দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। দেশের প্রধান প্রধান নদী ও শাখানদীগুলোর কোথাও পানি বাড়ছে কোথাও কমছে কোনো স্থানে আবার থমকে আছে। তবে প্রবল স্রোতে উত্তাল থাকায় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা থেকে শুরু করে উত্তর-মধ্যাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল হয়ে ভাটি ও মোহনার দিকে শরীয়তপুর-চাঁদপুর, বৃহত্তর নোয়াখালী-বরিশাল-ভোলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে সাতক্ষীরা পর্যন্ত তীব্র ভাঙন চলছে। পৈত্রিক ভিটামাটি, বসতঘর, ফসলি জমি, বাগান, ক্ষেত-খামার নদীগর্ভে হারিয়ে রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার। বন্যা-ভাঙনে গ্রাস করেছে রাস্তাঘাট, বাঁধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার্ত ও ভাঙনকবলিত লাখো মানুষ এখনো পানিবন্দি। পানিবন্দি মানুষ খাদ্য, থাকার ঘরসহ জরুরি ত্রাণের আশায় তাকিয়ে আছেন। খাদ্য, আশ্রয়, বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসার অভাবে হাহাকার করছে বন্যার্ত মানুষ।
ভারতের আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাত আপাতত কমেছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেট-ময়মনসিংহ বিভাগে উজানের ঢলও কমেছে। মৌসুমী বায়ু দুর্বল থাকায় দেশের অভ্যন্তরেও বৃষ্টিপাত হ্রাস পেয়েছে। তবে হিমালয় পাদদেশীয় ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, মধ্য-ভারত, বিহার ও নেপালের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। এর ফলে উজানে গঙ্গায় ও ভাটিতে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ত্রিপুরায় অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর পানি ফেনীর পরশুরামে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। ফের দেখা দিয়েছে আকস্মিক বন্যা। দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহ এবং শাখা-প্রশাখা, উপনদীগুলোতে পানি কোথাও বৃদ্ধি কোথাও হ্রাস পাচ্ছে। অনেক স্থানে পানির সমতল প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, গতকাল রোববার বিকাল পর্যন্ত ৯টি নদ-নদী ২০টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীগুলো হচ্ছে- ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, ধরলা, আত্রাই, ধলেশ^রী, কালিগঙ্গা, তুরাগ ও মুহুরী। শনিবার ৯টি নদ-নদী ২১টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। বর্তমানে দেশের উত্তর, উত্তর-মধ্য, মধ্যাঞ্চল থেকে ভাটি হয়ে পদ্মা-মেঘনার মোহনা পর্যন্ত ১৩টি জেলা বন্যা কবলিত। জেলাগুলো হচ্ছে- কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর। বন্যা পূর্বাভাসে জানা গেছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও মানিকগঞ্জ এই আট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অন্যদিকে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, প্রধান নদ-নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৩৯টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৬৬টিতে হ্রাস ও ৪টি স্থানে অপরিবর্তিত থাকে। শনিবার নদ-নদীর ৪৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৫৯টিতে হ্রাস ও ৪টি স্থানে অপরিবর্তিত থাকে।
বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। যা আগামী ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রধান নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে।
প্রধান নদ-নদীর প্রবাহ সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের সবক’টি পয়েন্টে পানি হ্রাস পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদের পানি ফুলছড়িতে বিপদসীমার ১৭, সাঘাটায় ৮, বাহাদুরাবাদে ২৫, সারিয়াকান্দিতে ৪৭, কাজীপুরে ৫৪, সিরাজগঞ্জে ৫২, পোড়াবাড়ীতে ২১, মথুরায় ৩৬ এবং আরিচায় ৩৭ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদী ৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে গোয়ালন্দে ৭৮, ভাগ্যক‚লে ১৮, সুরেশ্বরে ১৪ ও মাওয়ায় ১৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা নিয়ে আমাদের অন্যান্য সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু জানান, কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রায় সাড়ে তিনশ’ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ধরলার পানি বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ধরলা অববাহিকার ২টি উপজেলার ৩৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। অপর দিকে ব্রহ্মপুত্রের পানি কিছুটা কমলেও এখনও বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। উলিপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নেই বন্যায় ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৭ হাজার ৬২০জন। এর মধ্যে নদীভাঙনের শিকার ১ হাজার ৪০ জন এবং পানিবন্দি হয়েছে ৫৮ হাজার ৪শ’ জন। এছাড়াও ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে ৩১ হাজার ২৪০টি। বন্যায় ২টি ব্রীজ ও ৭টি স্কুল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার্তদের শনিবার ৩শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
ফেনী থেকে মো. ওমর ফারুক জানান, মুহুরী নদীতে গতকাল রাত থেকে ফের ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করে। ফলে সকালের দিকে নদীতে পানি বিপদসীমার ১৩ দশমিক ৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের জয়পুর এলাকায় মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের পূর্বের ভাঙন স্থান দিয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। বিকেল পর্যন্ত ৩ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে এবং ফুলগাজী-পরশুরাম সড়ক ডুবে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে জনদুর্ভোগ বেড়ে যায়।
টাঙ্গাইল থেকে আতাউর রহমান আজাদ জানান, ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে যমুনা, ধলেশ্বরী, ঝিনাইসহ সকল নদ নদীর পানি। এতেকরে জেলার ৭টি উপজেলার দুইশতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বানের স্রোতে রাস্তাঘাট ও ব্রিজ ভেঙে যাতায়াতে বেড়েছে দুর্ভোগ। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন রাস্তাঘাট। নৌকাই এখন একমাত্র ভরসা বানভাসিদের।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ধলেশ্বরী নদীর পানি বাড়লেও যমুনা ও ঝিনাই নদীর পানি কমেছে। যমুনা নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার, ঝিনাই নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার এবং ধলেশ্বরী নদীর পানি ১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৭৯ উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অসময়ের বন্যা দেখা দেয়ায় টাঙ্গাইল সদর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, নাগরপুর, মির্জাপুর, বাসাইল ও দেলদুয়ারে নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। এতে আবাদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি তলিয়ে গেছে পাঁচ শতাধিক হেক্টর ফসলি জমি। পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। দেখা দিয়েছে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ। পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যাপক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের খাদ্য সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন বানভাসিরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন