উত্তরাঞ্চলের গলার ফাঁস ভারতের গজলডোবা ও ফারাক্কা বাঁধ। বাংলাদেশের উত্তর জনপদের পূর্ব ও পশ্চিমাংশে দুটি ব্যারাজের মাধ্যমে পদ্মা ও তিস্তার পানি প্রত্যাহার করায় ক্রমশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে এ অঞ্চল তথা বাংলাদেশ। বিপর্যয় নেমে এসেছে বিস্তীর্ণ জনপদে। সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসেই উত্তরাঞ্চলের ছোট নদ-নদী পানিশূন্য হলেও বর্তমানে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তার মত বড় বড় নদ-নদী এলাকায়ও মরুভূমিতে পরিনত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি প্রাকৃতিক মনে করা হলেও এটির সাথে প্রতিবেশি দেশের প্রভুত্ববাদী রাজনৈতিক নীতি সম্পৃক্ত। তাই পর্যবেক্ষকদের অভিমত, ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধ বাংলাদেশে আঞ্চলিক রাজনীতির ইস্যু হওয়া উচিত।
বাংলা ২৯ ফাল্গুন দুপুরে এই রিপোর্ট লেখার সময় আবহাওয়া অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দীর্ঘ ৪ মাস ধরে ২৮ ফেব্রুয়ারি এক পশলা বৃষ্টি, ঝড়ো বাতাস এবং কোথাও কোাথাও শিলা বৃষ্টি হয়েছে বগুড়াসহ উত্তর জনপদের বিভিন্ন স্থানে। এর আগে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বাকি ১৫ জেলাতেও এবার বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পানি বিশেষজ্ঞ জানালেন, বিগত বর্ষা মৌসুমের পরপর ৪ দফার বন্যা এবং বর্ষাকালীন অতি বর্ষণের কারণে চলতি বছর এখন পর্যন্ত তেমন কোন বৃষ্টিপাত না হলেও খরার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে পক্ষকালের মধ্যে যদি ভারি বা মাঝারি আকারে ২/১ বার বৃষ্টি না হলে এবারের বৈশাখী খরা মারাত্মক ক্ষতিকর রুপে দেখা দিতে পারে। তার আশঙ্কা চলতি বছরের বৈশাখী ঝড়ের গতি ও প্রচন্ডতা হতে পারে ভয়ঙ্কর। তিনি বলেন, ২৮ ফেব্রæয়ারির শিলাবৃষ্টি তারই একটা নমুনা মাত্র।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, উত্তরের নদনদীগুলোর মধ্যে পদ্মা, মহানন্দা, তিস্তা, ব্রম্ভপুত্র, যমুনা, ধরলা, করতোয়া, বাঙালীসহ প্রায় ৫০টি নদনদীর পানি প্রবাহ বর্তমানে খুবই সীমিত পরিসরে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রায় ৫০ টির মত ছোট নদী ফাল্গুন মাসেই শুকিয়ে সরু নালার আকৃতি ধারণ করেছে। আর বড় বড় নদ নদীগুলোতে জেগে উঠেছে হাজার হাজার চর ও ডুবো চর। ডুবোচরের কারণে ব্যাহত হচ্ছে নৌপথের যোগাযোগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুষ্ক মৌসুমেও ইদানিং হঠাৎ করেই বন্যা দেখা যায়। হিমালয়ান বেল্টে ক্রমশ তাপদাহের কারণে যখনই বেশি মাত্রাই বরফ গলে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পায় তখনই তিস্তা ব্যারাজের গেইট খোলা থাকায় রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলের কিছু নদীতে দেখা দেয় তীব্র ভাঙন। এছাড়া নদীর চরে লাগানো ফসলের ব্যাপক ক্ষতির ঘটনা হয়।
এদিকে কয়েকজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জানালেন, উত্তরাঞ্চলের নদনদীতে পানি সঙ্কটের সাথে এখন আর ভূগোল জড়িত নয়। এর সাথে জড়িয়ে গেছে রাজনীতি। ভারতের রাজনীতিতে ট্রাম্পকার্ড এখন তিস্তার পানি। দিল্লির সূত্রে এ বিষয়ে ইতিবাচক উদ্ধৃতি কথা বারবার প্রকাশ করলেও কার্যত কোন পদক্ষেপ এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের অনেকেই এখন মনে করছেন, মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা অভিমুখী মিছিলের পর পানি ইস্যুতে তেমন বড় কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নেয়নি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মত বড় রাজনৈতিক দলগুলো। বাসদের সিনিয়র নেতা অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম পল্টুর মতে, বাম রাজনৈতিক ফ্রন্টের পক্ষ থেকে তারা বেশ কয়েক দফায় তিস্তা অভিমুখি রোড মার্চের কর্মসূচি পালন করেছেন। রোডমার্চে জনসমর্থন মিললেও অজ্ঞাত কারণে দেশের মিডিয়া এক্ষেত্রে তেমন কাভারেজ দেয় নি। তার মতে উত্তরাঞ্চলের রাজনৈতিক ইস্যুতে এখন ফারাক্কা ও গজলডোবা ব্যারাজের বিষয়টি স্থায়ী আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত।
প্রবীন সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক আব্দুর রহীম বগরার মতে কিছুদিন আগেও পানি ইস্যুটি ছিল বড় প্রতিবেশি ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক ইস্যু। কিন্তু ইদানিং হিমালয় অঞ্চলেও চীনও ভারতে প্রবহমান নদ নদীর পানি আটকে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেক্ষেত্রে পানি ইস্যুটি ক্রমশ ত্রিপাক্ষিক বা বহু মাত্রিক ইস্যুতে রূপ নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে উত্তরের প্রকৃতি, পরিবেশ, ফসল উৎপাদন ইস্যুতে রাজনীতির চর্চা জরুরি ও অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। তার মতে এখনই সময় উত্তরাঞ্চলের স্থানীয় রাজনীতিকদের দেশের স্বার্থে সোচ্চার হওয়া। বিশেষ করে উত্তরের নব প্রজন্মের রাজনীতিকরা যদি ১৯৭৬ সালের মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চের মর্মকথা অনুধাবন করে তাদের রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে তাহলে সেটা হবে কল্যাণকর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন