জীবনের যাবতীয় পাপ থেকে নিজেকে পবিত্র করা ও পরকালীন জীবনের পাথেয় পুণ্য অর্জনের অফুরন্ত সুযোগের মাস পবিত্র মাহে রমজান। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের পয়গাম নিয়ে উপস্থিত ইবাদতের বসন্তকাল। পুণ্যময় এ মাসে মহান রবের ইবাদত উপাসনায় আলোকিত হয় মুমিনের জীবন। ব্যর্থ সে ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেয়েও এর যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারে না এবং নিজের পাপমোচন করাতে পারে না। যে ব্যক্তি রমজান পেয়েও পাপ ক্ষমা করানো থেকে বঞ্চিত হলো মহানবী (সা.) তাকে ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যার কাছে রমজান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি।’ (আদাবুল মুফরাদ : ৫০২)
দীর্ঘদিনের পাপের অভ্যাস ছাড়া অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ১১ মাস পাপের সমুদ্রে নিমজ্জিত থাকার ফলে এ মাসেও লাগামহীনভাবে পাপনিদ্রায় বিভোর থাকে। বড় আক্ষেপের বিষয়, এ পবিত্র মাসেও ভেসে আসে গান-বাজনার আওয়াজ। অনেকে আবার রোজাদারের সামনে প্রকাশ্যে পানাহার করে বেড়ায়। নামাজ-রোজার কথা ভুলে গিয়ে চলে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। অবসরতা কাটাতে কোথাও জমে ওঠে জুয়া ও আড্ডার আসর। এসব রমজানের পবিত্রতা ও মহত্ত¡কে ধ্বংস করে। অনেকে দিনভর রোজা রাখে, আবার গীবত, পরনিন্দা ও মিথ্যা কথাসহ বিভিন্ন পাপ কাজেও লিপ্ত থাকে— এমন ব্যক্তির ভাগ্যে শুধু ক্ষুধাই জোটে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কত রোজাদার আছে, যাদের রোজার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। কত সালাত আদায়কারী আছে যাদের রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই জোটে না।’ (ইবনে মাজা : ১৬৯০)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী আমল করা বর্জন করেনি, তার এই পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি : ১৯০৩)
পাপের উপসর্গ নিয়ে বেড়ে উঠেছে যার জীবন, অন্যায়ের প্রবণতা মিশে আছে রক্ত কণিকায়, পবিত্র রমজান মাসেও যে ব্যক্তি পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছে না— তার উচিত আল্লাহর কাছে বেশি বেশি প্রার্থনায় মনোনিবেশ করা। কেননা দোয়া হলো মুমিনের হাতিয়ার। যেভাবে আল্লাহ শারীরিক অসুস্থতা থেকে সুস্থ করেন, সেভাবেই তিনি আত্মার ব্যাধির প্রতিকার করেন। আল্লাহর দরবারে ঝরা অশ্রু, বৃথা যায় না কখনও। পাপের ভারে ন্যুব্জ বান্দা যখন আল্লাহকে ডাকে তখন তিনি সাড়া দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি সাড়া দেবো।’ (সুরা গাফির : ৬০)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘কে তিনি যিনি, আর্তের ডাক শোনেন যখন সে তাকে ডাকে এবং কে তার দুঃখ দূর করেন?’ (সুরানামল : ৬২)।
পাপের আঁধারে নিমজ্জিত ব্যক্তির পক্ষে রাতারাতি পাপমুক্ত হওয়া দুষ্কর, এর জন্য চাই ধৈর্য ও অবিরাম চেষ্টা। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে পরিচালিত হওয়ার চেষ্টা করে আল্লাহ তার পথ খুলে দেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯)
পাপের আনন্দ শেষ হয়ে থেকে যায় এর অশুভ পরিণাম। ইবাদতের কষ্ট শেষ হয়ে থেকে যায় এর শুভ পরিণাম। তাই পাপের শাস্তি ও এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তার মাধ্যমে পাপমুক্ত হওয়া সহজ। আখেরাতের অপেক্ষমাণ কঠিন আজাব ছাড়াও এই পৃথিবীতে পাপের নগদ শাস্তি হলো— দুঃখ, দুর্দশা, অশান্তি, অস্থিরতা ও হতাশা। এ ছাড়াও পাপের কারণে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার দূরত্ব তৈরি হয়; পাপী ব্যক্তি থেকে তাঁর রহমতের দৃষ্টি উঠে যায়। তারা বিপদাপদ ও বিপর্যয়ে আপতিত হয়, দূরারোগ্য রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং রুজিরোজগারের সঙ্কটে জর্জরিত হয়। গুনাহ যেমনভাবে মানুষের শারীরিক কষ্ট ও শাস্তির কারণ, তেমনিভাবে তা আত্মিক রোগ-ব্যাধিরও কারণ। কারও থেকে একটি গুনাহ সংগঠিত হলে সেটি আরেকটি গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার কারণ হয়। হাফেজ ইবনুল কাইয়্যুম রহ. বলেন, গুনাহের একটি নগদ শাস্তি হলো, এর দ্বারা সে আরেকটি গুনাহের শিকার হয়। অনুরূপভাবে নেক কাজের একটি নগদ পুরস্কার হলো, একটি নেক কাজ আরেকটি নেক কাজের দিকে টেনে নেয়। (মায়ারিফুল কুরআন : ৭/৭০১)। রমজানে অভিশাপ্ত শয়তানকে বন্দি করে রাখা হলেও প্রত্যেকের সঙ্গে ‘নফসে আম্মারা’ কিন্তু ঠিকই রয়েছে— যা মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয় এবং কুপ্রবৃত্তির প্রতি আহবান করে। তাই সব ধরনের গুনাহের উপকরণ থেকে দূরে থাকতে হবে, বিশেষত দৃষ্টিকে হেফাজত রাখতে হবে।
সেহরি ও ইফতারে পরিমিত পানাহার করা উচিত। কারণ, মাত্রাতিরিক্ত খাবার আহারের ফলে ইবাদতে অলসতা তৈরি হয় এবং গুনাহের প্রবৃত্তি জাগ্রত হয়। আমরা যদি ভোজনবিলাসী না হয়ে মহানবীর (সা.) প্রকৃত সুন্নত এবং সাহাবিদের রোজা রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করে ভোজনে সংযমী হয়ে সীমিতভাবে সেহরি ও ইফতার করি, তা হলে এর মধ্যদিয়ে আমাদেও কৃপ্রবৃত্তিকে দুর্বল হবে এবং সুকুমারবৃত্তিগুলো বিকশিত হবে। রমজান সংযমের মাস, সাধনার মাস, ত্যাগের মাস। কিন্তু আমরা রমজানের এই বার্তাকে ভুলে গিয়ে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবিদের অনুসৃত পথ পরিহার করে সেহরি ও ইফতারে এতটাই ভোজনবিলাসী, খাদ্য ভোগী হয়ে উঠি যা রমজানের সংযম, সাধনা ও ত্যাগের বার্তাকে ভুলিয়ে দেয়। ফলে আমাদের কুপ্রবৃত্তি দুর্বল না হয়ে আরও হিংস্র ও পাশবিক হয়ে ওঠে। কাম, লিপ্সা, রাগ, মোহ আরও বেড়ে যায়। আমাদের সুকুমারবৃত্তিগুলো বিকশিত না হয়ে আরও নিস্তেজ হয়ে যায়।
মাহে রমজানে গুনাহ থেকে বাঁচতে হলে অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে সৎ সঙ্গ গ্রহণ করতে হবে। কেননা মানুষ পাপ কাজে অসৎ সঙ্গীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই পাপ থেকে বেঁচে থাকতে সৎ ও ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। মহানবী (সা.) ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তুমি মুমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন পরহেজগার লোকে খায়।’ (আবু দাউদ : ৪৮৩২)। রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের ওপরও; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। আমাদের সবার মনে সর্বদা এই চেতনা জাগ্রত রাখতে হবে যে, প্রতি মুহূর্তে আমরা যা করছি আল্লাহ তায়ালা তা দেখছেন। যেমন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা হুজরাত : ১৮)
আর এভাবে আল্লাহর ধ্যান দিলে জাগরুক রাখতে পারলেই পাপমুক্ত জীবনযাপন সম্ভব। তখন কেউ কারও ওপর জুলুম করবে না, একে অন্যের হক নষ্ট করবে না। আল্লাহ তায়ালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করবে না এবং যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ ও পাপাচারে লিপ্ত হবে না। এরই নাম তাকওয়া। রহমতের এই বসন্তকালে আসুন আমরা খোদাভীতি অর্জন করি এবং নিজেদের পাপ কর্মের জন্য খাঁটি মনে তওবা করে ভবিষ্যতেও যাবতীয় পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে একটি পুণ্যময় রমজান কাটাই। তবেই অনিন্দ্য সুন্দর হবে আমাদের ইহকাল ও পরকাল।
লেখক : মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া, নারায়ণগঞ্জ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন