শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামে সময়-মুহূর্তের গুরুত্ব

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:১০ এএম

আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে যে সমস্ত নেয়ামত দান করেছেন, তার মাঝে সময় অন্যতম। এ নেয়ামতের গুরুত্ব অনেক বেশি। পৃথিবীর শুরু থেকেই রাব্বুল আলামিন চাঁদ-সূর্য, আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরিচালনা করে আসছেন। সূর্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে উদিত হয়, আবার নির্দিষ্ট সময়ে অস্ত যায়। যার দ্বারা সময়ের গুরুত্ব খুব সহজেই বুঝা যায়। এ ছাড়া শরিয়তের বিধিবিধানের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের জন্য আল্লাহ একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হজ নির্দিষ্ট সময় পালন করার জন্য নির্ধারণ করেছেন, জাকাত নির্দিষ্ট পরিমাণ মাল হলে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করার জন্য নির্ধারণ করেছেন, ফরজ নামাজের জন্যও একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মুসলমানদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ।’ (সুরা নিসা : ১০৩)। এভাবে শরিয়তের অন্যান্য আহকামের মাঝেও সময়ের মালা গাঁথা রয়েছে।

আল কোরআনে সময়ের গুরুত্ব : আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের একাধিক জায়গায় দিনরাতের কসম করেছেন। রাতদিনের কসম করে বলেছেন, ‘শপথ রাতের, যখন তা আচ্ছন্ন করে। শপথ দিনের, যখন তা উদ্ভাসিত করে।’ (সুরা আল লাইল : ১-২)। এখানে রাত ও দিনের কসমে বান্দাদেরকে কল্যাণের চিন্তা ও গবেষণার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফজর ও দশ রাতের কসম করে এরশাদ করেছেন, ‘শপথ ফজরের, শপথ দশ রাতের।’ (সুরা ফজর : ১-২)। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘শপথ সকাল ও পূর্বাহ্নের; শপথ রাতের, যখন তা গভীর হয়।’ (সুরা দোহা : ১-২)। সময়ের কসম করে এরশাদ করেছেন, ‘সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মাঝে নিমজ্জিত।’ (সুরা আসর : ১-২)। এসব আয়াত দ্বারা সময়ের প্রতি অপরিসীম গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
নবীজীবনে সময়ের মূল্যায়ন : রাসুল (সা.) কী পরিমাণ সময়ের মূল্য দিতেন, তা তাঁর ইবাদত ও আমল থেকে বুঝা যায়। তিনি প্রতিদিন সকালে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আজ দিনের প্রথম অংশকে আমার জন্য উপকারী বানিয়ে দিন, তার মধ্যাংশকে সাফল্যমন্ডিত করুন এবং শেষাংশকে শুভ করুন।’ অসংখ্য হাদিসে সময়ের মূল্য ও জীবনের গুরুত্ব প্রদানের তাগিদ রয়েছে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয় আসার পূর্বে গনিমত মনে করো; বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্রের আগে স্বচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্ততার আগে অবকাশকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (সুনানে বায়হাকি : ১০২৪৮)।
সময় মোমিনের অমূল্য সম্পদ : পার্থিব জীবনে মোমিনের মূল পুঁজি সামান্য কিছু সময়। সময় কল্যাণের পথে ব্যয় ও সময় থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টাকারীর জন্য দুনিয়া ও পরকালে সুসংবাদ রয়েছে। সময়ের সঠিক ব্যবহারে শিথিলতা প্রদর্শন করা জীবনের মূল পুঁজি ধ্বংসের নামান্তর। সময়ের সঠিক ব্যবহার মোমিনকে জান্নাতের সুউচ্চ আসনে পৌঁছে দিতে পারে। অপরদিকে সময়ের অবহেলায় নিক্ষিপ্ত হতে পারে জাহান্নামে। তাইতো কোরআন ও হাদিসে সময়ের পরিচর্যায় স্ববিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই রাতদিন, সূর্য-চাঁদকে তোমাদের উপকারে নিয়োজিত করেছেন এবং তারকারাজিও তাঁরই নির্দেশমতো কর্মে নিয়োজিত। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩৩-৩৪)।
সময় সোনার চেয়েও মূল্যবান : সময় সবকিছুর তুলনায় দামি। এ কারণেই জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে মানুষ আফসোস করে, যদি আরেকটুখানি সময় দেওয়া হতো তাকে! এরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্তুতি যেনো তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে। যারা উদাসীন হবে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, মৃত্যু আসার পূর্বে তোমরা তা হতে ব্যয় করবে। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে আরও কিছুকালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা মোনাফিকুন : ৯-১০)।
সময়ের মূল্য দেওয়া মুসলিম ঐতিহ্য : যারা সময়ের গুরুত্ব দিয়েছেন, ইতিহাসে তারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন। সময়কে কাজে লাগিয়ে তারা জীবনকে দিয়েছেন পূর্ণতা। কালের বাঁধন পেরিয়ে অর্জন করেছেন কালান্তরের অমরত্ব। সময়ের মূল্য দেওয়া মুসলমানদের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় কর্তব্য। এরশাদ হচ্ছে, ‘যারা অনুসন্ধানপ্রিয় অথবা যারা কৃতজ্ঞতাপ্রিয়, তাদের জন্য তিনি পরিবর্তনশীলরূপে রাতদিন সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা ফোরকান : ৬৪)।
বড়দের সময়ের মূল্যায়ন : সময়কে মূল্যায়ন করে যারা বড় হয়েছেন, তাঁদের অন্যতম একজন ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)। তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িতকালেও একটি মাসআলা নিয়ে চিন্তারত ছিলেন। আরেকজন হলেন হজরত দাউদ তাঈ (রহ.); যিনি রুটির পরিবর্তে ছাতু খেতেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলতেন, ‘রুটির বদলে ছাতু খেলে ৫০টি আয়াত বেশি তেলাওয়াত করা যায়।’ আরেকজন হলেন বিখ্যাত আরবি ব্যাকরণবিদ খলিল ইবনে আহমদ (রহ.)। তিনি বলতেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে অসহ্যকর লাগে খাওয়া-দাওয়ার সময়টুকু।’ (সাফহাতুম মিন সাবরিল উলামা)।
সময়ের সুফল অসময়ের কুফল : একবার রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, ‘সৌভাগ্যবান কারা?’ তিনি বললেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু লাভ করে তা নেকআমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, ‘দুর্ভাগা কারা?’ তিনি বললেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু পেয়ে তা বদআমলে কাটিয়েছে বা আমলহীন অতিবাহিত করেছে।’ (তিরমিজি : ২৩২৯)।
পরকালে সময়ের হিসেব দিতে হবে : সময় ও জীবন আল্লাহর অমূল্য দান। সময়ের ইতিবাচক ব্যবহারই জীবনের সফলতা। সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। সময়ের যথাযথ ব্যবহার না করা বা অপব্যবহার করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর দরবারে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘শেষ বিচারের দিনে প্রতিটি মানুষ পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া এক কদমও নড়তে পারবে না। তা হলো, তার জীবনকাল কী লক্ষ্যে কাটিয়েছে? যৌবনকাল কী কাজে ব্যয় করেছে? কোন পথে আয় করেছে? কী কাজে ব্যয় করেছে? জ্ঞান অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করেছে কিনা?’ (তিরমিজি : ২৪১৬)।
সময়ের কারণে অনেকে ক্ষতিগ্রস্থ : আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য অসংখ্য নেয়ামত রেখেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সেই নেয়ামতগুলোর অকৃতজ্ঞতায় মত্ত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতগুলোর অপব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্থ। এরশাদ হচ্ছে, ‘সময়ের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্থ; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা আসর : ১-৩)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘দুটি নেয়ামত এমন রয়েছে, যে বিষয়ে মানুষ ধোঁকায় থাকে। তা হচ্ছে, সুস্থতা ও অবসর।’ (বোখারি : ৬৪১২)।
উদাসীনতা বা সময়ের প্রতি অবহেলা : সময়ের এতো গুরুত্ব হওয়াসত্তে¡ও অনেকেই এ ব্যাপারে উদাসীন। অথচ এরশাদ হচ্ছে, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতোক্ষণ না তোমরা সমাধিসমূহ দেখতে পাও (তোমাদের মৃত্যু হয়)। এটি কখনও সঙ্গত নয়; অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। আবারও বলি, এটি মোটেই সমীচীন নয়; তা তোমরা অনতিবিলম্বে জানতে পারবে। না, তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহগ্রস্থ হতে না। তোমরা (সময়ের প্রতি উদাসীন ও কর্মে অবহেলাকারীরা) অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে (তাতে প্রবেশ করবে)। অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম চাক্ষুস দেখে (তাতে প্রবেশ করে তার শাস্তি ভোগ করে) প্রত্যয় লাভ করবে। অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে প্রদত্ত সব নেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৮)।
টিভি চ্যানেলে সময় ব্যয় : আজকাল অনেকে অবসর সময় টিভি দেখে কাটাতে পছন্দ করে। তারা সারাক্ষণ বিভিন্ন মিউজিক চ্যানেল কিংবা মুভি দেখে সময় কাটাতে ভালোবাসে। এতে আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে নিজের সময় নষ্ট ও শারীরিক ক্ষতি হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, এটি মানুষের ধ্বংসের কারণও। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা তাদেরকে জমিনে ধসিয়ে দেবেন এবং তাদের কিছু লোককে বানর ও শূকরে রূপান্তরিত করবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০২০)।
গিবত ও পরনিন্দায় সময় কাটানো : অনেকে আবার অবসর সময়ে প্রচুর পরিমাণে পরনিন্দায় ডুবে থাকি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, আজকাল মসজিদের মতো পবিত্র জায়গায় বসেও মানুষ অন্যের গিবতে লিপ্ত হয়ে যায়। যা জঘন্য অপরাধ। অথচ গিবত ও অপরের দোষচর্চা নিকৃষ্টতম অভ্যাস। এরশাদ হচ্ছে, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস।’ (সুরা হুমাজা : ১)।
সময় সচেতন হওয়া জরুরি : আনমনে-অবহেলায় আমাদের সময় বয়ে যায়। আমরা সময়ের মূল্য দিই না, সময়ের মূল্য বুঝি না। কিন্তু ইসলামের সব কর্মপদ্ধতিতে সময়ের মূল্য অপরিসীম। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে পৃথিবীর কোনো জীবজন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর তাদের সময় পূর্ণ হলে তারা জানতে পারবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা ফাতির : ৪৫)। জীবন চলার বাঁকে বাঁকে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মানুষ ব্যাধি ও জরাগ্রস্থ হয়ে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই সময় থাকতে এখনই সময় সচেতন হতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন