মহান আল্লাহ তায়ালার অপূর্ব সৃষ্টি এই বসুধা। মানুষের জন্য বৈচিত্রময় উপকারী উপকরণসমৃদ্ধ করে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃজন করেছেন। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনেই নিগূঢ় কোনো রহস্য বিদ্যমান আছে, আছে সৃষ্টিজগতের কোনো না কোনো শ্রেণির কল্যাণকামীতা। পৃথিবীতে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সৃষ্টিরাজি থেকে আল্লাহ তায়ালা মানব সন্তানকে শিক্ষা গ্রহণের আদেশ করেছেন। সৃষ্টির প্রতিটি অংঙ্গজুড়েই পৃথক-পৃথক শিক্ষা রয়েছে। রয়েছে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ ও তাওহিদের মহান শিক্ষা, ঈমান আনয়নের অফুরন্ত নিদর্শন। পানি-বৃষ্টি আল্লাহ তায়ালার মহান দান। পানিবিহীন পৃথিবীর অস্তিত্ব অকল্পনীয়। ধরাপৃষ্ঠের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়েই রয়েছে পানি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বৃষ্টির বিচিত্রময় দিক আলোচনা করেছেন। নিজের কুদরত, বরকত ও শক্তির কথা ঘোষণা করেছেন। এসব থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহ তায়ালার বন্দেগীতে পূর্ণ আত্মনিয়োগ করার প্রতি বিশ্ববাসীকে আহবান করেছেন।
(ক) জমিন জীবন্তকরণ, ফল উৎপাদন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তা ভারী মেঘমালাকে বয়ে নিয়ে যায়, তখন আমি তাকে কোনো মৃত ভূখন্ডের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাই, তারপর সেখানে পানি বর্ষণ করি এবং তা দ্বারা সর্বপ্রকার ফল উৎপন্ন করি। এভাবেই আমি মৃতদেরকেও জীবিত করে তুলব। হয়ত তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে।’ (সুরা আরাফ: ৫৭)
অপর আয়াতে বলেন, ‘তুমি ভূমিকে দেখ শুষ্ক, তারপর যখন আমি তাতে বারি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও বাড়-বাড়ন্ত হয়ে ওঠে এবং তা উৎপন্ন করে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ।’ (সুরা হজ: ৫)
আয়াত দুটি মৃত্যুর পর পুনর্জীবন দানের কথা প্রমাণ করছে। ভূমি শুকিয়ে গেল তা নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। জীবনের সব আলামত তা থেকে মুছে যায়। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে তার ভেতর নব জীবন সঞ্চার করেন। ফলে সেই নিষ্প্রাণ ভূমি নানা রকম বৃক্ষ-লতায় ভরে ওঠে, যা দেখে দর্শকের চোখ জুড়িয়ে যায়। যে আল্লাহ এটা করতে সক্ষম তিনি কি তোমাদেরকে পুনর্বার জীবন দান করতে পারবেন না? (তাওজিহুল কুরআন)
(খ) পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম।
পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের ভীতি দূর করার জন্য তোমাদেরকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করছিলেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর পানি বর্ষণ করছিলেন, তা দ্বারা তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের ময়লা দূর করার জন্য, তোমাদের অন্তরে দৃঢ়তা বাঁধার জন্য এবং তার মাধ্যমে (তোমাদের) পা স্থির রাখার জন্য।’ (সুরা আনফাল: ১১)
(গ) সবকিছু বিনাশকারী।
বর্ণিত হয়েছে, ‘সে বলল, আমি এখনই এমন এক পাহাড়ে আশ্রয় নেব, যা আমাকে পানি থেকে রক্ষা করবে। নুহ বলল, আজ আল্লাহর হুকুম থেকে কাউকে রক্ষা করার কেউ নেই, কেবল সেই ছাড়া যার প্রতি আল্লাহ দয়া করবেন। অতঃপর ঢেউ তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিল এবং সেও নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হল। (সুরা হুদ: ৪৩)
(ঘ) জাহান্নামের শাস্তির উপকরণ।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘বলে দাও, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তো সত্য এসে গেছে। এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা কুফর অবলম্বন করুক। আমি জালেমদের জন্য আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি, যার প্রাচীর তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। তারা পানি চাইলে তাদেরকে তেলের তলানী সদৃশ পানীয় দেওয়া হবে, যা তাদের চেহারা ঝলসে দেবে। কতই না মন্দ সে পানীয় এবং কতই না নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল!’ (সুরা কাহফ: ২৯)
(ঙ) পানি এক স্বাদ ভিন্ন।
ঘোষিত হয়েছে, ‘আর পৃথিবীতে আছে বিভিন্ন ভূখন্ড, যা পাশাপাশি অবস্থিত। আর আছে আঙ্গুরের বাগান ও খেজুর গাছ, যার মধ্যে কতক একাধিক কান্ডবিশিষ্ট এবং কতক এক কান্ডবিশিষ্ট। এসব একই পানি দ্বারা সিঞ্চিত হয়। আমি স্বাদে তার কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এসব বিষয়ের মধ্যে সেই সকল লোকের জন্য নিদর্শন আছে, যারা বুদ্ধিকে কাজে লাগায়।’ (সুরা রাদ: ৪)
অর্থাৎ, কোনো গাছে বেশি ফল ধরে কোনো গাছে কম এবং কোনো গাছের ফল বেশি স্বাদযুক্ত এবং কোনো গাছের ফল ততটা স্বাদের নয়।
(চ) পাথর থেকে পানি সৃষ্টি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পাথরের মধ্যে কিছু তো এমনও আছে, যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়, তার মধ্যে কিছু এমন আছে যা ফেটে যায় এবং তা থেকে পানি নির্গত হয় আবার তার মধ্যে এমন পাথরও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।’ (সুরা বাকারা: ৭৪)
(ছ) আল্লাহ তায়ালার আরশ পানির উপর।
কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘তিনিই আকাশমন্ডল ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, যখন তাঁর আরশ ছিল পানির উপর, তোমাদের মধ্যে কাজে কে শ্রেষ্ঠ তা পরীক্ষা করার জন্য।’ (সুরা হুদ: ৭)
(জ) বৃষ্টির পানি পবিত্র।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি পবিত্র পানি। তা দ্বারা মৃত ভূমিকে সঞ্জীবিত করা এবং আমার সৃষ্ট বহু জীবজন্তু ও মানুষকে তা পান করানোর জন্য।’ (সুরা ফুরকান: ৪৮-৪৯)
(ঝ) পানি সংরক্ষণ করেন আল্লাহ তায়ালা।
ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি আকাশ থেকে পরিমিতভাবে বারি বর্ষণ করি, তারপর তা ভূমিতে সংরক্ষণ করি। নিশ্চিত জেন, আমি তা অপসারণ করতেও সক্ষম।’ (সুরা মুমিনুন: ১৮)
আকাশ থেকে আমি যে বৃষ্টি বর্ষণ করি তোমাদেরকে যদি তা সংরক্ষণ করার দায়িত্ব দেয়া হত, তবে তোমাদের পক্ষে তা সম্ভব হত না। আমি এ পানি পাহাড়-পর্বতে বর্ষণ করে বরফ আকারে জমা করে রাখি। তারপর সে বরফ গলে-গলে নদ-নদীর সৃষ্টি হয়। তা থেকে শিরা-উপশিরারূপে সে পানি ভূগর্ভে ছড়িয়ে পড়ে এবং মাটির স্তরে-স্তরে তা জমা হয়ে থাকে। কোথাও কুয়া ও প্রস্রবণের সৃষ্টি হয়। (তাওজিহুল কুরআন)
উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে বোঝা গেল, পানি ব্যতীত মানুষ, জীব, গাছপালা ইত্যাদি যেমন বেঁচে থাকতে পারে না, তেমনি পানি-বৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিজীবকে ভয়ংকর আজাবে নিপতিত করতে পারেন, ধ্বংস করে দিতে পারেন সুরম্য প্রাসাদ, সজ্জিত জনপদ ও নগর-গ্রাম। ফলে মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য হবে আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি পরিত্যাগ করা। পানির আজাব থেকে নিরাপদ থাকার লক্ষ্যে ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধান পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করা। সাথে সাথে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে জনজীবনে বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে সাধ্যের সবটুকু নিয়ে পানিবন্দী ও বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আল্লাহ তায়ালা তৌফিক দান করুন। আমিন!
লেখক: খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন