শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে অধিক নজর দিতে হবে

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০২২, ১২:০৫ এএম

এটাই বাস্তবতা, শিক্ষা ছাড়া মানুষ ও জাতি অচল। শিক্ষার প্রাথমিক এবং মৌলিক ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা, যেখান থেকে মানুষের শিক্ষাজীবন শুরু। আর এই শুরুর ক্ষেত্রে যদি ভিত শক্ত না হয় তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় অন্ধকার নেমে আসবে, এটাই স্বাভাবিক এবং চিরন্তন। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা কী দেখছি? সম্প্রতি প্রাথমিক স্তরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরও সে হারে শিক্ষার্থী বাড়ছে না, বরং দিনদিন কমে আসছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার প্রারম্ভে এর ঘাটতির বিষয়গুলো আগে তুলে আনা প্রয়োজন। নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের এ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। তবে সে সমস্যা অনেকাংশেই সমাধানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, প্রান্তিক পর্যায়ের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অভিভাবকদের মাঝে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শিক্ষকসংকট, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শিক্ষার্থী সংকট। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে প্রাথমিক স্তরে ঝড়ে-পড়া অনেকটাই রোধ হয়েছে। কিন্তু এ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নানা সমস্যা।

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে রয়েছে বিভিন্ন ধারা। এর মধ্যে অন্যতম হলো কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। আবার মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন ধাঁচের। সম্প্রতি করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, গ্রাম পর্যায়ে প্রাথমিক স্কুল থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের অনিহার কারণে প্রতিদিনই শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। কেন এভাবে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে, এদিকে সরকারের নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে, সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে সরকারকে। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ, যত্রতত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও শিক্ষায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এদের মধ্যে অন্যতম। প্রচুর পরিমাণে অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের পরও শিক্ষাব্যবস্থা মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি কেন?

প্রথমেই আসা যাক শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে। সরকার প্রতিনিয়তই শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হলে প্রয়োজন শিক্ষকদের একটি ভালো মানের বেতনব্যবস্থা। প্রশ্ন হলো, সেটি আমরা দিতে পারছি কিনা। ২০১৯ সালের নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, নিয়োগের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিধিমালা অনুযায়ী, সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিরূপণ করা হয়েছে ¯œাতক বা সমমান এবং বেতন গ্রেড ১৩তম ( ১১০০০-২৬৫৯০) এবং প্রধান শিক্ষকরা একই শিক্ষাগত যোগ্যতা সাপেক্ষে (৬৫% পদোন্নতি ও ৩৫% সরাসরি) নিয়োগের মাধ্যমে ১০ (১৬০০০-৩৮৬৪০) গ্রেড প্রাপ্য হবেন। সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে (মহিলা ৬০%, পোষ্য ২০% ও অবশিষ্ট ২০% পুরুষ) কোটার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই বেতন স্কেলে আদৌ ভালো মানের শিক্ষককে আমরা এ পেশায় আকৃষ্ট করতে পারবো কি? শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হলে শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ব্যতীত শিক্ষার পরিবর্তন সম্ভব নয়। শিক্ষকদের মানোন্নয়ন বলতে আমরা সাধারণত বুঝি আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান বৃদ্ধি। কোনটাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্জিত হচ্ছে না।

বেশিরভাগ চাকরিপ্রত্যাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চেয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের করণীক হওয়ায় গৌরববোধ করেন। বর্তমান বেতন কাঠামো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণিতে পরিণত করেছে। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কেউ এ জায়গায় আসতে রাজি নয়। ভালো মেধার আগমন না ঘটলে ভালো মেধা তৈরি হবে না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। শিক্ষা একটি সম্মানজনক পেশা হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষকরা। উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে শিক্ষকরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজের পাহাড় জমে থাকে। সরকারের মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন কাজকর্মের সাথে যুক্ত রাখা হয় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের। ফলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শিক্ষকরা। এতে পাঠদানে বিঘœ ঘটে। প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি করে করণীকের পদ সৃষ্টি এখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। এছাড়াও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই চতুর্থ শ্রেণির যে পদটি সৃজন করা হয়েছিল তা থেকেও সুফল পায়নি অনেক প্রতিষ্ঠান। কারণ, প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হলেও সকল নিয়োগ হওয়ার পূর্বেই থেমে যায় এ প্রক্রিয়া।

এছাড়াও স্কুল পর্যায়ে এত পরিমাণে কাজ থাকে, যেসব কাজে প্রায় সময়ই অন্তর্ভুক্ত হতে হয় সহকারী শিক্ষকদের আর প্রধান শিক্ষকরা সপ্তাহের বেশি সময় জুড়েই অবস্থান করে থাকেন উপজেলা সদরে। প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজ থেকে মুক্ত করে ক্লাসে মনোযোগী করা একান্ত প্রয়োজন। সহকারী শিক্ষা অফিসারের শুন্য পদ পূরণ এবং পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করে স্কুল পরিদর্শনের ব্যবস্থা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রন্তিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে পরিদর্শনের পরিমাণ খুবই কম। শিখন পদ্ধতি আরো আধুনিকায়ন এবং শিক্ষকদের অধিকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। দ্বিতীয় ধাপে যে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে তা হলো, যত্রতত্র নিয়ম নীতি না মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। এ বিষয়ে সরকারের কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সরকারি স্কুলগুলোতে সকল শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিনা বেতনে অধ্যায়ন ছাড়াও বিশেষ সুযোগ দেওয়ার পরও কাম্য শিক্ষার্থী আসছে না। এমনকি অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তার সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না দিয়ে পাঠাচ্ছেন কিন্ডারগার্টেনে। ভাববার বিষয় যে, অনেক অভিভাবক এমন কি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের সন্তানদের নাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খাতায় এন্ট্রি করে উপবৃত্তির টাকা নিচ্ছেন কিন্তু ক্লাস করাচ্ছেন কিন্ডারগার্টেনে। এতে করে সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে। সাধারণ মানুষের মাঝে প্রশ্ন উঠছে শিক্ষার মান নিয়ে।

অথচ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক কম মেধাবীরাই কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করছেন। তারপরও মোটা অংকের ফি এবং বেতন দিয়ে কিন্ডারগার্টেনে পাঠাচ্ছি আমাদের সন্তানদের। তৃতীয়ত হচ্ছে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি। এই কমিটি থেকে শিক্ষাব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে কী পাচ্ছে তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। এসব কমিটি ব্যবস্থাপনা বাতিল নতুবা সময়োপোযোগী করা একান্ত অপরিহার্য। শুধু সমালোচনা নয়, এগিয়ে যেতে হবে সুন্দর ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সরকারের আর্থিক সক্ষমতার প্রশ্নও এখানে রয়েছে। অন্যদিকে সরকারের উচিত এসব অর্থ খরচ হিসেবে না ভেবে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা। বর্তমানে আর অবকাঠামোর দিকে নজর দেওয়ার চেয়ে মানোন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া একান্ত অপরিহার্য। বারবার কারিকুলাম পরিবর্তন না করে অন্যান্য দেশের সাথে তালমিলিয়ে আধুনিক একটি পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করাও একান্ত জরুরি।

লেখক: শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আহমদ ৩ জুন, ২০২২, ১:৫৮ এএম says : 0
শিক্ষার প্রাথমিক এবং মৌলিক ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা, যেখান থেকে মানুষের শিক্ষাজীবন শুরু। আর এই শুরুর ক্ষেত্রে যদি ভিত শক্ত না হয় তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় অন্ধকার নেমে আসবে
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন