ফুটবলে পেলের দেশ ব্রাজিলের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য আর সুখ্যাতি। অথচ যে ফুটবলকে ঘিরে দেশ হিসেবে সারা পৃথিবীতে ৫ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের এই খ্যাতি আর পরিচয় সেই ফুটবলই শেষ পর্যন্ত সবচাইতে বড় কলঙ্ক এনে দিল ব্রাজিলকে। গত রোববার ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী সাও পাওলো স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বের আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের ম্যাচ চলাকালীন ৮ মিনিটের মাথায় হঠাৎ করেই সারা পৃথিবীকে হতভম্ব করে দিয়ে অনেকটাই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ব্রাজিলের স্বাস্থ্যবিভাগ আর পুলিশের কর্মকর্তারা মিলে জোরপূর্বক মাঠে প্রবেশ করে খেলা বন্ধ করার যে মাস্তানি প্রদর্শন করেছে তা শুধু ফুটবলের ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গণের ইতিহাসেও নজিরবিহীন!
কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম ভঙ্গ করার কথিত অপরাধে আর্জেন্টিনার চার ফুটবলার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ, ক্রিস্টিয়ান রোমেরো, জিওভান্নি লো সেলসো ও এমিলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে গ্রেফতার করতে যাওয়ার এই অনাকাক্সিক্ষত ও নিন্দনীয় ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের খেলোয়াড়রাসহ সারা পৃথিবীর কোটি কোটি ফুটবল দর্শক। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির বিবেচনায় ম্যাচ রেফারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে খেলা স্থগিত ঘোষনা করতে হয়। অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন আর্জেন্টিনার কোটি কোটি সমর্থকরা। ব্রাজিলের এই মাস্তানির প্রতিবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় তুলেছেন কোটি কোটি ফুটবল ভক্তরাও।
ঘটনার সূত্রপাত একটি উড়ো অভিযোগ। সেটি হচ্ছে, যথাযথভাবে কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম না মানায় মার্তিনেজ, রোমেরো ও লো সেলসোর খেলায় অংশগ্রহণ করাটা বে-আইনি এবং সেই অজুহাতে ম্যাচ চলাকালীন তারা তাদেরকে গ্রেফতার করতে আসেন ব্রাজিলের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা আনভিসা কর্মকর্তারা। অথচ খেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সংক্রান্ত কোনো অভিযোগই পাননি ম্যাচ রেফারিসহ খেলা সংশ্লিষ্ট কেউই। এমন অবস্থায় হঠাৎকরে ম্যাচ চলাকালীন রেফারির অনুমতি না নিয়েই রীতিমতো মাস্তানির ভূমিকায় মাঠে প্রবেশ করে খেলা বন্ধ করে দিয়ে ব্রাজিলের পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা যেভাবে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের গায়ে হাত তুলেছে তা শুধু নিন্দনীয়ই নয় অপরাধমূলক কর্মকান্ডও। এই ঘটনার সময় ব্রাজিলের ফুটবলারাও হতবাক হয়ে আর্জেন্টাই ফুটবলারদের পক্ষ নেন এবং স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও কোনো কর্ণপাত করেননি তারা। আনভিসার কর্মকর্তারা অস্ত্রধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে মাঠে ঢুকে সেই চার খেলোয়াড়কে আটক করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে যা পৌঁছায় তর্কবিতর্ক, হাতাহাতির পর্যায়ে!
মূলত ঝামেলাটা বাধিয়েছে ইংল্যান্ড ও ব্রাজিলের করোনাবিধি। একদিকে ব্রাজিলকে লাল তালিকাভুক্ত করায় সেখান থেকে কেউ ইংল্যান্ডে গেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন করতে হচ্ছে। এ কারণে ইংলিশ ক্লাবগুলো ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের ছাড়েনি। ওদিকে ব্রাজিলে করোনানীতি অনুযায়ী, দেশটিতে অব্রাজিলীয়দের ব্রিটেন, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত থেকে সরাসরি প্রবেশের অনুমতি নেই। ব্রাজিলে প্রবেশের পর ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন পালন করতে হবে। অ্যাস্টন ভিলা ও টটেনহ্যামে খেলার কারণে মার্তিনেজ, রোমেরো, বুয়েন্দিয়া ও লো সেলসো ইংল্যান্ড থেকে আর্জেন্টিনায় গেছেন। সেখান থেকে ভেনেজুয়েলায় বাছাইপর্বের একটি ম্যাচ খেলে ব্রাজিলে পা রেখেছেন। তাঁদের কারও পক্ষেই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন পালন করা সম্ভব হয়নি। এসব খবর সবাই জানতেন। তবু কীভাবে আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ইভেন্টে এভাবে ম্যাচ শুরু হওয়ার পর থামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে?
ঘটনা পরিক্রমা নিয়ে একটা টাইমলাইন সৃষ্টি করেছে ফুটবলবিষয়ক ওয়েবসাইট ইআইএফ সকার। সেখান থেকে জানা যায়, আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ) ও দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থার (কনমেবল) সঙ্গে ব্রাজিল সরকারের আলাপ হয়, ছাড়ের অনুমতিও দেওয়া হয়। তবে আনভিসা এ প্রস্তাব মানেনি এবং স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দেয়। স্টেডিয়ামে ঢুকে আনভিসা কর্মকর্তা ও ফেডারেল পুলিশ সিবিএফ ও কনমেবল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে। কর্মকর্তারা জানান, ম্যাচ চালানোর অনুমতি আছে তাঁদের। কিন্তু আনভিসা কোনো কথা শুনতে রাজি হয়নি এবং তাঁদের কথা উড়িয়ে দেয়। পরে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এমন কিছু তাদের অনিচ্ছায় হয়েছে এবং ম্যাচ চালানোর জন্য তারা চেষ্টা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারই তাদের ম্যাচের অনুমতি দিয়েছিল, ‘আনভিসা-কান্ডে আমরা অত্যন্ত বিস্মিত এবং আমাদের মনে হয়েছে, বিষয়টা আরও আগেই সুন্দরভাবে সমাধান করা যেত।’
ঘটনার আকস্মিকতা মানতে পারছেন না আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি। তার বক্তব্য, ওই চার খেলোয়াড় যে খেলতে পারবেন না, সেটা ম্যাচের আগে তাঁদের কেউই জানায়নি। আর আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্লদিও তাপিয়া জানাচ্ছেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা খেলোয়াড়দের দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বাছাইপর্বে নামার আগে কোয়ারেন্টিন-সংক্রান্ত বিধি কী হবে, এ নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো আগেই একমত হয়েছিল। সব দেশের স্বাস্থ্য বিভাগই তা জানত! ঘটনার ব্যখ্যায় তাপিয়া বলেছেন, ‘আজ যেটা ঘটেছে, সেটা ফুটবলের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ফুটবলে কালি লেপে দিয়েছে এটা। চারজন লোক একটা খবর জানাতে (ইংল্যান্ডের ক্লাবে খেলা আর্জেন্টিনার চার খেলোয়াড় খেলতে পারবে না জানিয়ে) মাঠে ঢুকে পড়লেন, আর কনমেবল খেলোয়াড়দের বলল ড্রেসিংরুমে ঢুকে যেতে!’
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের এই ম্যাচ সারা পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় লাইভ দেখছিল। যে সুবাদে এমন একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো গোটা ফুটবল বিশ্ব। তারপরেও ক্ষুব্ধ আর্জেন্টিনার সমর্থকদের কিছুটা হলেও স্বান্ত¦না দিতে পেরেছেন আর্জেন্টিনার কয়েকজন ফুটবলার। যারা রাগে, ক্ষেভে আর অপমানে মাঠে প্রবেশ করা ব্রাজিলের কয়েকজন পুলিশ আর স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে বেশ কয়েকবার চড়-থাপ্পর মেরেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েকজন আর্জেন্টাইন সমর্থক মন্তব্য করেছেন, ‘ফুটবল মাঠে এই ধরণের নজিরবিহীন জঘন্য কাজ পৃথিবীতে শুধু ব্রাজিলের মানুষদের পক্ষেই করা সম্ভব। ফিফার উচিত এই ব্যপারে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।’
ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসিও। টিভিতে দেখা গেছে, আর্জেন্টিনা অধিনায়ক আনভিসার কর্মকর্তাদের বলেছেন, ‘আমরা এখানে আছি তিন দিন হলো। তাহলে আপনার এ ব্যবস্থা এখন কেন নিচ্ছেন?’ তিনি এই ঘটনাকে আর্জেন্টিনার প্রতি চরম অসম্মানজনক হিসেবে অভিহিত করেছেন।
মেসি-ডি মারিয়ার আর্জেন্টিনা, নেইমার-কাসেমিরোর ব্রাজিল- এমন একটা ম্যাচ মানে তো তারকার ছড়াছড়ি। পুরো বিশ্ব ম্যাচটার জন্য উন্মুখ ছিল। কিন্তু সেই ম্যাচের হলো এমন পরিণতি! এক বুক কষ্ট আর অপমান বুকে নিয়ে সেখান থেকেই টিম বাসে করে এয়ারপোর্ট চলে যান মেসিরা। সেখান থেকেই ভাড়া করা বিমানে করে দেশের পথ ধরেন আলবিসেলেস্তে দল। যে বিমানে চড়েছেন চার খেলোয়াড়ও। এ ম্যাচের ভবিষ্যত কী হবে, সে ব্যাপারে ফিফার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। গতকাল এক বিবৃতিতে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থাটি জানায়, ‘ফিফা অত্যান্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের কনমেবল অঞ্চলের বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচটি অনাকাঙ্খিত কারণে স্তগিত হয়ে যাওয়ায় ফুটবল বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফুটবলজাতি গোটা বিশ্বেই উত্তেজনাকর এক ম্যাচ দেখা থেকেও বঞ্চিত হলো। পুরো ঘটনাটি ফিফার দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং মাচ রেফারির দেয়া রিপোর্ট ইতোমধ্যে ফিফার হতে পৌঁছেছে। পুরো রিপোর্ট পর্যালোচনা করে অতি শিঘ্রই একটি সিদ্ধান্ত ডিসিপ্লিনারি কমিটি দিতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
তবে সহসাই যে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দ্বৈরথ দেখা হচ্ছেনা ফুটবল বিশ্বের সেটি বলে দেওয়াই যায়। যিদও অক্টোবরে দুই দলেরই তিনটি করে খেলা থাকায় আগামী নভেম্বরে এই ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ আছে। কিন্তু নভেম্বরে এমনিতেই আরেকটি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচের সূচি যে আগে থেকেই ঠিক করা! তবে যদি তা না হয়, নিয়ম মোতাবেক যেহেতেু আয়োজক ব্রাজিল খেলা বর্জণ করেছে তাই খেলার তিন পয়েন্টই পাওয়ার কথা আর্জেন্টিনার। কিন্তু তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সারা পৃথিবী বহুল প্রত্যাশিত আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের গুরুত্বপূর্ণ এই খেলাটি দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। যার দায়ভার পুরোপুরি ব্রাজিল সরকারের উপরই বর্তায়। ব্রাজিলের কর্মকর্তারা এমন একটি ঘটনা ঘটিয়ে শুধু ফুটবলকেই কলঙ্কিত করেনি পাশাপাশি চরমভাবে অপদস্ত আর অসম্মান করা হয়েছে আর্জেন্টিনার ফুটবল গৌরব আর ঐতিহ্যকে।
স্বভাবতই এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবী। কোনো খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে যদি কারো সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে অফিশিয়ালি খেলা শুরুর আগেই সংশ্লিষ্টদেরকে জানানোর নিয়ম। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ব্রাজিলের পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মকর্তারা সেই আইন-কানুনের ধারেকাছেও যায়নি। সকল নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্রাজিলের কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ গায়ের জোরে অন্যায়ভাবে যেভাবে মাঠে ঢুকে আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের উপর তান্ডব চালিয়েছে তা শুধু নজিরবিহীনই নয়, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গণের ইতিহাসে সবচাইতে নিন্দনীয় ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন