সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বেশি সময়- স্মৃতিমগ্ন সময় কাটিয়েছি আমি ২/১ আর.কে মিশন রোডের ইনকিলাব ভবনে। নানা কারণেই আমার কাছে অন্য রকমের গুরুত্ব বহন করে এই সময়কাল। এখানে আমার কর্মজীবন ছিল শুরু থেকে পরবর্তী প্রায় ২৯ বছর। এর আগে দৈনিক আজাদ-এ দুই দফায় প্রায় এগার বছর এবং ইত্তেফাক-এ তিন বছর কেটেছে আমার কর্মজীবন। তিনটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে এই সমুদয় স্মৃতি যে কোন সাংবাদিকের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমার সাহিত্যকর্মের অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার পাশাপাশি দৈনিক ‘আজাদ’-এর স্মৃতিকথার খসড়া শেষ করে আমার সবচেয়ে দীর্ঘ কর্ম-সময় যেখানে কেটেছে সেই ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর স্মৃতিকথা যখন লেখা শুরু করছি, তখন ইনকিলাব তার প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছর পার করে ৩৬ বছর অর্থাৎ তিন যুগের শেষ বছরের যাত্রা শুরু করেছে। শুরু থেকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকায় দৈনিক ইনকিলাব-এর এই গৌরবময় পথযাত্রা আমার কাছে খুবই আনন্দময় অভিজ্ঞতা।
আমি ডায়েরি না রাখায় স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে ব্যক্তি এবং ঘটনাকেই অবলম্বন করতে হচ্ছে। নোট করছি- আবার প্রতিদিন লেখার সময় পাঠ করছি- এভাবেই ‘আজাদ পর্ব’ এর খসড়া প্রায় শেষ করে এখন ‘ইনকিলাব পর্ব’ শুরু করেছি। ইনকিলাব-এ আমার স্মৃতিমগ্ন সময়ের কথা আমি একটু অন্যভাবে লিখতে চাই- জানি না পারব কি না। যখন এই ভিন্নমাত্রার কথা ভাবছি তখন ইনকিলাব-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় আমাকে দু’চার কথা লিখতে বলা হয়েছে। যেদিন লিখতে বলা হয়, তার আগের দিনই এই ক’টি প্রশ্ন নোট করেছি-
১. কেন, কী কারণে ইনকিলাব দ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে সর্বশীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল-
২. একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের কাছে পাঠকের অন্তর্গত চাহিদা ইনকিলাব কীভাবে নির্ণয় করেছে এবং পূরণই বা করেছে কীভাবে-
৩. প্রচলিত সংবাদমাধ্যম থেকে অতিরিক্ত দৃশ্যগ্রাহ্য কী বা কী কী দিয়েছে ইনকিলাব তার পাঠকদের-
৪. অন্তর্গত এমন কোন্ বোধ-চৈতন্যকে ইনকিলাব ধারণ করেছে, যা পাঠকদের অশনাক্ত কিংবা অকথিত চাহিদা মিটাতে পেরেছে-
ইনকিলাব পাঠকদের হাতে পৌঁছে ১৯৮৬ সালের ৪ জুন তারিখে। তারও কিছুদিন আগে থেকে পরিকল্পনাকালে কমবেশি জড়িত থাকায় স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে শুরুতেই এই ক’টি বিষয় সামনে এসেছে। সংবাদমাধ্যম হিসেবে দৈনিক ইনকিলাবের নিজস্ব অবস্থান আছে এবং সেই অবস্থানে থেকেই ইনকিলাব তার জীবনের ৩৫টি বছর পার করেছে। দীর্ঘ এই যাত্রাপথ যা হয়, আগাগোড়া মসৃণ ছিল না। এই জাতীয় দৈনিকটিকেও নানা টানাপড়েন, চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আসতে হয়েছে। তবে এটা লক্ষ করা গেছে, ইনকিলাব কখনই হতাশ হয়নি, হতোদ্যম হয়নি, নীতি-আদর্শ-লক্ষ্য অক্ষুণ্ণ রেখে পথ চলেছে কখনও দ্রুত, কখনও ধীর গতিতে। জাতীয় দৈনিক হিসেবে দেশের জনগণের প্রতি অন্তর্গত আস্থা-শক্তি কখনও স্তিমিত হয়নি। জনগণও কখনও তাদের এই মুখপত্র- যা ‘শুধু দেশ ও জনগণের পক্ষে’- তার ওপর থেকে আস্থা হারায়নি। এটাই ইনকিলাব-এর শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এ কারণেই এই দৈনিকটির শক্তি-সমর্থন কোথায়, এ প্রশ্ন আসলে অবান্তর। এ দেশ ও জনগণের অন্তর্গত প্রেরণা-সমর্থন অতীতের মতো আগামীতেও অব্যাহত থাকবে, এটা মনে করা ভুল কিছু হবে না। ইনকিলাবের কর্মকান্ডের বিশদ বিবরণ তুলে ধরা ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়, তার বিশেষ দরকারও নেই।
ইনকিলাব জাতীয় উন্নয়ন-উৎকর্ষের কথা; জাতীয় স্বার্থের কথা বলেছে এবং কখনই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিনিময়ে তা বলেনি। সত্য-ন্যায়-মানবিকতাকে ইনকিলাব সব সময় সামনে রাখতে চেয়েছে। কখনও ব্যক্তির নয়, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যক্তির কর্ম-আচরণকে বিবেচনায় নিয়েছে, আলোচনা করেছে। কারও ভালো লেগেছে, কারও ভালো লাগেনি, আর এটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। সব সংবাদপত্রেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং তৎজাত চিন্তা-ভাবনা থাকতে পারে, থাকেও। তবে সত্যিকার জাতীয় সংবাদপত্রের সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয়, সর্বোতভাবে জাতীয়স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তার নিরিখেই সকল চিন্তা-ভাবনা ও ভূমিকা গ্রহণ। জাতীয় দৈনিক হিসেবে ইনকিলাবও এই ভূমিকা পালন করে চলেছে। সংবাদপত্র সাধারণত পাঠকদের জন্য সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি ঘটনা-প্রবাহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক সম্পাদকীয় মন্তব্যও করে থাকে। প্রকাশিত হয় সম্পাদকীয়তে। সাধারণত দেশের স্বার্থ ও জনগণের মতামতই সংবাদপত্রের কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনিত হয়। এই দায়িত্ব ইনকিলাব শুরু থেকে নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছে। দৈনিক ইনকিলাব-এ ৩৫ বছরে প্রায় ২৫ হাজারের মতো সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, আর এসবের মধ্যে উপরের কথাগুলোর সারবত্তা কমবেশি প্রতিফলিত হয়েছে এবং তা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যাবে।
মাস্টের উপরে তো প্রতিদিন ছাপা হয়, ইনকিলাব ‘শুধু দেশ ও জনগণের পক্ষে’, এই ছোট কথাটি শুধু ছাপার জন্য ছাপা কিংবা ওই জায়গাটা ভরাট করার জন্যও নয়। দেশ ও জনগণের পক্ষে ভূমিকা রাখা, অব্যাহত ভূমিকা রাখা জাতীয় সংবাদপত্রের দায়িত্ব। ইনকিলাবের দায়িত্বও এটাই। কথা ছোট-কিন্তু কাজটি জাতির আবেগ-চাহিদার দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই ছোট নয় কিংবা কাজটি না করলে চলবে, এমনও নয়। ইনকিলাব তার পথচলার শুরু থেকে এব্যাপারে জাগ্রত বোধ-চেতনার সাক্ষর রেখেছে। আরও একটি বিষয় আছে, ইনকিলাব কী করেছে- এর চেয়েও কম জরুরি কথা নয় ইনকিলাব কী করেনি? এই ৩৫ বছর ধরে যাঁরা ইনকিলাবের সাথে পাঠক হিসেবে, বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে, এজেন্ট হিসেবে এবং সর্বোপরি শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আছেন, তাঁরা এর জবাব জানেন।
জাতীয় দৈনিক নিজস্ব দায়িত্বশীলতার তাগিদেই অন্য কারও ভালো লাগুক বা না লাগুক সেই অপরিহার্য দায়িত্বগুলো পালন করে থাকে- যা ইনকিলাব বিগত ৩৫ বছর যাবত সযত্নে করে আসছে। কারও ভালো লাগবে, কারও ভালো লাগবে না, এটাই স্বাভাবিক। ভালো লাগা- না লাগা একান্তই নিজস্ব বিষয় হিসেবে গণ্য করতে হবে। এটা জাতীয় কোনো বিষয় নয় বলেই ইনকিলাবের মতো জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের বিবেচ্য বিষয় হওয়ার কথা নয়। দেশ- জাতির আবেগ-ঐতিহ্য, মর্যাদা-স্বার্থ সমুন্নত রাখার প্রশ্ন যেখানে- সেখানে অন্য কোনো বিবেচনা ইনকিলাব-এর কোনো বিচলন ঘটাতে পারেনি। মানব জীবন থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের জীবন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে নানা কারণে চড়াই-উৎরাই বা টানাপড়েন দেখা দিলেও লক্ষ্য ঠিক থাকলে যাত্রা থেমে থাকে না।
তিন যুগের শেষ বছরে ইনকিলাব আজ যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সময়ানুগ পরিবর্তন- তথ্যপ্রযুক্তিগত পরিবর্তন ঘটেছে আরও ঘটবে। এসবের মধ্য দিয়ে উপর-কাঠামোগত পরিবর্তন অবশ্যই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে এবং আরও হবে। তবে এর আত্মগত যে বোধ-চেতনা, নৈতিক নির্দেশনা বিশেষ করে দেশ-জাতি-জনগণের আবেগ-আকাক্সক্ষাজাত যে চাহিদা- এই সব আত্মিক বিষয়ে গণমুখিনতা থেকে ইনকিলাব বিযুক্ত হতে পারবে না। দৈনিক ইনকিলাবের সম্মানিত সম্পাদক প্রিয়জন জনাব এ এম এম বাহাউদ্দীনকে ১৯৮৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সম্পাদকীয় কর্মকান্ডে যতটুকু দেখেছি-বুঝেছি তাতে এই কথা বলা যায়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই শুভদিনে ইনকিলাবকে অশেষ অভিনন্দন। ইনকিলাব-এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আন্তরিক অভিনন্দন- মেধাবী সম্পাদক প্রিয়জন এ এম এম বাহাউদ্দীনকে, যিনি সহজাত মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে ইনকিলাবকে ৩৬ বছর বা তিন যুগে নিয়ে এসেছেন। কোনো সম্পাদক এত দীর্ঘ সময় একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক সম্পাদনা করেছেন, দায়িত্বে অবিচল থেকেছেন, এটা বিরল নজিরই বলতে হয়। ইনকিলাব এই সময়ের মধ্যে দেশ-জাতির চাহিদার নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিক হিসেবে ভূমিকা পালনের পাশাপাশি প্রচার সংখ্যায় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করার গৌরবও অর্জন করেছে, আর তা করেছে একবারে প্রতিষ্ঠার পরপরই।
আজাদ-ইত্তেফাক-ইনকিলাব- এই তিনটি জাতীয় দৈনিককে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এধরনের জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের ভূমিকার বিবেচনা-মূল্যায়ন করতে হবে। ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর আজাদের প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা থেকে, আর এর ঠিক অর্ধ শতক পর ১৯৮৬ সালের ৪ জুন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় দৈনিক ইনকিলাব।
ইনকিলাব শুরুর সময়- ১৯৮৬ সালে আমার বয়স ছিল ৩৮ বছর আর আজ আমার বয়স ৭৩ বছর। পরিকল্পনাকালীন সময় থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বেশি সময়, সবচেয়ে আনন্দময় সুন্দর সময় আমি কাটিয়েছি দৈনিক ইনকিলাব-এ। সম্মানিত সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন সাহেবের অশেষ সহযোগিতা এই দীর্ঘ কর্মকালে আমাকে বরাবর উদ্দীপ্ত রেখেছে, আজকের এই দিনে অপরিমেয় আনন্দের সাথে এই কথাটি উল্লেখ করছি।
আলহামদুলিল্লাহ। দৈনিক ইনকিলাব আজ ৩৬ বছরের যাত্রা শুরু করল, মহান আল্লাহ সহায় হোন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন