শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দখল-দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গাসহ সব নদী-খাল বাঁচাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা। কিন্তু সেই প্রাণ এখন দখল ও দূষণে মৃতপ্রায়। বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। এই মধ্য শরতেও মাঝে-মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। ক’দিন আগেও বিভিন্ন নদনদী বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এখন অবশ্য ধীরে ধীরে নদীর পানি কমে আসবে। পাড়ভাঙ্গা নদী শান্ত হবে। এ সময় স্বাভাবিককারণেই নদীর পানি স্বচ্ছ, পরিষ্কার ও টলটলে। অথচ, ব্যতিক্রম বুড়িগঙ্গা। দখল-দূষণে জেরবার আরো কিছু নদী। কর্ণফুলির কথা বলা যায়। বলা যায় চাকতাই খালের কথা। কর্ণফুলি দখল-দূষণে সংকুচিত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চাকতাই খালেরও সেই দশা। খালের দখল অব্যাহত থাকার পাশাপাশি সারাক্ষণ ময়লা-আবর্জনা ও নানা বর্জ্য পদার্থ খালে পতিত হওয়ার কারণে এর পানির রং কালো হয়ে গেছে। এক সময় এ খাল দিয়ে বড় বড় নৌযান চলাচল করতো। এখন খাল সরু ও এর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নৌচলাচল ব্যহত হচ্ছে। ঢাকার চারপাশের অন্যান্য নদী অর্থাৎ বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এমন কি ধলেশ্বরী পর্যন্ত দখল ও দূষণের ভয়াবহ শিকার। বুড়িগঙ্গার দূষণে এক সময় হাজারিবাগের ট্যানারিশিল্পকারখানার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ট্যানারিবর্জ্যরে দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গাকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে সাভারে ট্যানারিশিল্পনগর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেখানে ইতোমধ্যে ট্যানারিশিল্পনগর গড়ে উঠলেও ট্যানারিবর্জ্যরে দূষণ বন্ধ হয়নি। এই দূষণে ধলেশ্বরী এখন পর্যদুস্ত। একদা ধলেশ্বরীর পানি ছিল স্বচ্ছতার নজির; অথচ এখন পানির সেই স্বচ্ছতা নেই। দূষণের কারণে নদীতে মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণীর প্রাণরক্ষা কঠিন হয়ে পড়েছে। পাশ্ববর্তী এলাকার পরিবেশও এতে হুমকির মুখে পতিত হয়েছে।

যেখানেই শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে সেখানেই পার্শ্ববর্তী নদী বা নদীসমূহ দূষণের কবলে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশও বিপন্নতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বুড়িগঙ্গার দু’তীরবর্তী বির্স্তীণ এলাকায় শিল্পকারখানা ডকইয়ার্ড ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। এসব শিল্পের বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। প্রতিটি শিল্পকারখানার ইটিপি প্লান্ট স্থাপনের কথা থাকলেও অধিকাংশ শিল্পকারখানায় তা নেই। ফলে শিল্পবর্জ্যরে প্রকৃত ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছে বুড়িগঙ্গা। শিল্পবর্জ্যরে পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা দূষিত হচ্ছে পুরো শহরের পয়ঃবর্জ্য, কঠিন বর্জ্য ও নৌযানের বর্জ্যরে দ্বারা। কর্ণফুলী, চাকতাই খাল ইত্যাদির দূষণের জন্যও মোটামুটি এসব কারণই দায়ী। একদা বুড়িগঙ্গা কিংবা কর্ণফুলী নদী খুবই প্রশস্ত ছিল। এখন তাদের দু’পাশ দখল হতে হতে প্রস্ত কমে খালের চরিত্র লাভ করেছে। অবৈধ দখল বন্ধের জন্য বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর বিভিন্ন অংশে সীমানাপিলার স্থাপন করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সীমানাপিলার যথাস্থানে বসানো হয়নি। দখলদারদের স্বার্থে নদীর মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গায় এই সীমানাপিলারকে পর্যন্ত তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। সুযোগ পেলেই দখল ও নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত করার জন্য আমরা সরকারের অনেক কথা, অনেক প্রতিশ্রুতি, পরিকল্পনা ও প্রকল্পের কথা শুনেছি। এক সময় বুড়িগঙ্গার বুক থেকে বর্জ্য অপসারণ করার প্রকল্প নেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন কাজ চলার পর প্রকল্প পরিত্যক্ত হয়। প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের কী হয়, জানা যায়নি। পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও’ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে, তার দখল ও দূষণ রুখতে এবং সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন করতে সরকার, সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উল্লেখযোগ্য ও কার্যকর সাফল্য আজ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি।

নদীদখল ও দূষণ দিনকে দিনই বাড়ছে। এর ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। পানির প্রাকৃতিক উৎসসমূহ মানুষের অনাচারের কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পানযোগ্য ও বিশুদ্ধ পানির যেমন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি এইসব উৎসে মাছসহ অন্যান্য উপকারী প্রাণীর সংখ্যাও কমছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সংকট বা বিপর্যয়ের কারণে নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে এবং মানুষ রোগব্যাধিসহ বিভিন্ন দুর্বিপাকের শিকার হচেছ। ঝড়, জলোছ্বাস, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত, ভূমিধস, ভূমিকম্প, দাবানল, অগ্নুৎপাত ইত্যাদি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়ে গেছে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুনিয়াজুড়ে পরিবেশবিনাশী যেসব কর্মকান্ড চলছে, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের জন্য তা-ই দায়ী। বলা বাহুল্য, বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতাও বাড়ছে। পরিবেশ উন্নয়নে বিভিন্ন দৈশিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশে পরিবেশ সচেতনতা অত্যন্ত কম এবং পরিবেশবিনাশী কাজের সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত একটি মন্ত্রণালয় আছে। অথচ, সেই মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম সম্পর্কে দেশের মানুষ অল্পই জানে। মো. শাহাবউদ্দিন এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, বিভিন্ন উপলক্ষে যার সোচ্চার বক্তব্য শোনা গেলেও মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম মানুষের মধ্যে কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া শিল্পকারখানা স্থাপন করার সুযোগ নেই। কিন্তু এমন ভুরি ভুরি শিল্পকারখানা রয়েছে, যাদের এই ছাড়পত্র নেই। সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের কর্মকর্তারা এর কী জবাব দেবেন? পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে জেগে উঠতে হবে। ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। নদীদখল ও দূষণসহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যা কিছুই ঘটছে তা রুখে দিতে হবে। মানুষের মধ্যে বাড়াতে হবে পরিবেশসচেতনতা। বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী প্রভৃতি নদীর ভয়ংকর পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে একটি বহুপাক্ষিক বা সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন