সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

পদ্মা-যমুনার পানি বাড়ছে এবার ১৩ টি জেলায় বিভিন্ন পয়েন্ট ভাঙবে নদী : সিইজিআইএস

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর এবার মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পদ্মা এবং যমুনার পানি বাড়তে শুরু করেছে। এর ফলে এসব নদীর আশপাশের জেলাগুলো প্লাবিত হবে। তবে এসব নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন জেলায় নদী ভাঙন তীব্র রূপ নেবে। এতে ঘর-বাড়ি জমিজমা সব হারিয়ে নিস্ব হবে নদী পাড়ের লাখ লাখ মানুষ। এমনিতেই বন্যায় মানুষের দুর্বিষহ জীবন। তার উপর নদী ভাঙন যেন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’য়ের অবস্থা।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের নদীগুলোর পানি বাড়ছে। গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

নদী ভাঙন নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান স্টোর ফর এনভায়রনমেন্ট এন্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) এবছর নদী ভাঙনের যে পূর্বাভাস তাতে ভাঙন প্রবণ ১৩টি জেলার কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে বর্ষার শুরুতেই ৮ জেলায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। পদ্মা এবং যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে যে সব জেলায় তীব্র নদী ভাঙন দেখা দেবে সেগুলো হচ্ছে, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল এবং জামালপুর। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্দা জেলায় নদী ভাঙছে।

যমুনা নদীর পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। দ্রুত পানি বাড়ায় জেলার শাহজাদপুর ও চৌহালীতে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। শাহজাদপুরের রাউতারা এলাকায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধ ভেঙে গেছে।
পানি বৃদ্ধির ফলে মানিকগঞ্জের শিবালয়ের পদ্মা-যমুনা নদীর পাড় এলাকায় ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে হুমকির মুখে রয়েছে শিবালয়ের তেওতা, শিবালয় ও আরুয়া তিনটি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থান। এরমধ্যে তেওতা ইউনিয়নের আলোকদিয়া, মধ্যনগর, চরবৈষ্টমী, চরগঙ্গা প্রসাদ ও ত্রিসুন্ডী এ কয়েকটি এলাকার বেশ কিছু অংশ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এবছর ভাঙ্গনের যে ভয়াবহতা দেখা যাচ্ছে আগে থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ তিনটি গ্রাম নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া মানিকগঞ্জের হরিরামপুরেও নদী ভাঙনে নি:স্ব হচ্ছে মানুষ।

মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। উপজেলার লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের বড় নওপাড়া গ্রাম ও কনকসার ইউনিয়নের সিংহেরহাটি গ্রামের ৫০০ মিটার এলাকায় সপ্তাহখানেক ধরে ভাঙছে। এর ফলে দুই এলাকায় প্রায় ২০০ পরিবারের ভিটেমাটি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। নদীর পানি বৃদ্ধি, প্রচণ্ড স্রোত ও ঢেউয়ের আঘাতে নদীর কূল ভেঙে যাওয়ায় নদীপাড়ের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ক্রমশ ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় লোকজন বাড়িঘর সরিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

পদ্মার ভাঙনে শরীয়তপুরের জাজিরার অনেক মানুষ সব হারিয়ে নি:স্ব। প্রতি বছরই পদ্মার পানি বাড়ার সাথে সাথে ব্যাপক ভাঙনের দেখা দেয়। আবার পানি কমতে শুরু করলেও ভাঙন তীব্র হয়। তাই শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা পদ্মা নদীর ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি করছেন।

সিইজিআইএসের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পলির কারণে পদ্মার বুকে চারটি বড় চর তৈরি হয়েছে। শরীয়তপুর, চাঁদপুর, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের কাছে ওই চরগুলো বন্যার পানিপ্রবাহে বাধা পায়। ফলে পানি বঙ্গোপসাগরে দ্রুত নামতে বাধা পেয়ে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। একই সঙ্গে চরে বাধা পেয়ে পানি নদীর তীরে ভাঙনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

প্রতি বছর বর্ষার শুরুতেই পদ্মার ভাঙন অস্থায়ীভাবে ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। শুধু শরীয়তপুরে গত কয়েক বছরে ১০ কোটি টাকা খরচ করেও ভাঙন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পরিবেশ ও পনি বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম গতিশীল নদী পদ্মা। বিশেষ করে বর্ষাকালে এটি কোথায় কখন ভাঙন ঘটাবে তার পূর্বানুমান করা কঠিন। তবে এই নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। একই সঙ্গে নদীটির চরগুলোতে ও দুই তীরে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও পরিকল্পিত হতে হবে।

এদিকে যমুনায় পানি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাঙন শুরু হওয়ায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের দলিকার ও হাটবাড়ি চরের ৬০০ বাস্তুহারা পরিবার এখন দিশাহারা। একসময় চরের সচ্ছল কৃষক হয়েও নদীভাঙনে এখন তারা সহায়-সম্বলহীন। বর্ষা শুরু হতে না হতেই যমুনার ভাঙন লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসায় আশ্রয় হারানোর শঙ্কায় দিন কাটছে হাজারো মানুষের।

টাঙ্গাইলে যমুনা নদীর ভাঙন থামছেই না। ইতোমধ্যে শতাধিক ভিটেবাড়িসহ মসজিদ, হাট-বাজার, তাঁত কারখানা, স’মিল, আবাদি জমি ও রাস্তাঘাট যমুনার গর্ভে চলে গেছে। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফেলা জিও ব্যাগও কাজে আসছে না। ফলে চরম আতঙ্কে দিন পার করছেন যমুনা তীরবর্তী বাসিন্দারা। যমুনা নদীর কোলঘেঁষা টাঙ্গাইল সদর উপজেলা, কালিহাতী, নাগরপুর ও ভূঞাপুর উপজেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্প্রতি ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। সদর উপজেলার চরপৌলী, মাকরকোল, কেশবমাইঝাইল, তিতুলিয়া, নয়াপাড়া, কুকুরিয়া, বারবাড়িয়া, দেওরগাছা, রশিদপুর, ইছাপাশা, খোশালিয়া, চানপাশা, নন্দপাশা, মসপুর, কালিহাতী উপজেলার আলীপুর, ভৈরববাড়ী, ভূঞাপুর উপজেলার ভালকুটিয়া, নাগরপুর উপজেলার পাইকশা মাইঝাইল, খাষঘুণি পাড়া, খাষতেবাড়িয়া ও চর সলিমাবাদ এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বেশি। এ ছাড়া তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধির ফলে কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্দা জেলার বিভিন্ন স্থানে তীব্র নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন