ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে রোজা। রমজান মাসব্যাপী রোজা রাখা প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষের উপর ফরজ। ইসলাম ধর্মের ইবাদতগুলো শুধুমাত্র ইবাদতই নয়; বরং প্রত্যেক ইবাদতের মধ্যে অন্তর্নিহিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও শিক্ষা রয়েছে। সেই শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইবাদত পালনের সার্থকতা। রমজান মাস মুসলমানের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা অর্জনের মাস। বিশেষ ইবাদত-বন্দেগী পালনের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে জীবনযাপনের জন্য নিজেকে তৈরী করার মাস।
রোজা আমাদেরকে আদর্শ জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো শিক্ষা দেয়। রোজার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো তাকওয়া অর্জন। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া বা পরহেজগারি অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত- ১৮৩)।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাঁর নির্দেশ পালন করা এবং সকল প্রকার মন্দকর্ম থেকে বেঁচে থাকার নাম ‘তাকওয়া’। যার অন্তরে যে পরিমাণ তাকওয়া আছে আল্লাহর কাছে সে ততটুকু মার্যাদাবান। আল্লাহভীতি মানুষকে সব ধরণের অনৈতিক কাজকর্ম থেকে বিরত রাখে। কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে, ‘প্রকৃত জ্ঞানীরাই আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করেন।’ অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে- যে মুত্তাকি তথা তাকওয়াবান।’ (সূরা হুজুরাত)।
রোজাদার একমাত্র আল্লাহভীতি বা তাকওয়ার ভিত্তিতেই রোজা রাখে। সে দিনের বেলায় প্রচন্ড ক্ষুধা থাকা সত্তেও লুকিয়ে পানাহার করে না। তৃষ্ণা থাকা সত্তেও পান করে না। প্রবল বাসনা থাকার পরেও স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় না। কারণ সে জানে লুকিয়ে মানুষের দৃষ্টির আড়াল করা গেলেও আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টি থেকে আড়াল করা যাবে না। তিনি সবকিছু দেখেন, জানেন এবং শোনেন। মানুষের অন্তরের এ অনুভূতিই হলো ‘তাকওয়া’। যে কোন অনৈতিক কাজে জড়ানোর আগে মানুষের অন্তরে যদি এরকম অনুভূতি জাগ্রত হয় তাহলে সে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার-অনাচার পাপাচার থেকে নিজেকে বিরত রাখবে।
রমজান মাস মানুষকে কুপ্রবৃত্তির দাসত্বমুক্ত থেকে উন্নত চরিত্র ও উত্তম গুণে গুণান্বিত হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোজা মানুষের ভেতর ও বাহির উভয় দিকের সংশোধন করে। মানুষকে ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও সুশৃঙ্খল পরিপাটি জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়। একজন রোজাদার প্রবল চাহিদা থাকার পরেও আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না। নিজের কামনা-বাসনাকে দমন করে। ধৈর্য্যরে সাথে ইফতারের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এক মিনিট আগেও ইফতার করে না। সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে সেহরি গ্রহণ, সময়মতো ইফতার গ্রহণ, যথাসময়ে তারাবিহ নামাজ আদায়সহ অন্যান্য নেক আমল পালনে সময়ানুবর্তী হওয়ার যে শিক্ষা রমজানকে কেন্দ্র করে পাওয়া যায় তার কিছুটাও সারা বছর চর্চা করতে পারলে মানবজীবন হবে আলোকিত।
রমজান মাস ইবাদতের সঙ্গে মুসলমানদের সখ্যতা-অভ্যস্ততা গড়ে তোলে। সাভাবিকভাবে আমরা দেখতে পাই, মানুষ কোন কাজ এক/দুই বার করলেই তাতে অভ্যস্ত হয় না, কিন্তু এই কাজটি ধারাবাহিকভাবে কয়েকবার করতে থাকলে ধীরে ধীরে এর প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যায়। মানুষকে ইবাদতে অভ্যস্ত করে তোলার জন্যই রমজান মাস। রমজানে মুসলমানরা এক মাসব্যাপী নির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী ইবাদত পলন করে সারা বছর ইবাদতের জন্য নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলে। রমজানে বিশেষ বিশেষ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে, সিয়াম সাধনা, সালাতুত তারাবিহ, ইফতার, ই’তিকাফ, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা, সহমর্মিতা প্রকাশ, শবে-কদরের সন্ধান, ওমরাহ পালনসহ বহু ইবাদতের বিধান রয়েছে এবং এসব ইবাদত পালনের মাধ্যমে বিশেষ সওয়াব লাভের সুযোগ রয়েছে। মুসলমানরা রমজানে এসব ইবাদাত পালন করে অধিক সোয়াব লাভ করে এবং সারা বছর এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে অনুপ্রাণিত হয়। এভাবেই রমজান মাসে ইবাদতের সঙ্গে মুসলমানদের সখ্যতা গড়ে ওঠে।
রোজা মানুষকে পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা-গীবত, মিথ্যাচার, প্রতারণা, খুন, গুম, সন্ত্রাস, ছিন্তাই-রাহাজানি প্রভৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মসংযম ও আত্মগঠনের শিক্ষা দেয়। রোজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের বাহ্যিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করা এবং তাঁর স্বভাব, চরিত্র, আচার-আচরণ সংশোধন করে নিজেকে উত্তমরূপে করে গড়ে তোলা।
রমজান মাস হচ্ছে কুরআন নাযিলের মাস। এ দিক থেকে রমজান মাসকে কুরআনের মাসও বলা হয়। এ মাসে কুরআনের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। মুসলমানরা এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করেন এবং কুরআনের বিধি-বিধান বুঝে সে অনুযায়ী জীবনযাপনের প্রয়াস চালায়। আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়ত এবং সৎ পথের ¯পষ্ঠ নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী।’ (সূরা বাকারা ১৮৫)। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত করে সেই সুপথপ্রাপ্ত এবং সেই প্রকৃত সফলকাম।
ধনীরা রোজা রেখে অনুভব করে একজন দরিদ্র মানুষ কত কষ্ঠে অনহারে অর্ধাহরে দিন কাটায়। এ ক্ষেত্রে ধনীরা দরিদ্রদের সাথে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে। ধরী দরিদ্র সকলেই সমান, এর মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই রোজা আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয়। প্রত্যেক রোজাদার একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি রিপু দমনপূর্বক রোজা পালন করেন। সুতরাং রোজার মাধ্যমে মানুষ পরমতসহিষ্ণুতা ও হতদরিদ্রের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা লাভ করেন।
পবিত্র রমজান মাসে এভাবে প্রশিক্ষণ লাভ করে নিজেকে একজন সৎ ও আল্লাহভীরু নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। আদর্শ জীবন গঠনের লক্ষ্যে সবাইকে অনুপ্রাণিত হতে হবে। রমজানের সার্বিক শিক্ষার আলোকে সারা বছর নিজের জীবন পরিচালিত করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক : জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন