সিলেটে পুলিশী নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র প্রদান করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আজ (বুধবার) বন্দর বাজার ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া সহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে ওই অভিযোগপত্রটি জমা দেয়া হয়েছে আদালতে। তবে অভিযোগপত্রে যেসব আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদন্ডও হতে পারে বলে অভিযুক্তদেও এমন তথ্য জানিয়েছেন, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর আজ দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান জানান, অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ৩০২, ৫০১ ও ৩৪ ধারায়। এছাড়া অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫(২), ১৫(৩) ধারায়। ওই দুই আইনের একটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ও অপরটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের কথা উল্লেখ রয়েছে। ফলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদন্ডও হতে পারে তাদের। ১৯৬২ পৃষ্টার এই অভিযোগপত্রে ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে জানিয়ে এসপি বলেন, এরমধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশ রয়েছেন ৭ জন। তবে রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন পূর্ব পরিকল্পিত কিংবা পূর্ব বিরোধের জের ধরে নয় বলে দাবি করেছেন পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ।
তিনি বলেন, তদন্তে রায়হান আহমদকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানোর প্রমাণ মিলেছে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ বহিস্কৃত এসআই
আকবর হোসেন ভূইয়া, বহিস্কৃত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও টিটু চন্দ্র দাস নির্যাতনে অংশ নেন বলে প্রমাণ মিলেছে তদন্তে। আর নির্যাতনের আলামত নষ্ট ও অভিযুক্তদের পালাতে সহয়াতা করেন বহিস্কৃত এএসআই হাসান উদ্দিন এবং কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত করা হয়েছে এই ৬ জনকে।
নগরীর আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০অক্টোবর রাতে সিলেট কতোয়ালীর মডেল থাানর অর্ন্তগত বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া ও তার সহকর্মী সহকারীরা।
ফাঁড়িতে রায়হানকে ধরে আনা প্রসঙ্গে এসপি খালেদ উজ জামান বলেন, সাইদুল শেখ নামের এক ব্যক্তির অভিযোগ ছিল ছিনতাইয়ের. সেই প্রেক্ষিতে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে পুলিশ। এসপি বলেন, সাইদুল ইয়াবা সংগ্রহ করতে কাষ্টঘর এলাকায় গিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলাও রয়েছে। সাইদুলের দাবি, ইয়াবা সংগ্রহকালে সেখানে রায়হানের সাথে বাকবিতন্ডা হয় তার।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই পুলিশ সুপার আরও জানান, সাইদু্লরে অভিযোগ পেয়ে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে। সেখানে জিজ্ঞাসবাদকালে মারধর করা হয় তাকে। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন রায়হান। পরে হাসপাতালে মারা যান তিনি।
এদিকে, নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম প্রথম থেকেই অভিযোগ করেছিলেন, অন্য কারো ইন্ধনে পূর্ব পরিকল্পনার জেরে রায়হানকে তুলে এনে নির্যাতন করেছে বন্দও বাজার পুলিশ। তবে বুধবার এসপি খালেদ-উজ-জামান বলেন, দীর্ঘ তদন্ত, সবার সাক্ষ্য গ্রহণ এবং রায়হান, আকবর সহ সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোন আলাপ সংগ্রহ করেও এরকম কোনো প্রমাণ পাইনি আমরা। রায়হানকে নির্যাতনের সাথে পূর্ব বিরোধের কোন কিছু পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
অভিযোগপত্র নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন বলেন, জড়িত সব আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাহলে শান্তি পাবে আমার ছেলের আত্মা। আমি মরে যাওয়ার আগে আসামীদের শাস্তি দেখে যেতে চাই এটা আমার প্রত্যাশা।
জানা যায়, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রীর করা মামলার পর মহানগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়িতে নিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা পায়। এরপর ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁঞাসহ চারজনকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে করা হয় প্রত্যাহার। কিন্তু ১৩ অক্টোবর পুলিশী হেফাজত থেকে পালিয়ে যান আকবর। ৯ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে আকবরকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে বরখাস্ত কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও হারুন অর রশিদ এবং প্রত্যাহার হওয়া এএসআই আশেক এলাহীকে গ্রেফতার করা হয়। ১১ অক্টোবর রায়হানের মৃত্যুর দিনই ওসমানী মেডিকেল কলেজের মর্গে প্রথম ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্ত শেষে রায়হানের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। ভিসেরা রিপোর্টেও নির্যাতনের বিষয়টি উঠে আসে।
প্রসঙ্গত, নগরীর আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা। এরপর কয়েক ঘণ্টা চলে নির্যাতন। শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করে রায়হান। এসময় তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুরোধ করে। ভোরের ফজরের নামাজের পূর্ব মূহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তবে তখন রায়হানের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি তাকে। এরপর ১১ অক্টোবর সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতপালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার। ১১ অক্টাবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে সিলেট জুড়ে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন