মহান রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং এ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে বলেন:“আমি জীন ও ইনসানকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি”(আযযারিয়াত: ৫৬)। ইবাদতের অপরিহার্য একটি বিষয় হলো তাকওয়া অর্জন। আল্লাহ তা’আলা বলেন:“হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা ঐ আল্লাহকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক আত্মা হতে সৃষ্টি করেছেন”(সূরা নিসা:০১)। আল্লাহ তা’আলা তাঁর এক মহা নেয়ামত হিসেবে রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের মাস রমাদানুল মোবারক তাঁর বান্দাদের দান করেছেন। তাই সকল মু’মিনের উচিত এ মহিমান্বিত মাসের প্রতিটা মুহুর্তকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে কাজে লাগানো।
সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো তাকওয়া অর্জন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:“হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, আশা করা যায় এতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে” (সূরা আল-বাক্বারা :১৮৩)। উক্ত আয়াত পাঠান্তে আমরা আল্লাহ তা’আলার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাই। যথা: (১) রমজান মাসের সিয়াম সাধনা সকল মুসলিমের জন্য আবশ্যক তথা ফরজ ইবাদত, (২) এ সিয়ামের বিধান শুধু আমাদের ওপরই ফরজ করা হয়নি; বরং পূর্বের বহু জাতি-গোষ্ঠীর ওপরও ফরজ হিসেবে সাব্যস্ত ছিল এবং (৩) সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো তাকওয়ার গুণাবলী অর্জন করা। ইসলামে রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, সাদা-কালো, ভাষা, জাতি, গোত্র ও বংশের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই; বরং সকল মুসলমানের মাঝে সাম্যতা আনয়ন করেছে। তবে তাকওয়ার গুণাবলী একের ওপর অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব বিধান করে, মানুষকে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত করে এবং মর্যাদার আসনে সমাসীন করে। আল্লাহ তা’আলার বাণী:“তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদা সম্পন্ন, যে বেশি তাকওয়াবান”(সূরা আল-হুজুরাত:১৩)।
ক. তাকওয়ার পরিচয়:
তাকওয়ার আভিধানিক অর্থ: তাকওয়া, আল্লাহর ভয়, পরহেজগারি, সংযম, রক্ষা, বেঁচে থাকা, সাবধানতা অবলম্বন, ধার্মিকতা ইত্যাদি। পরিভাষায়:
-হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) মুত্তাকীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন:‘মুত্তাকী হলো তারা যারা আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে’।
-হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেন:
‘তাকওয়া হলো আল্লাহর আনুগত্য করা, অবাধ্য না হওয়া, তাঁকে স্মরণ করা, ভুলে না যাওয়া, তাঁর কৃতজ্ঞতা পোষণ করা এবং অকৃতজ্ঞ না হওয়া’।
-তাকওয়ার ব্যাখ্যায় হযরত ওমর (রা.) হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.) কে জিজ্ঞাসা করেন, তাকওয়া কাকে বলে? তখন তিনি ওমর (রা.) কে বলেন, আপনি কী কখনো ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর দিয়ে পথ চলেন নি? তিনি বলেন হ্যাঁ, চলেছি। উবাই (রা.) বলেন, তখন আপনি কী করেছেন? তিনি বলেন, তখন আমি জড়সড় হয়ে পথ চলেছি, যাতে কাঁটা শরীরে বিদ্ধ না হয়। তখন তিনি বলেন, সেটাই তাকওয়া। বস্তুত সাওয়াবের আশায় ও শাস্তির ভয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার বিষয়ে সদা সচেতন থাকা এবং পাপাচার হতে বেঁচে থাকাই তাকওয়া।
অতএব আমরা বলতে পারি, ইসলামের আদিষ্ট বিষয়গুলোর প্রতিপালন, নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর বর্জন ও আল্লাহ তা’আলার নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতিই তাকওয়া। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল মাজীদে ঘোষণা করেন:‘তোমাদের রাসূল যা কিছু নিয়ে এসেছেন, সেগুলো আঁকড়ে ধরো আর তিনি যেসব বিষয়ে নিষেধ করেছেন, সেগুলো থেকে বিরত থাকো”(সূরা আল-হাশর:৭)।
খ. তাকওয়ার গুরুত্ব:
মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হালাল-হারাম,ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা আর উচিত-অনুচিত ইত্যাদি বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ হতে পারার মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলি নিহিত। কুরআনুল কারীমের একাধিক জায়গায় আল্লাহ তা’আলা এবিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন, যেমন তিনি বলেন:“হে বিশ্বাসীগণ!তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, ঠিক যতটুকু তাঁকে ভয় করা উচিত আর তোমরা পরিপূর্ণ মুসলমান না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না”(সূরা আল-ইমরান:১০২)। অন্যত্র বলেন:“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করো (তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে পারো) তাহলে তিনি তোমাদের জন্য (অন্যদের থেকে) পার্থক্যকারী কিছু স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং কৃত অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন”(আল-আনফাল :২৯)। অনুরূপভাবে তিনি বলেন:“সেসব জনপদবাসী যদি বিশ্বাস স্থাপন ও তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতো তাহলে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের বরকতের সব দুয়ার আমি তাদের জন্য খুলে দিতাম”(আল-আনফাল:৯৬)। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:“তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার”(সূরা আল-বাক্বার:১৮৯)।
উপরোল্লেখিত প্রমানাদিসহ কুরআনুল কারীম ও হাদীসের অসংখ্য দলীল দ্বারা বুঝা যায় যে, রহমত, বরকত, মাগফিরাত, মুক্তি ও মহান রবের সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে আমাদের অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন, ধারন ও পালন করতে হবে ।
গ. তাকওয়া অর্জনে সিয়ামের ভূমিকা:
মাহে রমজান হচ্ছে সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস, স্বীয় অপরাধ ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার মাস এবং তাকওয়ার গুণাবলিতে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সর্বোৎকৃষ্ট সময়। রোজার প্রতিটি রীতি-নীতি ও কার্যকলাপে তাকওয়ার শিক্ষা রয়েছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণার তীব্র চাহিদা থাকা সত্তে¡ও একজন রোজাদার সারাদিন খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করে না, স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা পূরণ হতে বিরত থাকে; কারণ সে আল্লাহকে ভয় করে। এটি এজন্য নয় যে, সে খাদ্য গ্রহণ করলে কেউ দেখে ফেলবে; বরং রোজাদারের হৃদয়জুড়ে এ বিশ্বাস প্রবল যে, দুনিয়ার কেউ দেখুক আর না-ই দেখুক, সেই মহান মনীব তাকে দেখছেন যিনি সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক ও পর্যবেক্ষক। তাই দিনের বেলায় পানাহার করা যাবে না, রোজার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কাজ করা যাবে না, তাঁর কোন আদেশ-নিষেধ অমান্য করা যাবে না। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন:“যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখলো কিন্তু মিথ্যা কথা ও অশ্লীল কাজ পরিহার করলো না তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই”(সহীহুল বুখারী)। আল্লাহ তা’আলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার এ অনুভূতিই তাকওয়া, যা অর্জনের এক সর্বোৎকৃষ্ট সময় শাহরু রমাদান।
মাসব্যপী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত তাকওয়ার এ গুণটি যদি কোনো ব্যক্তি লালন ও পালন করে, তাহলে তার পক্ষে মিথ্যা বলা, অন্যের হক নষ্ট করা, ঘুষ ও সুদ খাওয়া, আমানতের খেয়ানত করা, প্রতারণা করা, মালে ভেজাল দেওয়া, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে জনসাধারণের ভোগান্তি সৃষ্টি করা, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, গরীব ও অসহায়দের ত্রাণের মাল আত্মসাত করা, ইভটিজিং, ধর্ষণসহ যে কোন অন্যায় কাজ করা ও দুর্নীতিপরায়ণ হওয়া সম্ভব নয়। কেননা সে সবসময় মনে করবে, আমি কোনো অন্যায় কাজ করলে মহান আল্লাহ তা দেখবেন এবং এর জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হবে ও পরিণাম ভোগ করতে হবে। এ জন্যই হাদীসে কুদসীতে এসেছে, হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:“সাওম কেবল আমারই জন্য এবং এর প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব; কেননা সে (রোযাদার) আমার সন্তুষ্টির জন্যই পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পরিহার করে” (সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। (চলবে)
লেখক : শিক্ষক, নিবরাস মাদরাসা, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন