আমি একটি মাদকদ্রব্য। আমার নাম সিগারেট। আমি দেখতে বেশ সুন্দর। আমি সাদা কাগজে মোড়ানো। দেখতে কলমের মতো। আমাকে দেখতে শান্তির প্রতীকের মতো মনে হয়। কারণ আমি দেখতে সাদা। আমি খুব সহজলভ্য একটি মাদক। আমি পৃথিবীর সব দেশে, শহরে এবং গ্রামেও বিক্রি হই। আমি অনেক প্রাচীন একটি মাদকদ্রব্য। যে কোন দেশের মানুষের মধ্যে আমি খুব দ্রুত নেশা তৈরি করতে পারি। ছোট, বড় নারী, পুরষ যে কেউ আমার নেশাতে আক্রান্ত হয়। দুই থেকে তিন দিন কয়েকবার আমাকে গ্রহণ করলেই, আমি নেশাতে পরিণত হই। যে কোন দেশের, যে কোন পরিবেশের মানুষকে আমি সহজেই আসক্ত করে ফেলি। আমার নাম ধূপমান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ১৯৮৭ সাল থেকে ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে বিশ্বকে ধূমপানমুক্ত করার অদম্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ধূমপানের কারণেই আয়ুষ্কাল কমে যায় ১০-২০ বছর। বিশ্বে যত লোক মারা যায় তার দ্বিতীয় প্রধান কারণ ধূমপান। প্রতি বছর ৫৮ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় ধূমপানের কারণে, প্রতি ১০ জনে একজন। মৃতদের ৭০ শতাংশই; কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ এর অবস্থা দাঁড়াবে ছয়জনের মধ্যে একজন। হু-এর মতে প্রতি বছর এক কোটি লোক ধূমপানের কারণে অসুস্থ হয়। ধারণা করা হচ্ছে ধূমপানের কারণে বিংশ শতাব্দীতে যা পরিমাণ মারা গেছে একবিংশ শতাব্দীতে তার ১০ গুণ মারা যাবে।
সিগারেটের একটা টানে তিন হাজারেরও বেশি রকম রাসায়নিক পদার্থ ঢুকে যায় ধূমপায়ীর শরীরে। এর মধ্যে প্রধান হলো নিকোটিন। এই নিকোটিনই ধূমপান ছাড়তে দেয় না। এমন কোন রোগ নেই যার কারণের মধ্যে ধূমপান নেই। তবে ধূমপানের কারণে সবচেয়ে ভয়াবহ রোগীটি হলো ক্যান্সার। সিগারেট-বিড়িতে ৬৫ রকমের বেশি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে ৩৩ ভাগ ক্যান্সারের কারণ ধূমপান। ধূমপানের ফলে সবচেয়ে বেশি হয় ফুসফুসের ক্যান্সার। প্রতি বছর বিশ্বে ১৩ লাখ লোক মারা যায় ফুসফুসের ক্যান্সারে, বাংলাদেশে মোট ক্যান্সার রোগীর ২৫ ভাগ। এ ক্যান্সারের ৯০ শতাংশ কারণ ধূমপান। এ কারণে হতে পারে মুখ, গলা, গলবিল, খাদ্যনালী, অগ্নাশয়, পাকস্থলী, যকৃৎ, মূত্রথলি, বৃহদান্ত্র ও মলাশয়, স্তন ও জরায়ূমুখ ক্যান্সার। গবেষণায় দেখা গেছে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ১০ গুণ এবং মুখ, গলা, অন্ননালী, অগ্নাশয়, কিডনি, মূত্রথলি, জরায়ু মুখ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কয়েক গুণ বেশি। এ ছাড়া ধূমপান করলে রক্তে মোট কোলেস্টেরল ও খারাপ কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা বেড়ে যায় এবং কমে যায় ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএলের মাত্রা। এতে করে রক্তনালীতে চর্বি জমে গিয়ে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক,স্ট্রোক, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, পায়ে গ্যাংগ্রিন। গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপায়ীদের ৪০ বছরের পর হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা পাঁচ গুন বাড়ে। হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ।
ধূমপানের কারণে হতে পারে সিওপিডি-এমফাইসেমা, ক্রোনিক ব্রোঙ্কাইটি শ্বাসনালীর ইনফেকশনও বাড়ায় ধূমপান। গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপায়ীদের যক্ষ্মা হওয়ার সম্ভাবনা দু-চার গুণ বেশি। প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয় এরা। এছাড়া ঘনঘন ফুসফুসের ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়। ধূমপানের ফলে মায়ের পেটের শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গর্ভাবস্থায় ধূমপান করলে অ্যাবরশন হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। শিশুর ওজন কম হতে পারে, আক্রান্ত হতে পারে অ্যাজমায়। গবেষণায় দেখা গেছে শুধু মা বাবার ধূমপানের আমেরিকার দু-তিন লাখ শিশু শ্বাসনালীর প্রদাহে আক্রান্ত হয়ে ১৫ হাজার হাসপাতলে ভর্তি হয়। এছাড়া কোন কারণ ছাড়াই মারা যেতে পারে শিশু।
আপনি হয়তোবা ধূমপান করেন না। ভাবতে পারেন আপনি এ স্বাস্থ্য সমস্যামুক্ত। আপনার আশপাশের ধূমপায়ীদের ধোঁয়া আপনার ক্ষতি করে চলেছে আপনার অগোচরে। একে বলে সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং। গবেষণায় দেখা গেছে ফুসফুসের ক্যান্সারের ১০ ভাগ রোগী কখনোই ধূমপান করেননি। তারা আক্রান্ত হয়েছেন সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং থেকে। এ ছাড়া এদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি ২০-৩০ ভাগ, হৃদরোগের ঝুঁকি ২০-৩০ ভাগ। তাই আপনার আশপাশের ধূমপায়ী হতে সাবধান হোন।
ধূমপান বন্ধ করার সুফল
* ২০ মিনিট পর ধূমপায়ীর রক্তচাপ, নাড়ীর গতি এবং দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
* ৮ ঘন্টার মধ্যে ধূমপায়ীর রক্তের কার্বণ মনোঅক্সাইডের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
* ৩ দিনের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
*শ্বাসকষ্ট এবং সিওপিডি অনেক ভালো হয়ে যাবে।
* ১ বছর পর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ কমে যাবে এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে।
* ১০ বছর পর হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা এতটাই কমে যাবে তা অধূমপায়ীদের মতো হয়ে যাবে।
* ধূমপানের কারণে যে অর্থ খরচ হয় সে অর্থ জমিয়ে অনেক প্রয়োজনীয় ভালো কাজ করা যেতে পারে। ধূমপান ভালো কিছু বয়ে আনে না। নিয়ে আসে রোগ-বালাই, অশান্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি।
শুধু সাময়িক মানসিক প্রশান্তির আশায় আমরা ধ্বংস করে দিচ্ছি নিজেদের। পরিবারকে ঠেলে দিচ্ছি ঝুঁকির মধ্যে, অভিভাবকহীনতায় নিরাপত্তাহীনতায়। তাই আসুন আমাদের দেহ, মন, পরিবেশকে আমরা ভালো রাখি। ধূমপান সহ যাবতীয় মাদককে ‘না’ বলি। শুধু এই দেশ নয়, পুরো পৃথিবীকে ভালো রাখার জন্য আমরা ধূমপানকে ঘৃণা করি। আর শুধু সিগারেট নয় যে কোনো মাদকদ্রব্য মানুষ ও পরিবেশ দুটোর জন্যই বিপজ্জনক। তাই আমি ‘সিগারেট’ তোমাদের আবারো বলছি- “তোমরা আমাকে ও সকল মাদককে ঘৃণা করো”।
মাও: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট,
মোবাইল- ০১৭১৬-২৭০১২০।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন