তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকছে
তিস্তা পাড়ের মানুষের ওপর যেন হঠাৎ গজলডোবার গজব নেমে এসেছে। তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা নিলফামারির জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারি, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারি এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকছে। এতে ব্যাপক ফসলের ক্ষতি হচ্ছে এবং বন্যা ও নদী ভাঙনের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার সেবক থেকে সিকিমের সিমথন পর্যন্ত তিস্তার পানি সরিয়ে নিতে নদীতে দেয়া হয়েছে পাঁচটি বাঁধ। ওইসব বাঁধের মাধ্যমে পানি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হলেও বৃষ্টি হলে সেগুলো ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়া হয়। গত কয়েকদিনে ভারী বৃষ্টির কারণে গজলডোবা সøুইসগেট খুলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজ থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের ওই বাঁধগুলো খুলে দেয়ায় পশ্চিমবঙ্গের টাকিমারি, বদাগঞ্জ, রংদামালি, কালিয়াগঞ্জ, পাহাড়পুর, দোমোহনি, কাছারিঘাট, বার্নিশ, মঙ্গলঘাট, মেখলিগঞ্জ, হলদিবাড়িসব বিস্তীর্ণ এলাকা হয়েছে প্লাবিত। সেই পানি ভাটিতে বাংলাদেশের সীমান্তের তিস্তার আশপাশ ভাসিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই গতকাল তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফলে হঠাৎ করে তলিয়ে গেছে তিস্তার নিলফামারি, লালমনির হাট, রংপুর ও কুড়িগ্রামের তিস্তা পাড়ের কয়েকশ’ গ্রাম। কয়েক মাস আগে ভরা মৌসুমে ভারতের ছেড়ে দেয়া পানিতে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। অতপর ভারতের ছেড়ে দেয়া পানির ওই ঢলে সিলেট শহর তলিয়ে গিয়েছিল।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত তিস্তার পানি চুক্তি ঝুলিয়ে রেখে মূলত বাংলাদেশকে তাদের ‘ড্যাম’ হিসেবে ব্যবহার করছে। বন্ধুত্বের নামে তারা বাংলাদেশের মানুষকে কখনো পানিতে ভাসাচ্ছে কখনো শুকিয়ে মারছে।
জানতে চাইলে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানান, বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে তিস্তায় বুধবার রাত ৯টা থেকে পানি বৃদ্ধি হচ্ছে। আগামী ৩৬ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং কোনো কোনো স্থানে বিপৎসীমা অতিক্রম করবে।
জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে ভারতের বেশ কয়েকটি জেলায় ভারী বর্ষণ হচ্ছে। সে পানির ঢলে তলিয়ে যায় ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে গজলডোবা সøুইসগেট খুলে দেয়া হয়। এতে লালমনিরহাটের তিস্তা নদীতে পানি বেড়ে যায়। কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) বিপৎসীমার দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিস্তা নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি ও ভারতের গজলডোবা ব্যারেজে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় উজানের ঢল বেড়ে যায়। ফলে তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ বেড়েছে। যদিও এখনো জেলার তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। তবে জেলার নিম্নাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এছাড়া পানি জমেছে জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকায়। এসব পানি তিস্তা ও ধরলা নদীতে চলে আসায় পানি অনেকটা বেড়েছে। তারা আরও জানায়, তিস্তা নদীর বাম তীরে ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষায় আদিতমারী উপজেলার গোবর্দ্ধন এলাকায় সলেডি স্প্যার বাঁধ ২ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গত বছর কিছু অংশে ভাঙন দেখা দিলে তা সংস্কার শুরু করে। সেই সংস্কার কাজ শেষ হতে না হতেই আবারও সেটি ভেঙে যাচ্ছে। এত দিনে পানি কমে গেলেও এবার সেটির কোনো কাজ করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
স্থানীয়রা জানায়, শুকিয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় তিস্তা আবারো ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সির্ন্দুনা, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা ইউনিয়নের তিস্তা তীরবর্তী মানুষের শঙ্কা ফের তাদের পানিতে ভাসতে হবে।
তিস্তায় পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়ায় নিলফামারীর ডিমলার ছাতনাই এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারি, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারি এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকছে। এতে এসব এলাকার উঠতি বাদাম, আমনের চারা, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হচ্ছে। এছাড়াও পানি ঢুকছে নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়িতে। পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই অথবা অতিক্রম করলে এই অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। গঙ্গাচড়ার চরের সাইদুল ইসলাম জানান, গত বুধবার রাত থেকে হওয়া বৃষ্টি ও নদীর পানির কারণে আমার বাড়ির সামনের যে বাঁধ ছিল সেটি প্রায় অর্ধেক ভেঙে গেছে। পানি ঢুকছে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বিভিন্ন এলাকায়। এই এলাকার ভুট্টার দামসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। রংপুরের কাউনিয়ার টেপামধুপুর গ্রামের মো. মকবুল হোসেন বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে আমরা অনেক দুর্দশায় পড়ব। আমন লাগানোর জন্য বীজও ফেলতে পারছি না আমরা। যুগের পর যুগ ধরে আমরা ডান তীরে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি কিন্তু সরকার সেটি করছে না।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানির প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। ব্যারাজ রক্ষার্থে সবগুলো কপাট খুলে না দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতি বছর জুন মাসে বন্যা দেখা দেয়। তাই তিস্তাপাড়ের মানুষকে সর্তক থাকতে বলা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন