যেকোনো কালে যেকোনো যুগে গল্পই সিনেমার প্রাণ। গল্প ছাড়া শিল্প-সাহিত্য, নাটক-সিনেমা হয় না। এর মধ্যে ভাল-মন্দের বিষয়টি রয়েছে। ভালো গল্প এবং এর শক্তিশালী চিত্রনাট্য হলে সিনেমা দর্শক দেখবেই। আমাদের চলচ্চিত্রে এখন যে আকাল চলছে, তার কারণ ভালো গল্পের যুথবদ্ধ চিত্রনাট্যের অভাব। এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। আবার ভাল গল্পের সিনেমা হলেই চলবে না, তা প্রদর্শনেরও ভালো সিনেমা হল লাগবে। আমাদের সিনেমার উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে রয়েছে, এই দুই কারণ। চলচ্চিত্রের চলমান মন্দাবস্থার প্রেক্ষাপটে কথাগুলো বললেন, চিত্রনায়ক ফেরদৌস। তিনি বলেন, আমাদের চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, চার-পাঁচটা গান আর চার-পাঁচটা ফাইটের মিশ্রণ। অনেক নির্মাতা মনে করেন, গল্প যেমন হোক, গানগুলো যদি দেশে-বিদেশে ভাল লোকেশনে শূটিং করা যায়, তাহলে দর্শক দেখবে। এটা তাদের চরম ভ্রান্ত ধারণা। এখন ভালো ভালো থিম নিয়ে মিউজিক ভিডিও হচ্ছে। দর্শক সেগুলো দেখছে। কাজেই সিনেমার গান দেখতে তাদের হলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের প্রয়োজন, ভাল গল্প এবং চিত্রনাট্য, যাতে সিনেমা দেখতে দেখতে দর্শকের মধ্যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এখন আমাদের অনেক নির্মাতা দর্শকের মধ্যে এই অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারছে না। সিনেমা দেখে যদি দর্শকের মনে আনন্দ-বেদনার অনুভূতি সৃষ্টি না হয়, তাহলে সে সিনেমা দর্শক দেখবে কেন? এমনকি ভিলেনের মাধ্যমে শুধু চিৎকার-চেঁচামেচি করে যে ভয়ের দৃশ্য ধারণ করা হয়, তা দর্শককে শিহরিত করতে পারছে না। তারা তা দেখে হাসে। একটা কৌতুকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ একজন ভিলেনকে দিয়ে চিৎকার না করিয়েও দর্শকের মধ্যে শিহরণ সৃষ্টি করা যায়। আমাদের চলচ্চিত্রের মূল সমস্যা হচ্ছে, নকল প্রবণতা। নির্মাতাদের অধিকাংশ বিভিন্ন দেশের দর্শকপ্রিয় সিনেমা নকল করে সিনেমা বানান। অথচ এসব সিনেমা দর্শক আগেই দেখে ফেলেছে। যে সিনেমা দর্শক আগে দেখেছে, তার দুর্বল নির্মাণের বাংলা ভার্সন তারা দেখবে কেন? ফেরদৌস বলেন, নির্মাতাদের মধ্যে সিনেমার গল্প নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অভাব রয়েছে। যদিও এখন কেউ কেউ ভিন্ন ও সমসাময়িক গল্প নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন। তবে তা যথেষ্ট নয়। আমাদের মূল ধারার নির্মাতাদের চিন্তাধারা বদলাতে হবে। প্রযুক্তিজ্ঞান আহরণ করতে হবে। দুই ধরনের সিনেমা নির্মাণের চিন্তা করতে হবে। প্রথমত ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য, দ্বিতীয়ত সিনেপ্লেক্স ও অন্য সিনেমা হলের জন্য। প্রচলিত ফর্মুলেটেড সিনেমা নির্মাণ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আবারও বলছি, এজন্য সবার আগে প্রয়োজন, ভালো গল্পের শক্তিশালী চিত্রনাট্য এবং প্রতিটি দৃশ্য পারফেক্টলি ধারণ করা। দুর্বল চিত্রনাট্য দিয়ে সিনেমা বাঁচানো যাবে না। দর্শক এখন অনেক অ্যাডভান্সড। তাদের ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। ফেরদৌস বলেন, একটি সিনেমা তখনই দর্শকপ্রিয়তা পাবে, যখন নির্মাতা দর্শকের চিন্তার চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। যা দর্শক কল্পনা করতে পারবে না, তা নির্মাতাকে করতে হবে। তাহলে দর্শক সিনেমা দেখার আগ্রহ পাবে। নির্মাতা যদি দর্শকের চিন্তার চেয়ে পিছিয়ে থাকেন এবং দর্শক আগেই জানে তিনি কি সিনেমা নির্মাণ করবেন, তাহলে তো সেই সিনেমা দর্শকের দেখার কোনো কারণ নেই। ফেরদৌস বলেন, চলচ্চিত্রের জন্য প্রয়োজন সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের গল্প। নির্মাতাদের এ সময়ের মানুষের সুখ-দুঃখ ও সমস্যার গল্প নিয়ে ভাবতে হবে। রোমান্টিক গল্পের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনতে হবে। আগের রোমান্টিকতা আর এ সময়ের রোমান্টিকতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এখন ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে একজনের সাথে আরেকজনের প্রেম-ভালবাসা হচ্ছে। সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এসব নিয়ে সমসাময়িক গল্প ও চিত্রনাট্য তৈরি করতে হবে। এছাড়া আমাদের সমৃদ্ধ যে সাহিত্য রয়েছে, এ সাহিত্য নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা জরুরি। ফেরদৌস বলেন, আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির যে ঐতিহ্য তা সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। প্রযুক্তির এ যুগে তা বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা এখন অনেক সহজ। এ কাজটি করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন