রোজা এমন এক ইবাদাত যার প্রতিদান ফেরেস্তারা লিখতে অপারগ। কলমের কালি যার হিসাব লিখতে অক্ষম। রোজা একমাত্র মহান রবের জন্য। মহান আল্লাহ নিজ হাতে তার প্রতিদান দিবেন। এমন বরকতময় রমজান প্রতিবার আমাদের নিকট আসে মাস পেরিয়ে আবার সে এক বছরের জন্য বিদায় নেয়। এভাবে আমাদের জীবনে অনেকগুলো রমজান পেরিয়ে আমরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ি। পৃথিবীর সব আমল শেষ হয়ে যায়। শুরু হয় তার ফল লাভ।
আমাদের জীবনে ৩০,৪০, ৫০ বা ৬০ বা তারও বেশি মাস আমরা রোজা আদায় করি। ফল যেই সেই। রোজার আগে আমার চরিত্র আর পরের চরিত্র কোন পার্থক্য নেই। পুরো মাস আমার আত্মার চিকিৎসা করলাম। কিন্তু আত্মার রোগ বালাই দূর হল না। আমার আত্মা পরিশুদ্ধ হল না। আসুন একটু যাচাই করি:
রমজান সংযম, না কি অপচয়ের মাস: রোজাকে আমরা সকলে সংযমের মাস বলি। আসলে রোজা সংযমের মাস। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায় রোজাকে আমরা অপচয়ের মাস বানিয়ে নিয়েছি। রমজান এক উৎসবের মাসে রূপ নিয়েছে। এই মাসে খরচ বেশি। এই মাসে বাজার বেশি। রোজার মাসে আমরা সবচেয়ে বেশি খাবার খাই। সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট করি। ইফতারী আর সাহরীতে এত আইটেম আর এত খাবার তৈরী হয়, যা আমরা প্রচুর খেয়েও শেষ করতে পারি না। অনেক খাবার নষ্ট হয়। অপরদিকে অনেক মানুষ এমন আছে না খেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে তাদের খবর রাখারও সুযোগ হচ্ছে না। রোজা যতই মর্যাাদাপূর্ণ ইবাদাত হোক না কেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অপচয় কারীকে ভালবাসেন না। কেননা অপচয়কারী শয়তানের ভাই। শয়তানের ভাই সেজে আমি কিভাবে মাওলার প্রিয় হতে পারি? এই অপচয় আমাকে আমার প্রভুর নিকট থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই রমজানে বেশি খাওয়ার আইটেম নয়। বেশি খাওয়া নয়। অপচয় নয়। তবেই রমজান হবে সংযমের মাস।
রমজান ইবাদাতের মাস না কি খেলাধুলার মাস: রমজানে একটি নফল আদায় করলে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। একটি ফরজ আদায় করলে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। এই মাসে যত বেশি ইবাদাত করা যাবে। ততই বেশি লাভ হবে। কিন্তু আমরা রমজানকে আমোদ প্রমোদ, বিনোদন আর খেলার মাস বানিয়ে নিয়েছি। সময় কাটানোর জন্য আমরা ক্রিকেট খেলা দেখা সহ আরো বিভিন্ন খেলায় লিপ্ত থাকি। আপনি যত খেলাই বলুন কোন খেলা কি সওয়াবের কাজ। কোন খেলাধুলা কি ইবাদাত তুল্য? অবশ্যই না। তাহলে রমজানে আমি মূল্যবান সময়টাকে খেলায় না কাটিয়ে ইবাদাত, তেলাওয়াত, ইস্তেগফার, দরুদ পাঠ ইত্যাদি কাজে ব্যয় করি। তবেই রমজান আমাকে সুফল এনে দেবে। রমজানকে খেলার মাস বানিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করা কি কোন বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
রমজান ইবাদাতের মাস না কি বিনোদনের মাস: রমজান মাসে অন্য মাসের তুলনায় একটু অবসর বেশি। অফিস সময় কম। ব্যবসায় সময় কম। এই অবসর সময়কে নিয়ামত মনে না করে কষ্টকর মনে করি। তাই এই সময় কাটানোর জন্য টিভি দেখা, ফেইসবুক সহ সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি বিনোদনে লিপ্ত হয়ে যাই। অথচ আমার উচিত ছিল, এই অবসর সময়ে ইবাদাতের মিষ্টতা গ্রহন করা। কোরআনুল কারিমের তেলাওয়াতের স্বাদ গ্রহন করা। কোরআনের মাসে কোরআন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করা।
রমজান ইহসানের মাস না কি অন্যের কষ্ট বাড়ানোর মাস: রমজান মাস অন্যের কষ্ট অনুধাবন করার মাস। অন্যের কষ্ট দূর করার মাস। কিন্তু রমজান মাসে আমার ইফতার সাহরীতে এতো বেশি আইটেম থাকতে হয় যে, ঘরের মা, বোন, স্ত্রী, মেয়ে তাদের সারাদিন এই রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তারা কোন ইবাদাতের সুযোগ পান না। তারপরও আমার মন ভরে না। আরো বেশি চাই, আরো বেশি চাই। অথচ একটু চিন্তা করলেই আমার খাবার আইটেম কমাতে পারি। তাদের সময় বাঁচিয়ে ইবাদাতের সুযোগ করে দিতে পারি। তাদের কষ্ট কমাতে পারি। এতে তাদেরও লাভ হয়। আমারও লাভ হয়।
রমজান দানের মাস না কি বেশি লাভ করার মাস: রমজান মাস দানের মাস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মাসে সবচেয়ে বেশি দান করতেন। তিনি প্রবাহিত বায়ুর চেয়ে আরো বেশি প্রসারিত, মুক্ত হস্তে দান করতেন। এই মাসে সকল ভাল কাজেই বেশি সওয়াব। কিন্তু আমরা দানের পরিবর্তে এই মাসকে ব্যবসায় বেশি লাভের মাস বানিয়ে নিয়েছি। এই এক মাসেই সারা লাভ করে নিতে হবে। তাই রমজান আসার আগেই জিনিস পত্রের দাম আগুনের মত বাড়তে থাকে। অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে দাম চলে যায়। কোন ব্যবসায়ীই দাম কমানোর উদ্যোগ নেন না। কিভাবে আরো বেশি লাভ করা যায় এই ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন। একটু ভাবুন তো এই অবস্থায় আমি কিভাবে রমজানের বরকত লাভে ধন্য হতে পারি!
রমজান অন্যের কষ্ট বুঝার মাস ন কি ঘুমানোর মাস: রমজান গরীবের ক্ষুধার জ্বালা, অনাহারের কষ্ট বুঝার মাস। কিন্তু আমি যদি সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাই তবে আমার পক্ষে তাদের কষ্ট বুঝা সম্ভব হবে? কোন ভাবেই না। আমরা অনেকেই রমজানের অবসর ঘুমিয়ে কাটাই। অন্যের কষ্ট অনুধাবন করতে হলে আমাকে অবশ্যই দিনের ঘুম ছেড়ে দিতে হবে। ক্ষুধার কষ্ট অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে।
রমজান কাজের মাস না কি ফাঁকি দেওয়ার মাস: স্বাভাবিক ভাবেই রমজানে অন্য মাসের তুলনায় কাজ কম থাকে। যারা আল্লাহর প্রিয় হতে চান তারা তাদের কর্মীদেরকে কাজ কমিয়ে দেন। আমাদের দেশে রমজানে অফিস সময়ও কম। কিন্তু এই অফিস সময়ের মধ্যে আমরা অনেকেই রোজার দোহাই দিয়ে আরো কাজ কম করতে চাই। রমজানের কষ্ট বলে চালিয়ে দেই। একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, রমজান সবচেয়ে বেশি কষ্ট করার মাস। এই মাসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ বদরের বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই মাসেই ইসলামের চুড়ান্ত বিজয় মক্কা বিজয় সাধিত হয়েছে। এই মাসে মহাবীর তারিক বিন যিয়াদ রাহঃ এর নেতৃত্বে স্পেনের মাটিতে কালিমার বিজয় পতাকা পত পত করে উড্ডীন হয়েছে। এই বরকতময় মাসে মুহাম্মদ বিন কাসিম রাহঃ আমাদের এই প্রিয় ভারত ভূমি জয় করেছেন। তাই এই মাস কাজ কম করার মাস নয়। সবচেয়ে কঠিনতম কাজ করে সফলতা অর্জনের মাস এই রমজান। তাই এই মাসে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব খুব ভাল ভাবে আঞ্জাম দেওয়ার এই রমজান মাস।
রমজান ব্যস্ততার মাস না অলসতা আর গল্পের মাস: রমজান রহমতের বসন্তকাল। এই মাসে যে আজলা ভরে রহমত কুড়িয়ে নেবে সেই সফল। এই মাসে আমরা বেখেয়ালে সময় কাটানোর জন্য আড্ডা আর গল্পে সময় ব্যয় করি। এই আড্ডায় সময় ব্যয়ে আমরা গীবত, মিথ্যা অনেক পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ি। অথচ রমজানের এক একটি মুহুর্ত অনেক অনেক মূল্যবান। এই এক একটি সময় আমার কাছে আর কখনো ফিরে আসবে না, শুধু আফসোস রেখে যাবে। আমার সময় যদি আড্ডা, গল্প, গীবত আর মিথ্যায় লেগে যায় তবে আমার উপোস থাকায় কোন লাভ হবে না।
আসুন রমজানকে রমজানের মত করেই কাটাই। রমজান নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করি। নিজের কাজগুলোকে ঢেলে সাজাই। নিজের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করি এবং শোধরানোর চেষ্টা করি।
লেখক ; শিক্ষাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন