বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কোটি মানুষ

গো-খাদ্যের চরম সঙ্কট : বরাদ্দ মাত্র ৫ কোটি টাকা কোনো ক্ষতিগ্রস্তই ত্রাণ পাচ্ছে না

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশের চলমান বন্যায় দুই সপ্তাহে ১২ জেলার নদীভাঙনে ফসলি জমি, ধান ক্ষেত-খামার, রাস্তাঘাট, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হচ্ছে। ভাঙন আতঙ্কে নদীপাড়ের মানুষগুলো দিশাহারা। চলতি বন্যায় প্রায় এক কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুকনো খড় না থাকায় গবাদিপশুর খাদ্য চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে গবাদিপশুর খাদ্য ক্রয়ের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু কি পরিমাণ চাল ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা বলতে পারছে না দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বন্যা ও নদী ভাঙনকবলিত জেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্তরা ত্রাণ পাচ্ছে না বলে জানা গেছে।

সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের ১২টি জেলার চরম ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা জন্য সরকারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ডিসিদের নামে কি পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা বলছে না দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
এদিকে সরকারি বরাদ্দ দিলে ও এখনো ত্রাণ পায়নি অনেক জেলার সাধারণ মানুষ। এদিকে সরকারি বরাদ্দ হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয় চাল ও গম সরবরাহ করতে পারছে না বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তবে এসব জেলায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে মাঠে নেই রাজনৈতিক দলের জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় নেতারা।

এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিটি জেলায় আমাদের বরাদ্দ দেয়া আছে। ডিসিরা তা ব্যয় করতে পারবেন। আমরা গতকাল বুধবার গো-খাদ্য ক্রয়ের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। ডিসিদের অনুক‚লে কি পরিমাণ নগদ টাকা ও চাল বরাদ্দ দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, সেটা বলতে পারবো না। তবে যথেষ্ট বরাদ্দ আছে। আমি জামালপুরের ডিসির সঙ্গে কথা বলেছি তিনি বিতরণ শুরু করেছে। বাকিদের সঙ্গে কথা বলছি।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রেজাউল করিম ইনকিলাবকে বলেন, আমার জেলা ৯টি উপজেলায় সরকারিভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তারা বিতরণ কাজ শুরু করেছে।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, চলতি বন্যায় এ জেলার ৪টি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৫২টি পরিবার। এ জেলায় ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি এবং বিতরণ কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, মানুষ আর ত্রাণ চায় না। তারা নদীর ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধান চান।

গতকাল বুধবার পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, মধ্য-দক্ষিণে মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। তাছাড়া আরো বিভিন্ন জেলা-উপজেলা, গ্রাম-জনপদ বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে প্লাবিত হচ্ছে। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, ধরলা, ঘাঘট, ধলেশ্বরী, আত্রাই এই ৭টি নদ-নদী ১৮টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া প্রধান নদ-নদীগুলোর ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৫০টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৫২টি স্থানে হ্রাস ও ৭টি স্থানে অপরিবর্তিত থাকে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। চর, দ্বীপচরসহ নদ-নদী অববাহিকার নিচু এলাকার এখনো ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এসব এলাকার কাঁচা সড়ক তলিয়ে থাকায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হক জানান, চলমান বন্যায় জেলায় প্রায় ১৬ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমির রোপা আমন ও ২৭০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত, ১শ’ হেক্টর জমির বীজতলা দীর্ঘদিন পানিতে তলিয়ে রয়েছে।
টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। যমুনাসহ সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা, ধলেশ্বরী ও ঝিনাইসহ অন্যান্য শাখা নদীগুলোর পানি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার এবং ঝিনাই নদীর পানি বিপদসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পানি বৃদ্ধির সাথে দেখা দিয়েছে তীব্রভাঙন।

পদ্মা যমুনার অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে পানির তোড়ে এবাব ভয়াল থাবার মুখে পড়েছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের দুর্গম চরাঞ্চলের আজিমনগর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়। গত ২৮ আগস্ট রাতে চরাঞ্চলের তিনটি ইউনিয়নের জনগণের একমাত্র চিকিৎসাসেবার অবলম্বন হাতিঘাটা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কেন্দ্রটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে নতুন করে হাতিঘাটার জনমনে ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত মঙ্গলবার আজিমনগর ইউনিয়নের ভাঙনকবলিত চরাঞ্চল পরিদর্শন করেন মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল লতিফ, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাইন উদ্দিন ও হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম।

ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৫টি ইউনিয়নের ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে এসব মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় উজানের ঢল ও বৃষ্টিপাতে দেশের তাঁত ও দুগ্ধশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে যমুনা নদীতে ৯ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর ও গোহালা নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়ে শাহজাদপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে।

অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, রাজবাড়ী, নওগাঁ, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নাটোর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ঢাকা, শেরপুর জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ বন্যার কবলে পড়েছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১২ জেলায় বন্যাকবলিত হয়েছে। ২ লাখ ৯৬ হাজার ২৭৯ জন এ বন্যায় সর্বস্ব হারিয়েছেন। আরও ৭১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৮ জন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যায় ৭৫ হাজার ৩৩১টি ঘর সম্পূর্ণ এবং ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৮২৫টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে ১১ হাজার ৫৮৩ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৪ লাখ ৫৮৭ হেক্টর জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্গত জেলাগুলোতে অন্তত ৫২ হাজার ২০৮টি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত মঙ্গলবার সচিবের নির্দেশনা এসেছে, কোনোভাবেই জেলা প্রশাসক ও ত্রাণ কর্মকর্তার বাইরে অন্য সূত্রের তথ্য নেওয়া যাবে না। কিছুদিন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের তথ্যের ভিন্নতা থাকলেও আজ থেকে একই রকম তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে উত্তরের দুর্গত এলাকাগুলোর বানের পানি নেমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা আর খুব বেশি বাড়বে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন