বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দ্বিন, আধ্যাত্মিক জগতের সু-উচ্চ মকামের অধিকারী, পবিত্র কুরআন-হাদীস, ফেকাহ উসুল মানতেক সহ সর্বাধিক জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভান্ডার, সুন্নীয়ত তথা মসলকে আলা হয’রত নীতি আদর্শ বাস্তবায়নের পথিকৃৎ ৩৮ তম আউলাদে রসুল (দঃ) লক্ষ লক্ষ মুরীদ, ভক্ত-অনুরক্ত সুন্নী জনতার প্রানপ্রিয় পরম শ্রদ্ধাস্পদ মুর্শিদে বরহক হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রঃ) এর ৬২তম সালানা ওরছ মুবারক ১১ জিলক্বদ ১৪৪২ হিঃ (২৩ জুন ২০২১ খ্রীঃ) অনুষ্ঠিত হবে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট এর উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হবে। এই মহান বরকতময় দিবসে ফয়ুজাত হাসিলের উদ্দেশ্যে হুজুরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও কার্যক্রম উপস্থান করা হল।
পাকিস্তানের হাজারা জিলার হরিপুর (সেতালু শরীফ) ছিরিকোট এর নবী বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ১৮৫৭ সালে আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ সদর শাহ্ (রহঃ) ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন জমানার গাউস হযরত আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি (রহঃ)। জন্ম সূত্রে তিনি হযরত সৈয়দ ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ হযরত সৈয়দ জালাল আর রিজাল (রঃ) এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
ব্রিটিশ ভারতে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৭ হিজরীর (১৮৮০ সালের কোন এক তারিখে) শাবান মাসে তাঁকে মমতাজুল ‘মুহাদ্দেশীন’ সনদ প্রদান করে দস্তারে ফজিলত প্রদান করা হয়। শিক্ষা সমাপনান্তে তিনি আপন মাসওয়ানী সৈয়দ বংশের এক বিদুষী মহিলা সৈয়দা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পূর্ব পুরুষের অনুসরনে কিছুদিনের মধ্যে ইসলাম প্রচারের মহৎ উদ্দেশ্যে দঃআফ্রিকা গমন করেন। কেপটাউন, জাঞ্জিবার, মোম্বাসা প্রভৃতি এলাকায় তিনি ব্যবসা করার সাথে সাথে ইসলাম প্রচারে ব্রতী হন। চরম বর্ণবাদের শিকার বহু কালো মানুষ হজুর কিবলার হাতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, দেখা যায় যে, একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী উনাবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে (সিরিকোটি (রহঃ) ইসলাম প্রচার ও মসজিদ নির্মাণের উদ্যোক্তা ছিলেন। হুজুরের জ্ঞাতিভাইয়েরা বংশ পরায়ু স্থায়ীভাবে বসবাস করে ঐ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন অদ্যাবধি।
তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করে (১৯১১-১২ই) ইংরেজী। ব্যবসা বাণিজ্য ধর্ম প্রচার কোন কিছুতেই মনঃস্থির করতে পারছিলেন না। কি এক অজানা অপ্রাপ্তি তাঁকে অস্থির করে তুলছিল। তাঁর বিদুষী স্ত্রী এ রকম উদাসীনতা অস্থিরতা লক্ষ্য করে হরিপুরের চৌহর শরীফের মসহুর অলী হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রঃ)‘র দরবারে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করার পরামর্শ দেন সিরিকোটি (রঃ) কে। এক সময় তিনি হরিপুর বাজারে কাপড়ের দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর তিনি একদিন সত্যি সত্যিই চৌহর শরীফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। চৌহরভী (রঃ)‘র হুজরার সন্নিকটে একজন নূরানী চেহারার ব্যক্তির সাথে দেখা হয়ে যায়। সিরিকোটি (রঃ) ঐ ব্যক্তির নিকট খাজা আবদুর রহমান (রঃ)’র অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ভদ্রলোক উল্টো বললেনঃ ও তাহলে তুমি এসে গেছো, স্ত্রী সাহেবান পাঠিয়েছেন তোমাকে। গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী চৌহরভী (রঃ) না বলা কথা ফাঁস করে দেয়ার মতো অদৃশ্য জ্ঞানের এ মানুষটিই একজন কামেল পুরুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ কথা ভাবতে না ভাবতেই বৃদ্ধ লোকটি কাল বিলম্ব না করে বললেন তিনিই খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রঃ)। সিরিকোটি (রঃ) পাথর কেন সংগ্রহ করছেন জানতে চাইলে চৌহরভী (রঃ) বলেন, একটা মসজিদ নির্মাণ করার জন্য পাথর সংগ্রহ করছিলাম। এ কথা শুনে সিরিকোটি (রঃ) চৌহরভী (রঃ) হাতে মসজিদ নির্মানের জন্য কিছু টাকা প্রদান করলেন। টাকা গ্রহণ করে চৌহরভী (রঃ) হাত তুলে অনেকক্ষণ দোয়া করলেন। সিরিকোটি (রঃ) কি করেন জানতে চাইলে হুজুর বললেন হরিপুর বাজারে একটি কাপড়ের দোকান রয়েছে। চৌহরভী (রঃ) এ কথা শুনে উৎফুল্ল চিত্তে বলে উঠলেন, আমি সবাইকে বলে দিব হরিপুর বাজারে আমার একটা কাপড়ের দোকান আছে। তোমরা ঐ দোকান হতে সওদা করো। কি অদ্ভুত ব্যাপার! সিরিকোটির দোকানের মালিক বনে গেলেন চৌহরভী (রঃ)। ক্ষনিকের সংক্ষিপ্ত কথোপকোথনে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হলো, একদিকে এলমে লুদুন্নীর প্রস্রবন “আল্লাহ প্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞানের ভান্ডার” অপরদিকে জাহেরী ইলমের জ্ঞানের ভান্ডার। অতএব চতুস্কনের সাথে লোহার আকর্ষণ শুরু হয়ে গেল।
সিরিকোটি (রঃ) হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভীর (রহঃ) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে মুর্শিদের খেদমতে সমর্পিত হয়ে গেলেন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একজন জ্ঞানী আলেম মুরীদকে পেয়ে অন্যান্য মুরীদ ভক্তগণ খুবই উৎফুল্ল হলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই মুর্শিদ হুকুম করলেন, মুরীদ মাওলানাকে লঙ্গরখানার জন্য বন থেকে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে। এরকম একজন খ্যাতনামা মাওলানাকে এ রকম কষ্টসাধ্য কাজের নির্দেশ দেয়ায় অন্যান্য মুরীদানগণ অবাক হলেন, তা ছাড়া এ কাজটা মানান সই নয়। মাওলানা সাহেব নির্বিকার, নির্দেশ পালনে বদ্ধপরিকর। কারণ এ কাজের মধ্যে নিশ্চিত রহষ্যের কথা হুকুমদাতা ও নির্দেশ পালনকারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্তরের অন্তরস্থ তার বিহীন সংযোগে তোল পাড় শুরু হয়। পাথুরে পাহাড়ে কাঠ পাওয়া যায় না বিধায় বহুদুর হতে কাঠ সংগ্রহ করে মাথায় বোঝা বহন করে বহু বছর পর্যন্ত হুকুম সিরিকোটি (রহঃ) পালন করেছেন। একদিন অকস্মাৎ পীর সাহেব কেবলা কাঠ সংগ্রহ বন্ধ করার আদেশ দিলেন। সিরিকোটি (রঃ) হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এ আদেশ কেন? কোথাও কি কোন ভুল হয়ে গেছে? মুরীদের নিবিষ্টমনের খেদমতে মুর্শিদ প্রফুল্ল চিত্তে এ নির্দেশ প্রদান করেছেন, তা পরবর্তী নির্দেশনায় পরিস্ফুট হয়েছে। যথারীতি খেলাফতের মতো মহান সোপানে অধিষ্ঠিত করে বার্মার রাজধানী রেংগুন (ইয়াংগুন) গিয়ে দ্বিন ইসলামের খেদমত আঞ্জাম দেয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রিয় মুরীদ সিরিকোটি (রঃ) নির্বিধায় নিশ্চিত মনে পীরের নির্দেশ শিরোধার্য করে অচেনা, অজানা গন্তব্যস্থানে চার হাজার মাইল দূরের রেংগুনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান পরিবার সংসার চেনাজানা সকলকে অবাক করে।
রেংগুনে পৌঁছে বাঙালী মসজিদে পেশ ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব নিয়ে দ্বিন ইসলাম মজহাব, মিল্লাত ,শরীয়ত, তরীকত ভিত্তিক ওয়াজ- নসিয়ত শুরু করেন। পান্ডিত্যপূর্ণ ও যৌক্তিক বিশ্লেষন ধর্মী বয়ান মুসল্লীদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দুর-দুরান্ত থেকে মুসল্লীরা হুজুরের ইমামতিতে নামাজ আদায় ও ইসলামী বয়ান শোনার জন্য জমায়েত হয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। পীরের তাওয়াজ্জুহ পাওয়া নবী সন্তান সৈয়দ আহমদ শাহ (রঃ)’র অনেক কেরামত সে-সময়ে প্রকাশ পায়। মুসল্লীদের বাইয়াত হবার জন্য পুনঃপুনঃ আবেদন-অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে এর একটা সমাধান দেয়ার জন্য পীরের (চৌহরভী (রঃ) নিকট পত্র লেখেন সিরিকোটি (রঃ)। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রঃ) একখানা রুমাল সমেত পত্রোত্তরে সৈয়দ আহমদ শাহ কে রুমালের এক প্রান্ত নিজ হাতে ও অপর প্রান্ত মুসল্লীদের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে মাশায়েখ কেরামের পক্ষ হতে প্রদত্ত ছবক সহকারে বাইয়াত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। জেনে রাখা ভাল খেলাফত পেলেই বাইয়াত করানো যায়না, যতোক্ষন মুর্শিদের হুকুম না হয়। বর্তমানে দেখা যায় অনেকে খেলাফতের সীল ছাপ্পর মেরে সাজ্জুাদানসীন হয়ে বা খলীফা বনে বাইয়াত শুরু করে দেন (নাউযুবিল্লাহ)। এ সকল কার্যকলাপে তথাকথিত পীরদের কারনে তরীক্বতের মূল উদ্দেশ্যের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। একধরনের আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে। সমাজে ধর্মে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। অলী, মুর্শিদ, খেলাফত, বাইয়াত এ সব অতীব সুক্ষ্য ব্যাপার। দাঁড়ি, টুপি, আলখাল্লা, পাগড়ি, অলী বা মুর্শিদ হবার মাপকাঠি নয়। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। শত শত মুসলèী সরল প্রাণ মুসলমান হুজুরের হাতে বাইয়াত গ্রহন করে মনের তৃপ্তি মেঠান। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রঃ) পত্র সমেত ত্রিশপারা দূরুদ সম্বলিত মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রছুল (দঃ) শিরোনামের একটি অমুল্য ও অদ্বিতীয় গ্রন্থ সিরিকোটি এর নিকট পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন রেংগুনের ভাইদের সহায়তায় ছাপিয়ে মখলুকাতের উপকারার্থে প্রচার করা এবং সাথে সাথে হরিপুরস্থ দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার দ্বিতল ভবন নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে পাঠানোর জন্য একটি কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়ে সতর্ক করেন যে, যতোদিন এ ২টি কাজ সম্পন্ন না হবে ততোদিন সিরিকোটি (রঃ) রেংগুন ত্যাগ করতে পারবেন না। এ কাজসমূহ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১৬ বছর সৈয়দ আহমদ শাহ (রঃ) রেংগুন ছেড়ে যাননি পীরের নির্দেশের কারনে।
লেখক- প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাষ্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন