আমাদের দেশে যত সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে অন্যতম মানব পাচার। এটি একটি বৈশি^ক সমস্যা। এ সমস্যার অন্যতম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ এখন স্বল্পউন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। অথচ সোমালিয়া কিংবা সুদানের তরুণদের মতো কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে হাজারো তরুণ উন্নত বিশ্বের পথে পাড়ি দিচ্ছে। দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কারও কারও সলিল সমাধি হচ্ছে। স্বপ্ন দেখা অপরাধ না। কিন্তু দুঃস্বপ্নে বিভোর হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ, আমেরিকার পথে যাওয়া উচিৎ নয়। কেউ কেউ ভাবে ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশে কোনোভাবে যেতে পারলে ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। কারও কারও ভাগ্যে হয়তো সেটি হচ্ছে। কিন্তু দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। অনেকের ঠিকানা হচ্ছে জেল। শতশত মানুষ দালালদের খপ্পরে জমিজমা, ভিটেবাড়ি বিক্রি করে শেষ সম্বলটুকু তাদের হাতে তুলে দিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। অনাহারে বনজঙ্গলে কাটছে তাদের দুর্বিসহ জীবন। কারও খোঁজ মিলে না। দালালরা অনেককে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে। ওইসব তরুণরা না পারছে দেশে ফিরতে, না পারছে বিদেশের মাটিতে টিকে থাকতে।
করোনায় যখন উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিপর্যস্ত, তখন বাংলাদেশের মানবপাচারের ঘটনা দেশ ও বিশে^র গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে ঘরে ঘরে চাকুরী দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এ কাজটি করতে পারলে মানবপাচার কিছুটা হলেও কমতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যত কৌশল অবলম্বন করা হয় তার কিছুটা যদি মানবপাচার বন্ধে কাজে লাগানো হতো, তাহলে বিদেশের মাটি থেকে লাশের কফিন এভাবে আসতো না। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতের একটি আদালত তাকে চার বছরের কারাদন্ড দিয়েছে। বাংলাদেশের কোন এমপির বিরুদ্ধে এটাই প্রথম বিদেশের আদালতে সাজা হওয়ার ঘটনা। এ লজ্জা শুধু আওয়ামী লীগের নয়, গোটা জাতির। একটি অপরাধ হাজারো অপরাধের জন্ম দেয়। অপরাধ অপরাধই। খুন, গুম, ধর্ষণ, ব্যাংক লুট, করাও অপরাধ। টাকা পাচার, মানবপাচারও অপরাধ। আমরা যেন এখন অপরাধের বৃত্তে আটকে গেছি। এই বৃত্তের অপসারণ করতে না পারলে সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে।
গত ৫০ বছরে বহুবার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। কেউ ক্ষমতা পেয়েছে, কেউ হারিয়েছে। কিন্তু জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। যদিও ক্ষমতার পালাবদলে জনগণের মূখ্য ভূমিকা ছিল। কিন্তু সে অধিকার আজ নেই বললে চলে। অথচ এদিকে কেউ নজর দিচ্ছে না। উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে পরিচিত যেসব দেশ, সেসব দেশে উন্নয়ন কার্যক্রম একদিনে শুরু হয়নি। উন্নয়ন কখনোই শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে পারে না। অর্থনীতির সাথে মৌলিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকারের উন্নতি মিলেই উন্নয়ন হয়। এখন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে কিছু অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ইত্যাদির মাধ্যমে। এগুলো দেখে আমরা অনেকে আত্মহারা। ভাবছি, দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। অথচ উন্নয়নের নামে হাজারো কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। এ দিকটি খেয়াল করা হচ্ছে না। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে সরকার উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করলেও শেষপর্যন্ত ঋণের বোঝা কিন্তু জনগণের কাঁধেই পড়ে। বর্তমানে মাথাপিছু ঋণ প্রায় ৮৫ হাজার টাকা। ফলে আজ যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করবে, তার মাথায়ও এই ঋণের দায় চাপবে। বাজেটের আয়তন বছরের পর বছর বেড়েছে। কিন্তু জনগণ কী এর সুফল পাচ্ছে? সুফল পেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তরুণরা উন্নত জীবনের আশায় সাগর পথে পাড়ি দিতো না। যে উন্নয়ন শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্যে হয় সেটাকে উন্নয়ন বলি কী করে? উন্নয়ন হয়নি সেটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু উন্নয়নের নামে কত বন উজাড় হলো, কত নদী বিনাশ হলো, বাতাস কত দূষিত হলো, কত মানুষ সাগরে ডুবে মরলো, কত টাকা বিদেশে পাচার হলো, নাগরিকদের বঞ্চনা ও বৈষম্য কত প্রকট হলো এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খোঁজা জরুরি। যখন একটি রাষ্ট্র নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য, কলকারখানার শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি ও নিরাপত্তা, শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থান করতে পারে না; তখনই কেবল জীবিকার খোঁজে অবৈধ পথে পাড়ি জমায় মানুষ। লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় খঁজছে কেন, তা রাষ্ট্রের খতিয়ে দেখা উচিৎ। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করা হতো তাহলে অবৈধভাবে তরুণরা বিদেশে পাড়ি দিতো না। ভূমধ্যসাগর থেকে গত ১০ জুন ১৬৪ জন এবং ২৪ জুন ২৬৭ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড উদ্ধার করেছে। এশীয় উন্নয় ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ পাচার হয়। ইউএনডিপি বলছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ৩ লাখ ও তিন দশকে ১০ লাখ মানুষ পাচার হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে বিভিন্ন দেশের ৮১৩ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়। ইতালি যাওয়ার রুট মধ্যবর্তী ভূমধ্যসাগরীয় রুট হিসেবে পরিচিত। এই রুটে সবচেয়ে বেশি অভিবাসীর মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে এই রুটে ৯৮৩ জন এবং ২০১৮ সালে ২৩ শতাধিক অভিবাসীর মৃত্যু হয়। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ২০১৬ সালে। ওই বছর ৪ হাজার ৬শ’মানুষের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৯৪ জন অভিবাসীর মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং অন্তত ৫০ হাজার টাকার অর্থদন্ডের বিধান থাকলেও মানবপাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার উৎস প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ১০ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অর্থবছরের ১০ মাসে প্রবাসী রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অথচ যাদের ঘাম আর রক্তে উপার্জিত রেমিটেন্সে দেশীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, অর্থনীতির সোনার ডিম দেয়া সেই প্রবাসীদের মধ্যে গত ১০ বছরে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিকের লাশ বাংলাদেশে এসেছে। অথচ তাদের শ্রম-ঘামের মূল্যায়ণ হয়নি। বিদেশের মাটিতে আর কোনো বাংলাদেশীর দাসত্বের বন্দিজীবন, অনাহারে মৃত্যু, সাগরের নৌকায় ভাসমান মানবেতর জীবন, কবর থেকে উঠিয়ে আনা কংকাল কিংবা বিমানবন্দরে কফিনের মিছিল আমরা আর দেখতে চাই না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন