সংবাদপত্রজগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল ‘ইনকিলাব’। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, বৈচিত্র্যময় ফিচার, সময়োপযোগী কলাম ও দুঃসাহসী সম্পাদকীয়ের কল্যাণে দৈনিক ইনকিলাব স্বল্প সময়ের মধ্যে পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পত্রিকাটির জন্য ছিল বাড়তি আকর্ষণ। তখন ফটোকম্পোজ ছিল মুদ্রণ শিল্পের নতুন সংযোজন, যা এদেশে ইনকিলাবই প্রথম ব্যবহার করেছিল। শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর ভর করে একটি সুদক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী মাঠে-ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিভাগীয় শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে স্থাপন করা হয়েছিল নিজস্ব অফিস। প্রতিটি জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায় প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ইনকিলাবের সুযোগ্য সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন পত্রিকার সিনিয়র-জুনিয়র সবার সঙ্গে গড়ে তোলেন ব্যতিক্রমী এক চমৎকার সম্পর্ক। পত্রিকার কর্মপরিবেশ হয়ে উঠে অনন্য সুন্দর।
পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ মাওলানা এম এ মান্নান। ইনকিলাবে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের ছায়া। ১৯৮৬ সালের ৪ জুন পত্রিকা প্রকাশের আগে তিনি কয়েক বার নীতিনির্ধারণী বৈঠক করেন সবার সঙ্গে। বছরে তিন-চারবার তিনি বিভিন্ন উপলক্ষে বৈঠক করতেন। বৈঠক শেষে থাকত খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। তিনি নিজে খেতে পছন্দ করতেন এবং অন্যকে খাওয়ানোর মাঝে পরম তৃপ্তিবোধ করতেন। প্রতিবারই খাবার ম্যানুতে থাকত বিশেষ বিশেষ চমক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সামাজিক সংগঠনের কর্ণধার, আলেম-ওলামা, শিক্ষাবিদ ও আমলাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে আসতেন। তিনি তাদের আপ্যায়ন করতেন রাজকীয়ভাবে, খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে। মেহমানদারিতে তিনি ছিলেন অনন্য, অসাধারণ।
১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসের কোনো একদিন বনানী ১০ নম্বরে ইনকিলাবের অস্থায়ী কার্যালয়ে একটি বৈঠকের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। তখন পত্রিকার ডামি প্রকাশে ইনকিলাব কর্মীগণ সবাই ব্যস্ত। আমরা সবাই ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। তাঁর পাশেই বসা ছিলেন সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, মহাসম্পাদক এ কে এম মহিউদ্দিন, নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা রূহুল আমীন খান, ফিচার সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গফুর ও বার্তা সম্পাদক সুলতান আহমদ। আমরা শ্রোতার সারিতে। নীতিনির্ধারণী বৈঠক সবার কাছেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পিনপতন নিস্তব্ধতা। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বৈঠকের সূচনা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মাওলানা মান্নান সাহেবকে আমরা সবাই ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করতাম। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি সবাইকে স্বাগত জানান এবং সবাইকে ইনকিলাব পরিবারের সদস্য বলে উল্লেখ করেন। তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তিনি তাঁর কথা স্পষ্ট করেই বলেন। আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে অর্থের ব্যাপারে কাউকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমরা পত্রিকা দিয়ে কোনো ব্যবসা করতে আসিনি। জাতীয় দায়িত্ব পালন করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আপনারা কে কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাসী এটাও আমার কাছে বিবেচ্য নয়। বস্তুনিষ্ঠ খবর দেবেন, এখানে নিজের রাজনৈতিক মতামতটা জুড়ে দেবেন না। এখানে কোনো আপোস নেই। দেশ ও দেশের জনগণের অন্তরের যে আকাক্সক্ষা এটাই আমাদের পত্রিকার সত্যিকারের নীতি ও আদর্শ। কোনো ধর্মকেই কটাক্ষ করা চলবে না। আপনারা যে যে ইউনিয়নের সদস্য, সেই ইউনিয়নের সঙ্গেই নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকুন, সকলের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক থাকা জরুরি। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে আমরা বিশেষ কোনো ইউনিয়নের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করব না।’
মাওলানা এম এ মান্নান তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করে বলেন, ‘তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। সর্বক্ষেত্রে তাকে সম্মান করতে হবে। আকারে-ইঙ্গিতেও তাঁকে কটাক্ষ করা চলবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁকে সব সময় সর্বোচ্চ আসনে স্থান দেবেন।’ মাওলানা মান্নান সাহেব এ সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতির কথাও উল্লেখ করেন। তিনি এই বৈঠকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ব্যাপারেও সব সময় সবাইকে সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের নির্দেশনা দেন। তিনি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ জাতীয় নেতাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। তিনি দুই নেত্রী- শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার নিউজকে সমগুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা দেন।
আমি দীর্ঘদিন দৈনিক ইনকিলাবে চাকরি করেছি। স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি ও চিফ রিপোর্টার পদে কাজ করে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আগেই বলেছি, মাওলানা এম এম মান্নান সাহেব বছরে কয়েকবার আমাদের সবাইকে নিয়ে বৈঠক করতেন। একদিনের একটি বৈঠকের কথা এখনও মনে পড়ে। তিনি তখন এইচ এম এরশাদ সাহেবের মন্ত্রিসভার সদস্য। একই সঙ্গে দুই-দুইটি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী। সম্ভবত ১৯৮৭ সাল। তিনি তখন ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তিনি ঐ সময়ে ইনকিলাবের এক ঘরোয়া বৈঠকে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘যিনিই দেশের প্রেসিডেন্ট তাঁকে তো সম্মানের আসনে রাখতে হয়। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সমালোচনা করে লিখুন। কিন্তু তাঁর বক্তৃতার নিউজটা তো একটু ভালো করে দিতে পারেন।’ উল্লেখ্য, ইনকিলাবে আমরা যারা তখন কাজ করি, তাদের প্রায় সবাই ছিলাম স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য। স্বয়ং সম্পাদক সাহেবও গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। মাওলানা মান্নান সাহেবকে নিউজে কখনো হস্তক্ষেপ করতে দেখিনি।
এবার অন্য প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি। দৈনিক ইনকিলাব যখন বাজারে আসে, তখন একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের। ইত্তেফাকের সার্কুলেশন ছিল সর্বোচ্চ। সর্বস্তরের মানুষের প্রিয় ছিল ইত্তেফাক; আর্থিকভাবেও ছিল অনেক শক্তিশালী। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল দৈনিক সংবাদ। বামপন্থী চিন্তাধারার মানুষের কাগজ হিসেবে পরিচিত সংবাদের সঙ্গে প্রগতিশীল পত্রিকার তকমা যুক্ত ছিল। আরেকটি মানসম্মত পত্রিকা ছিল দৈনিক বাংলা। সরকারি ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকাটির সার্কুলেশন ছিল মানের তুলনায় খুবই কম। আর যে কয়েকটি পত্রিকা ছিল সেগুলো ততটা প্রভাবশালী ছিল না। এই পরিস্থিতিতে দৈনিক ইনকিলাবের সাহসী ভূমিকা, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জনপ্রিয় কলাম এবং বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন পাতা পাঠককে চুম্বকের মতো কাছে টেনে আনে। অল্প সময়ে এত পাঠকপ্রিয়তা অন্য কোনো পত্রিকা এর আগে আর পায়নি। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটা একটি রেকর্ড। দীর্ঘ সময় ইনকিলাব তার এই ধারা বজায় রাখতে পেরেছিল, যদিও পরবর্তীতে দেশে কয়েকটি পত্রিকা ভালো সার্কুলেশন পেয়েছে। যেমন- যুগান্তর, জনকণ্ঠ, সমকাল, প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটির জনপ্রিয়তা ওঠা-নামা করেছে।
ইনকিলাব এত অল্প সময়ে কেন পত্রিকা জগতে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল, তা আজও অনেকের কাছে বিস্ময়। ‘ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’- ইনকিলাবের অন্তর্নিহিত সম্পাদকীয় নীতি হলেও সর্বস্তরের মতাদর্শের সংবাদিকদের সম্মিলিত প্রয়াসে পত্রিকাটি সর্বমহলের প্রিয় পত্রিকায় পরিণত হতে পেরেছিল। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির পাশাপাশি নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মীদের নিরলস পরিশ্রমের ফসল ছিল ইনকিলাব। বিশেষ করে, কর্মীবান্ধব সম্পাদক বাহাউদ্দীন ভাইয়ের দিকনির্দেশনা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছিল ভিন্ন মাত্রায়। সর্বোপরি আলহাজ মাওলানা এম এ মান্নান সাহেবের ছায়া-শীতল বড় হৃদয়ের স্পর্শ সবাইকে কর্মে উৎসাহী করে তুলেছিল। নিয়মিত বেতন-ভাতার পাশাপাশি কর্মীদের যে কোনো বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর উন্নত মানসিকতা মালিকপক্ষের অতি কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল সংবাদকর্মীদের। বছরে তিনটি বোনাস, অডিটফিট অ্যালাউন্স এবং তিন বছর অন্তর বেসিকের সমপরিমাণ ভাতাসহ বিনোদন ছুটি ইত্যাদি ছিল সাধারণ বিষয়। এছাড়া বাহাউদ্দীন ভাই প্রতি বছর বিভিন্ন সরকারি ছুটিতে ক্রিকেট, ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করতেন। তিনি আয়োজন করতেন পিকনিকের। সংবাদকর্মীদের পরিবার-পরিজনও এসব পিকনিকে আমন্ত্রিত হতেন। এত আন্তরিক পরিবেশ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে দেখা যেত না। এই পত্রিকায় কাজ করার সময়ই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি। বাহাউদ্দীন ভাই আমাকে উচ্চ শিক্ষায় যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তা কোনো দিন ভুলে যাওয়ার মতো নয়। বিশেষ করে, আমি যখন পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি তখন তিনি এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম। শুধু এককথায় বলা যায়, ভালোবাসার এই ঋণ জীবনে কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করার সুযোগ নেই। আমার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন উপলক্ষে ইনকিলাব ভবনে আমাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছিল। আমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ আমাদের নানা রকম উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়েছিল। গরু জবাই করে গোটা অফিসের সবাইকে বিশেষ ভোজের আয়োজন করে খাওয়ানো হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মাওলানা এম এ মান্নান গুরুতর অসুস্থ থাকা সত্তে¡ও শুধু আমাকে দোয়া করার জন্য ইনকিলাব ভবনে এসেছিলেন। হুজুর এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে, তাঁকে বড় একটি চেয়ারে বসিয়ে কয়েকজন মিলে দু’তলায় উঠিয়েছিলেন। এ অনুষ্ঠানে বাহাউদ্দীন ভাই ছাড়াও তাঁর ছোট ভাই ইনকিলাবের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন, সাবেক মন্ত্রী ইনকিলাবের উপদেষ্টা আনোয়ার জাহিদসহ সংশ্লিষ্ট সবাই উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছিলেন আমার প্রিয়জন স্পোর্টস এডিটর রেজাউর রহমান সোহাগ।
ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠালগ্নে ডিইউজে এবং বিএফইউজে ছিল ঐক্যবদ্ধ। নির্বাচনের সময় দু’টি ফোরামে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতেন সংবাদিক নেতৃবৃন্দ। এক পক্ষে থাকতেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাংবাদিকগণ, অন্য পক্ষে বিএনপি সমর্থিত সাংবাদিকগণ। বামপন্থী সাংবাদিকগণ কেউ এ পক্ষে, কেউ অন্য পক্ষে। তখন প্রতিযোগিতা থাকলেও সব পক্ষের মধ্যেই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, পরস্পরের প্রতি ছিল শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। ইনকিলাবের আপদ-বিপদে উভয় পক্ষের নেতৃবৃন্দই ছুটে আসতেন। গিয়াস কামাল চৌধুরী, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ জাফর, আমানুল্লাহ্ কবীর, আবেদ খান যেমন ইনকিলাব ভবনে আসতেন, ঠিক তেমনি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহজাহান মিঞা, আবুল কালাম আজাদ, আকরাম হোসেন খানের মতো নেতারাও আসতেন। এরশাদ সাহেব প্রেসিডেন্ট থাকার সময় একবার ইনকিলাব বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন উভয় ফোরামের নেতৃবৃন্দ বৈঠক করে ইনকিলাব বন্ধের প্রতিবাদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে সারাদেশে সকল পত্রিকায় ধর্মঘট পালন করেছিলেন। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই সর্বাত্মক ধর্মঘটের পর এরশাদ সাহেব ইনকিলাব বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
মাওলানা এম এ মান্নান ইনকিলাবে কর্মরত সাংবাদিকদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। বাহাউদ্দীন ভাইও সবাইকে আপন করে নেন। তিনি তাঁর চেয়ে বয়সে একটু বড় সাংবাদিকদের ‘ভাই’ সম্বোধন করেন। বয়সে যারা সমসাময়িক ও ছোট তাদের সঙ্গেও তিনি আন্তরিক ও সম্মানজনক আচরণ করেন। তিনি ক্রীড়ামোদি ব্যক্তিত্ব। মোহামোডান স্পোর্টিং ক্লাব তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান। আশির দশকে ফুটবল ছিল খুবই জনপ্রিয় খেলা। মোহামেডান জয়ী হলে বাহাউদ্দীন ভাইয়ের উদ্যোগে ইনকিলাবে বিরিয়ানির উৎসব হতো। মোহামেডান পরাজিত হলে তাঁর মন খারাপ; কিন্তু ইনকিলাবে খাওয়া বাদ যেত না।
নানা উপলক্ষে ইনকিলাব ভবন হয়ে উঠত উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবেশটা থাকত সবসময় কর্মীবান্ধব। বাহাউদ্দীন ভাই তাঁর চিন্তা ও সিদ্ধান্তে অটল থাকা মানুষ। ভুল হোক শুদ্ধ হোক- তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকতেন। তথাপি আমি লক্ষ করেছি, তিনি মানুষ হিসেবে অনেক উদার। ভিন্ন চিন্তা ও পরমতসহিষ্ণু একজন ব্যক্তিত্ব। ভিন্ন মতকেও তিনি শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে অভ্যস্ত। আমি যখন ইনকিলাবে চাকরি করি, তখন সেখানে ইউনিয়নের দুই ফোরামের সাংবাদিকগণই সক্রিয় ছিলেন। ইউসুফ শরীফ, নূরুদ্দীন ভূঞা, সাইফুল আলম, জাকারিয়া কাজল, নাঈমুল ইসলাম খান, কে এম সাদেকুল হক, রবিউল্লাহ রবি, বাবলু রহমান, সাজ্জাদ আলম খান তপু, মোহাম্মদ আলম, শামীম সিদ্দিকীসহ বেশ কিছু সাংবাদিক আওয়ামী লীগ সমর্থক ফোরামের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। অন্যদিকে মঞ্জুরুল আলম, মুনশী আবদুল মাননান, মাসুদ নিজামী, এলাহী নেওয়াজ খান সাজু, সৈয়দ মেসবাহ উদ্দিন, কবি আবদুল হাই শিকদার, রাশিদ-উন নবী বাবু, আবদুল আউয়াল ঠাকুর, এম আবদুল্লাহ্ প্রমুখ বিএনপি সমর্থক ফোরামে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাহাউদ্দীন ভাইয়ের কাছে কিংবা হুজুরের কাছে তাদের সবাই আপন মানুষ হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। এসব কারণেই ইনকিলাব সর্বজনস্বীকৃত একটি শক্তিশালী হাউজে পরিণত হয়েছিল।
একটি হাউজের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশের কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। কিন্তু একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয় হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার সম্পাদকীয়নীতি। সত্য উচ্চারণে বলিষ্ঠতা এবং সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতায় একটি পত্রিকাকে পাঠক তাঁর নিজের কাগজ হিসেবে বিবেচনা করে। ইনকিলাবের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছিল। স্পেশাল রিপোর্ট এবং তথ্যবহুল ও যুক্তিনিষ্ঠ কলাম ইনকিলাবকে এক উচ্চ মাত্রা দান করেছিল। তখন এমন সব এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট ইনকিলাবে ছাপা হতো, যাতে মিডিয়া জগতে তোলপাড় সৃষ্টি হতো। এমন অনেক রিপোর্ট ইনকিলাবে প্রথম ছাপা হতো, দেখা যেত, পরের দিন অন্যান্য পত্রিকা তার ফলোআপ রিপোর্ট ছাপিয়েছে। ইনকিলাবে এমনি শক্তিশালী একটি টিমওয়ার্ক কাজ করত। ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন মতাদর্শের হলেও সাংবাদিক হিসেবে এখানে সবাই ছিলেন বস্তুনিষ্ঠ, সৎ ও পেশাদার। মোট কথা, দেশ ও দেশের জনগণের মনোজগতকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল বলেই ইনকিলাব সংবাদপত্র জগতে কার্যত এক বিপ্লবের সূচনা করেছিল।
নানা রকম চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দৈনিক ইনকিলাব ৩৬তম বর্ষে পদার্পণ করছে। হাজারো সমস্যা এবং ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আজও আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে। ‘দেশ ও জনগণ’ ইনকিলাবের প্রাণশক্তি। চিরজীবী হোক দৈনিক ইনকিলাব, এই আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা। এই প্রতিষ্ঠানের সাথে অনেকে জড়িত ছিলেন, তাঁদের অনেকে আজ দুনিয়াতে নেই; মহান আল্লাহর কাছে তাঁদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। প্রতিষ্ঠাকালে জড়িতদের অনেকে এখন ইনকিলাব নেই, কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সম্মানজনক অবস্থায় রয়েছেন। প্রতিষ্ঠাকালীন কিছু সহকর্মী আজও ইনকিলাবে আছেন এবং পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছেন যারা, তারা সবাই মিলে ইনকিলাবের ঝান্ডা উড্ডীন রেখেছেন। তাঁদের সবাইকে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
লেখক: হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন। সাবেক চিফ রিপোর্টার, দৈনিক ইনকিলাব। সাবেক মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন