শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

হুট করে তেলের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি

এইচ এম আব্দুর রহিম | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

ভোজ্য তেল, চাল, চিনি, সবজির দামের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, তখনই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হলো। কয়েকদিন আগে টিসিবির পণ্যের দাম বাড়ানো হলো। আবার এলপিজির দামও দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানিখাতে ভর্তুকি হ্রাসের কথা বলা হলেও এই বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ করে তুলবে, যা খুব ভয়াবহও হতে পারে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রতিফলন ঘটেনি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পিছনে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং ভর্তুকি কমানোর যে কারণ দেখানো হয়েছে, তা একেবারেই অযৌক্তিক। গত আট বছর যাবৎ জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্মমুখী ছিল। অপরিশোধিত তেলের দাম ৪০ ডলার নিচে নেমে এসেছিল। তখন দেশে তেলের দাম সমন্বয় করা হয়নি। প্রতিবেশী অনেক দেশে জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো হয়েছিল। দেশের বাজারে না কমিয়ে সরকার বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। ফলে দেশের তেলের বাজার আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তুলনা করা অযৌক্তিক।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদের আয়ের আনুপাতিক হারের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে, যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি করবে অত্যধিক। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা যে সাময়িক সেটাও প্রমাণিত। ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আবার কমতে শুরু করেছে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লেও হুট করে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো সমীচীন হয়নি। এখন হঠাৎ দাম বৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম সংস্থা (বিপিসি) বিভিন্ন সময়ে ভর্তুকির অজুহাত তুলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালেও এর অন্তর্নিহিত কারণ বিইআরসির গণশুনানির মাধ্যমে জানানো উচিত। এমনিতেই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ও সেবা সার্ভিসের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। সেখানে নতুন করে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে, যা বাঞ্চনীয় হয়নি। মূল্যবৃদ্ধির বিষয় পুনর্বিবেচনা করে অনভিপ্রেত সামাজিক সঙ্কট এড়াতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এমনিতে করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়ের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে। অনেকোর আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। এমন করুণ পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি একটা অমানবিক সিদ্ধান্ত। জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর কারণে কৃষিখাতে ব্যয় বাড়বে। এত খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়তে পারে বিদ্যুতের দামেও। এ অজুহাতে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে। সব মিলে চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। এক জরিপের তথ্য মতে, করোনা মহামারির এই সময়ের মধ্যে তিন কোটি ২৪ লাখ লোক নতুনভাবে দরিদ্র হয়েছে। জ্বালানি তেলের সাথে সব কিছুর সংযোগ আছে। যে কারণে এখন মূল্যবৃদ্ধি না করে যথাসম্ভব কমিয়ে পরিবহন ভাড়া, পণ্য ও সেবামূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনা জরুরি ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে পণ্যের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে দেশ। মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুদদার নানা অজুহাত দেখিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলবে।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ না করে সাধারণ জনগণের উপর বাড়তি মূল্য চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমে তখন দাম কমানো হয় না। লোকসান পোষানোর কথা বলা হয়। এটা এক ধরনের লুণ্ঠনমূলক আচরণ। কোভিডের কারণে ৭৭ ভাগ মানুষের আয় কমেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে কষ্ট হচ্ছে। আর এই সময়ে এসে তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে জ্বালানি বিভাগ জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেলের দাম ক্রম বর্ধমান। বিশ্ব বাজারে ঊর্ধ্বগতির কারণে পাশের দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ জ্বালানি তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করছে। চলতি বছর অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিভিন্ন গ্রেডের পেট্রোলিয়াম পণ্য বর্তমান মূল্যে সরবরাহ করায় মোট ৭২৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে ২৪ এপ্রিল গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। সেই সময় ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা, কেরোসিনের দাম ৬৫ টাকা, অকটেনের দাম ৮৯ টাকা ও পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেনের অভিমত, ‘এর সব চেয়ে বড় প্রভাব পড়বে পরিবহন খাতে। তারা তো রাতারাতি পরিবহন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। এই দাম বৃদ্ধি যদি ধাপে ধাপে করত তাতে হয়ত কেউ কিছুটা মানিয়ে নিতে পারত। এত বেশি বাড়ানো দেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। পরিবহন ব্যয় বাড়ায় আমাদের নিত্যদিনের ব্যয় বাড়বে এবং বিদ্যুতের দামও বাড়বে। কারণ আমাদের অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র ডিজেলচালিত। একই সঙ্গে সেচ কাজে ডিজেলের ব্যবহার হওয়ায় কৃষিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।’

সরকারি হিসাবেই করোনার আগে বাংলাদেশে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী লোকসংখ্যা ছিল পৌনে চার কোটি। অর্থাৎ নতুন দরিদ্রসহ বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী লোকসংখ্যা প্রায় সাত কোটি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথা পিছু আয় নিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সরকার যাই বলুক না কেন, এটা খুব স্পষ্ট যে করোনার আগেই শ্লথ হয়ে আসা অর্থনীতি করোনার অভিঘাতে আরও অনেক নিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে। ওদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতি শ্লথ থাকা এবং বৈদেশিক অনেককর্মী তাদের সঞ্চয় দেশে পাঠানোর কারণে করোনার সময় দেশে ডলার রিজার্ভের বিরাট উল্লম্ফন হয়েছিল। করোনার প্রভাব কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক কর্মীদের টাকা আসায় ভাটার টান শুরু হয়েছে। ফলে এখন দেশে প্রতিদিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমছে। এর ফলে সরাসরি ভোক্তার কাছে যাওয়া আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। আবার স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো আমদানি করা পণ্য প্রয়োজন হয়। ফলে দাম বাড়ছে সেগুলোরও। অর্থনৈতিক ধীরগতি, কর্মসংস্থানহীনতা এবং অতিদ্রুত কোটি কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাওয়া আর উচ্চ মূল্যস্ফীতি আমাদের যে বার্তা দেয়, তা মোটেই শুভ নয়।
লেখক: সাংবাদিক, নিবন্ধকার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন