে দশ বছরে আর বাস্তবায়ন করে দুই বছরে। আর আমাদের দেশে আমরা পরিকল্পনা করি দুই বছরে আর বাস্তবায়ন করতে দশ বছর লাগাই। কারণ, পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে। চোখটা অন্ধ, দূরে দেখতে পাই না। পড়তে গিয়ে তখন হোঁচট খেয়ে দেখি বিদ্যুতের লাইনতো সরাতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের সরকার কাজের চেয়ে প্রচার বেশি চায়। আমাদের উন্নয়নটা টোটালি ভিন্ন একটা মাত্রায়। ভিন্ন দর্শন রয়েছে, যেখানে পরিকল্পনায় নূন্যতম আধুনিকতা নাই, বিজ্ঞান নাই। তিনি বলেন, বিনিয়োগ কিন্তু প্রচুর হচ্ছে। বিনিয়োগে সর্বোচ্চ যদি রির্টান পেতে হয়-ধ্যান, জ্ঞান, সময়, শ্রম দিতে হবে পরিকল্পনায়। বাস্তবায়নটা একটা রোবটিক জিনিস। আমাদের এখানে কিছু একটা হলেই সেটা মিডিয়ায় বড় করে যায়, বাইরে এটা প্রচারই হয় না। সেখানে শুধু পরিকল্পনা কি হলো, সেটাই প্রচার হয়।
এই মুহুর্তে আমাদের করনীয় কি তা বলতে দিয়ে তিনি গুরুত্ব দেন সমন্বয়ের উপর। তিনি বলেন, আমাদের জনসংখ্যা বেশি, সেই তুলানায় ভূমি কম। সুতরাং আমাদেরই তো সবচেয়ে বেশি পরিকল্পনায় সময় দিতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের সরকারও পরিকল্পনায় সময় দিতে আগ্রহী নয়। কাজ হলো, একটা প্রচার হলো-এটাই তাদের কাছে যথেষ্ঠ। বুনিয়াদী উন্নয়নের জন্য অনেক পরিকল্পনা করতে হবে। যেহেতু জায়গা কম, লোক বেশি-তাই ভূমির বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার।
তিনি বলেন, তবে মূল বিষয় হচ্ছে, একসাথে অনেক কাজ হতে পারে। তাতে আমি ব্যাক্তিগতভাবে কোন সমস্যা দেখছি না। তবে কাজের মধ্যে অবশ্যই সমন্বয় থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন