মদের মূল আরবি শব্দ ‘খামরুন’ হল এমন এক অ্যালকোহলীক পদার্থ, যা (মন মস্তিষ্কে) নেশা ও মাদকতা উৎপন্ন করে। এর অর্থ বিলুপ্ত করা, লুকিয়ে ফেলা। যেহেতু মদ মানুষের বুদ্ধি-বিবেক বিলুপ্ত করে দেয় তাই এই নামকরণ। রব্বুল আলামিন আল কোরআনে মদপানকে শয়তানের কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে : হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর (ইত্যাদি) হলো ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করে চল, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা মায়িদা ৫ : ৯০-৯১)।
ইসলামের প্রথম যুগে জাহেলিয়াত আমলের সাধারণ রীতি-নীতির মত মদ্যপানও স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। অতঃপর রসূলে করীম (সাঃ)-এর হিজরতের পরেও মদীনাবাসীদের মধ্যে মদ্যপান ও জূয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষ এ দুটি বস্তুর শুধু বাহ্যিক উপকারিতার প্রতি লক্ষ্য করেই এতে মত্ত ছিল। কিন্তু এগুলোর অন্তর্নিহিত অকল্যাণ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না।
মদীনায় পৌছার পর কতিপয় সাহাবী এসব বিষয়ের অকল্যাণগুলো অনুভব করলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ফারূকে-আযম, হযরত মা’আয ইবনে জাবাল এবং কিছুসংখ্যক আনসার রসূলে-করীম (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন : ‘মদ ও জুয়া মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে ফেলে এবং ধনসম্পদও ধ্বংস করে দেয়। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?’ এ প্রশ্নের উত্তরে সূরা বাকারায় নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এ-গুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়’।
আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, মদ ও জুয়াতে যদিও বাহ্যিক দৃ’িতে কিছু উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু দু’টির মাধ্যমেই অনেক বড় বড় পাপের পথ উন্মুক্ত হয়; যা এর উপকারিতার তুলনায় অনেক বড় ও ক্ষতিকর। যেমন, মদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দোষ হচ্ছে এই যে, এতে মানুষের সবচাইতে বড় গুণ, বুদ্ধি-বিবেচনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ, বুদ্ধি এমন একটি গুণ যা মানুষের মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। পক্ষান্তরে যখন তা থাকে না, তখন প্রতিটি মন্দ কাজের পথই সুগম হয়ে যায়। এ আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় মদকে হারাম করা হয়নি, কিন্তু এর অনি’ ও অকল্যাণের দিকগুলোকে তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, মদ্যপানের দরুন মানুষ অনেক মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। মদের ব্যাপারে পরবর্তী আয়াতটি নাযিল হওয়ার ঘটনা নিম্নরূপ :
একদিন হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফা (রা.) সাহাবিগণের মধ্যে হতে তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেন। আহারাদির পর যথারীতি মদ্যপানের ব্যবস্থা করা হলো এবং সবাই মদ্যপান করলেন। এমতাবস্থায় মাগরিবের নামাযের সময় হলে সবাই নামাযে দাঁড়ালেন এবং একজনকে ইমামতি করতে এগিয়ে দিলেন। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যখন তিনি সুরা আল-কাফিরূন ভুল পড়তে লাগলেন, তখনই মদ্যপান থেকে পুরোপুরী বিরত রাখার জন্যে দ্বিতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হল। এরশাদ হল : ‘হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তোমরা নামাযের কাছেও যেওনা।’ এই আয়াতের মাধ্যমে নামাযের সময় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে। তবে অন্যান্য সময় তা পান করার অনুমতি তখনও পর্যন্ত বহাল রয়ে গেল।
মদ্যপান সম্পূর্নরূপে হারাম হওয়ার ঘটনাটি নিম্নরূপ : হযরত আতবান ইবনে মালেক কয়েকজন সাহাবীকে নিমন্ত্রণ করেন, যাদের মধ্যে সা’দ ইবনে আবী অক্কাসও উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর মদ্যপান করার প্রতিযোগিতা এবং নিজেদের বংশ ও পূর্ব-পুরুষদের অহংকারমূলক বর্ণনা আরম্ভ হয়। সা’দ ইবনে আবী অক্কাস একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন যাতে আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের প্রশংসাকীর্তন করা হয়। ফলে একজন আনসার যুবক রাগাম্বিত হয়ে উটের গন্ডদেশের একটি হাড় সা’দ এর মাথায় ছুঁড়ে মারেন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে সা’দ রসূল (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে উক্ত আনসার যুবনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন হুযূর (সা.) দোয়া করলেন : ‘হে আল্লাহ! শরাব সম্পর্কে আমাদের একটি পরিষ্কার বর্ণনা ও বিধান দান কর।’ তখনই সূরা মায়েদার উদ্ধৃত মদ ও মদ্যপানের বিধান সম্পর্কিত বিস্তারিত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এতে মদকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়েছে।
‘হে ঈমান্দারগণ! নিশ্চিত জেনো, মদ, জুয়া, মূর্তি এবং তীর নিক্ষেপ এসবগুলোই নিকৃ’ শয়তানী কাজ। কাজেই এসব থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে থাক, যাতে তোমরা মুক্তিলাভ ও কল্যাণ পেতে পার। মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্ত্রুতা ও তিক্ততা সৃ’ি হয়ে থাকে; আর আল্লাহর যিকর ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখাই হল শয়তানের একান্ত কাম্য, তবুও কি তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে না? ইসলাম মানুষের ব্যক্তি জীবন,অর্থনৈতিক জীবন ও সামাজিক জীবনের শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা বিধান সহ তার ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ সাধনের জন্যই মদ্যপান, মাদকাসক্তি ও মাদক দ্রব্যের ব্যবহার হারাম করে দিয়েছে।
প্রিয় নবী হযরত (সা.) এরশাদ করেন : সকল নেশাদার দ্রব্য হচ্ছে মদ আর প্রত্যেক মদ হচ্ছে হারাম। সহীহ মুসলিম : ইবনে উমার রা. বর্নিত। মাদক হলো অপরাধের আকর। কোরআন কারিমে বর্ণিত হারুত ও মারুত এই মাদকের নেশায় মাতাল হয়েই জোহরার ইশারায় হত্যা, ব্যভিচারসহ নানান অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১০২; তাফসিরে আজিজি ও তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে : রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : ‘তোমরা মদপান থেকে বেঁচে থাকো। কারণ এটি যাবতীয় অপকর্মের চাবি। ’ (মুবাদরকে হাকেম খণ্ড ৪, পৃ. ১৪৫; মুনজিরি হাদিস ৩৪৮৭, পৃ. ৪৫৫)। মদ মানুষকে আল্লাহর স্মরণ তথা নামাজ কালাম থেকে বিমুখ করে তার চরিত্র ও নৈতিকতা ধ্বংস করে দেয় এবং তাকে নিয়ে যায় পাপাচারের দিকে। প্রিয় নবী বলেন : মদ পান কর না , কারণ উহা হচ্ছে সকল অনাচারের চাবিকাঠি। ইবনে মাজা: আবুদ দরদা রা. বর্ণিত। হযরত ওসমান বিন আফ্ফান রা. বলেন : মদপান থেকে বেঁচে থাকো , কারণ উহা হচ্ছে উম্মুল খবায়েছ তথা সকল পাপাচারের মূল। তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতে একজন আবেদ ছিল। এক নষ্ট মেয়ে সাক্ষ্য দেবার কথা বলে তাকে ডেকে পাঠাল।ঘরে ঢুকতেই বন্ধ করে দেয়া হল সকল দরজা। আবেদ উপস্থিত হল এক সুন্দরী মহিলার কাছে , যার কাছে ছিল এক ডিব্বা মদ ও একটি বাচ্চা ছেলে। মহিলা বলল : আমি আপনাকে মূলত সাক্ষ্য দেবার জন্য ডাকিনি , বরং ডেকেছি এই উদ্দেশ্যে যে, হয় আপনি আমার সাথে মিলিত হবেন, অথবা মদ পান করবেন, অথবা এই বাচ্চাকে হত্যা করবেন । অন্যথায় এখানে কু-মতলবে এসেছেন বলে চিৎকার দিয়ে মানুষের কাছে আপনাকে বেইজ্জত করে ছাড়ব। অগত্যা আবেদ মদ পানেই সম্মত হল। তাকে এক গ্লাস মদ পরিবেশন করা হলে সে নেশাগ্রস্ত হয়ে আরো চাইল এবং এক সময় নেশার ঘোরে হত্যা করল বাচ্চাকে এবং মিলিত হল মহিলাটির সাথে। হযরত ওসমান রা. বলেন : অতএব তোমরা মদ থেকে বেঁচে থাক। কারণ উহা হচ্ছে সকল পাপাচারের মূল। কোন ব্যক্তির অন্তরে যদি ঈমান ও মদ্যপান একত্রিত হয় তখন একটি (মদ্যপান) অন্যটিকে ( ঈমানকে) বিদূরিত করে দেয়। (নসাঈ শরীফ।)।
কোরআন কারিমে মাদক নিষিদ্ধের বিষয়টি তিনটি ধাপে এসেছে। প্রথমে বলা হয়েছে, ‘লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, এতদোভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য অপকারও, কিন্তু এগুলোতে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২১৯)। দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হলো, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, এগুলো শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯০)।
সর্বশেষে ঘোষণা করা হলো, ‘শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদিগকে আল্লাহর স্মরণে ও নামাজে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯১)। সাহাবি হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের কিছু নিদর্শন হলো ইলম লোপ পাবে, অজ্ঞানতার বিস্তার ঘটবে, মদ্যপান ও মাদকের প্রসার ঘটবে, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে’ (বুখারি, প্রথম খণ্ড, হাদিস: ৮০)। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে মিরাজের রাতে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি দেখানো হয়েছে। ‘তিনি মদ, মাদক ও নেশা গ্রহণকারীদের শাস্তি দেখলেন। তারা জাহান্নামিদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে’ (বুখারি ও মুসলিম, মিরাজ অধ্যায়)। ফিকাহ তথা ইসলামি ব্যবহারিক বিধানমতে মাদক গ্রহণ হারাম হওয়ার পাশাপাশি তা অপবিত্রও। কোনো মুসলমানের মাদক ব্যবহার করা যেমন হারাম, অনুরূপভাবে তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ করা এবং ক্রয়বিক্রয় করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
মদ মানুষের বিবেক বুদ্ধি বিদুরিত করে। মাদকাসক্ত ব্যাক্তি বিশ্রী ও অশ্লীল কথা বলে। মাঝে মধ্যে গালাগালি করে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও ইসলাম ধর্মকে। আবার অনেক সময় অভিশাপ দেয় পিতা মাতা , স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনকে। মদ মানুষের অর্থ সম্পদ বিনষ্ট করার পাশাপাশি নষ্ট করে দেয় মানব দেহকে । এটি দেহকে দূর্বলতার এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিলুপ্ত হয়ে এতে সৃষ্টি হয় অনেক রোগের। মদ ও মাদক দ্রব্য আঘাত হানে হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, পেট, অন্ত্র, কিডনি ও মস্তিষ্কে। মাদকাসক্ত ব্যাক্তি বাস্তবতা বিবর্জিত কল্পনার জগতে বিচরণ করে , নিজকে মনে করে বীর বহাদুর, মহারাজ ও দানবীর। কিন্তু বাস্তবতার এক পর্যায়ে সে হয়ে যায় মোরগের চাইতেও দূর্বল, কুৎসিত ঝগড়াটের চাইতেও দুষ্ট, গাধার চাইতেও নির্বোধ এবং শুকরের চাইতেও নোংরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন