দিল্লি জাওহার লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ সত্ত্বেও আফরিন ফাতিমাদের ডুপ্লেক্স বাড়িটি নিমেষেই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। ভারতের বর্তমান সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে একের পর এক বৈষম্যের নজির স্থাপন করে চলেছে। অথচ অধিকাংশ ভারতীয় জনগণ এমনটি পছন্দ করে না। বড় বড় হিন্দু আইনজীবীরা ফাতিমাদের পক্ষে মামলা লড়বেন বলে মিডিয়াকে জানিয়েছেন। বাড়ি ও পরে ধ্বংসস্তুপ হওয়া দুটি ছবি পাশাপাশি দিয়ে ফাতিমা লিখেন, শুধু আমাদের বাড়ি কেন, আমার ধরে নিয়ে যাওয়া পিতা মাতা ও ছোট বোনের এমনকি আমার নিজের জীবনের চেয়েও আমি আমার রাসূল (সা.) কে অধিক ভালোবাসি। আফরিন ফাতিমার সে টুইট বার্তাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি যারাই ইসলামী চেতনার কবর রচনার স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রজন্ম তাদের হতাশ করেছে। শাহবাগী যে ধারায় তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন, তাদের ধারণার বাইরে দেশব্যাপী চালু রয়েছে নিন্দা ও প্রতিবাদ। রাসূল (সা.) অবমাননার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ।
ঢাবিতে নাতে রাসূলের কর্মসূচি, পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন, বৃষ্টির মধ্যে শাবিপ্রবির মাঠে নাতে রাসূল (সা.), নটরডেম, ইডেন, ডুটেক্সসহ সারাদেশের শতশত স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের প্রতিবাদ মিছিল ছিল আলেম উলামা, মুসল্লিদের কর্মসূচির বাইরে। ইসলামী কর্মতৎপরতার সাথে যুক্ত লোকেদের বাইরে নবীপ্রেমের এ স্বতস্ফূর্ত নতুনধারা ভেতর থেকে বদলে যাওয়া পজিটিভ বাংলাদেশের রূপ। মহান রাব্বুল আলামীনের বাণী ওয়া রাফা’না লাকা জিকরাকার আধ্যাত্মিক বহিঃপ্রকাশ। নবীজীর ভালোবাসায় উজ্জীবিত বাংলাদেশই স্বাধীনতার অটুট গৌরব। নবীপ্রেমের এ ঐশী ফল্গুধারাই বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান রিজিওনের ৭০ কোটি মুসলমানের রক্ষাকবচ।
বিশে^র ১২০টি দেশে বহুল প্রচারিত প্রভাবশালী কুয়েতি নিউজ ম্যাগাজিন ‘আল মুজতামা’ আরব বিশে^ প্রাচীন ও নেতৃচরিত্রের মিডিয়া। চলতি মাসে এর কভার স্টোরি ছিল বিপন্ন ভারতীয় মুসলমান। রাজপথে একটি নামাজের জামাতের ছবি দিয়ে শিরোনাম করা হয়েছে, ‘ভারতীয় মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন’। ভেতরে স্টোরি শুরু হয়েছে ইতিহাসের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। বলা হয়েছে, বহু শতাব্দী আগে হিন্দুস্থানের সামুদ্রিক দস্যুদের কবলে পড়া নারীদের একজন সমুদ্র উপকূলেই চিৎকার করেছিল, ‘হে মুসলমানের খলিফা আমাকে উদ্ধার করুন’। এই বিপন্ন জাহাজের নারী কণ্ঠের চিৎকার লোকমুখে পৌঁছে গিয়েছিল বাগদাদে। খলিফার প্রাসাদে। তিনি সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন এবং এই জলদস্যুদের ধরে নারীশিশুদের উদ্ধার এবং ভারতের পশ্চিম দক্ষিণ অঞ্চলটি মুসলমানদের জন্য নিরাপদ করা হয়েছিল।
এর আগে ৭১২ ইংরেজিতে শাসক হাজ্জাজের যুগে তার সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করেন। দেবল বন্দর দখল করে তখনকার রাজা দাহিরকে পরাজিত করেন। মূলত এটিই মুসলমানদের হিন্দুস্থান বিজয়ের সূচনা। এরপর আরব, তুর্কি ও মধ্য এশিয় বিজেতারা সারা ভারত জয় ও শাসন করেন। কমবেশী ৯০০ বছর মুসলমানরা ভারতবর্ষকে নিজেদের সামগ্রিক অবদানে একটি অতুলনীয় সভ্যতা হিসাবে গড়ে তুলেন।
‘আল মুজতামা’য় বলা হয় আজকের ভারতে প্রায় ৩০ কোটি মুসলমান অস্তিত্ব বিলোপ ও নির্বাসনের মুখোমুখি। হেন অত্যাচার নেই, যা তাদের ওপর চলছে না। জান-মাল-নিরাপত্তা-মানবিক মর্যাদা অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এমন সময় তাদের সাহায্য করার মতো কোনো শক্তি কি পৃথিবীতে আছে? এখানে ভারতীয় মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা হয়েছে। ২০০ কোটির সামনে প্রশ্ন ছুঁঁড়ে দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নের জবাব মুসলিম উম্মাহ হয়তো খুঁজে বের করবে। তাছাড়া মানুষের তকদির তো কোনো শাসক বা শক্তি কর্তৃক লিখিত হয় না। তকদির তো লেখা হয়, আসমানে।
আল্লাহ বলেন, ‘ইন্নাল্লাজীনা ইউজূনাল্লাহা ওয়া রাসূলাহু লাআ’নাহুমুল্লাহু ফিদ দুনইয়া ওয়াল আখিরাতি ওয়া আ’আদ্দা লাহুম আযাবাম মুহীনা।’ অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লানত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অপমানজনক আযাব। (সূরা আহযাব : আয়াত ৫৭)।
বস্তুগত দৃষ্টিতে চিন্তা করলে এমন শক্তির খোঁজ পাওয়া যাবে না। তবে আল্লাহর অভাবনীয় কুদরতের ফায়সালার ওপর আস্থার আলোকে ভাবলে ঠিক সময়মতো সমাধান প্রত্যক্ষ করা যাবে। মুসলমানদের ঈমানী শক্তি আর সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিধানের প্রতি দৃষ্টি রাখলে এই প্রতীতি জন্মে যে, যুগে যুগে সীমালঙ্ঘনকারীদের যে পরিণতি হয়েছে, এ যুগেও তেমনই হবে।
নবী করীম (সা.) জানিয়েছেন যে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘মান আ’দা লী ওলিয়্যান, ফাকাদ আজানতুহু বিল হারব।’ অর্থাৎ, যে আমার প্রিয় বান্দার সাথে শত্রুতায় লেগে যায়, আমি আল্লাহ স্বয়ং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে দেই। উগ্রবাদী লোকজন ছাড়া সারা ভারত তার সন্তানদের সুন্দর সহাবস্থানই চায়।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বৃটিশ শাসন না এলে ভারতের বর্তমান এ রূপ দাঁড়াতো না। ভারতের দীর্ঘ ১৯০ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদানই উজ্জ্বলতর। বিগত ৭৫ বছর ভারত স্বাধীন। আলাদা রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ৩০/৩৫ কোটি মুসলমান বাদ দিলে কেবল ভারতেই এর সমপরিমাণ মুসলমান থাকা সম্ভব। কিন্তু শাসকদের সংবিধানবিরোধী আচরণ ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ভারতকে এক নতুন চেহারায় উপনীত করেছে। গত প্রায় ৭০ বছরের গণতান্ত্রিক ভারতের সাথে যার অমিল স্পষ্ট। ভারতীয় শাসনতন্ত্রের উদার ও বহুমাত্রিকতা ইদানিং নিতান্ত পর্যুদস্ত।
মুসলিমদের শত শত বছরের প্রিয় মাতৃভূমি যা হযরত নূহ (আ.) এর বংশধর কর্তৃক প্রথম আবাদকৃত সুন্দর প্রকৃতির দেশ। বলা হয়, সিন্দ এবং হিন্দ নাম দু’টোও হযরত নূহ (আ.) এর সন্তানদের রাখা। এরপর পৃথিবীর নানা জাতি এখানে এসে দখল ও বসত গড়ে। মুসলিম বিজয়ের পর থেকে এখনও পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষ মুসলমান ধর্মপ্রচারক, পীর-আউলিয়া, দরবেশ, উলামা-মাশায়েখ, শাসক ও গুণীবুদ্ধিজীবীদের স্নেহ, মায়া-মমতা ও উচ্চতর মানবিকতার প্রবহমান ধারায় নিষিক্ত।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের এক ইঞ্চি জমিও এমন নেই, যেখানে গত হাজার বছরে ইসলামের ভাবসম্পদ ও সংস্কৃতি চর্চা হয়নি। কেবল ভারতেরই আসমুদ্র হিমাচল মানচিত্রে লাখো পীর মাশায়েখের জীবন চর্চার শিক্ষা ও আলো চির সঞ্জীবিত রয়েছে। তাতারিরা যখন আরবে মুসলমানদের রাজধানী ও অন্য অনেক ভূখণ্ড দখল করে নেয়, তখন হেজাজ ও মিশর ছাড়া মুসলিম বিশে^র আর কোনো আশ্রয় ছিল না। তখন মুসলিম উম্মাহর গৌরবময় ও নিরাপদ বৃহৎ আশ্রয় ছিল এই উপমহাদেশ।
ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দনি খিলজি ও সুলতানুল আউলিয়া খাজা নিজামুদ্দীন (রহ.) এর সময়কালটি দেখলে ভারতের প্রতি মুসলমানের অবদান সহজে বোঝা যাবে। এরও বহু আগে নবী করীম (সা.) এর পবিত্র রওজা শরীফ থেকে সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) যখন হিমালয়ের দেশটিতে প্রবেশ করেন। লাহোরের দাতা গঞ্জ বখশ হযরত আবুল হাসান আলী ইবনে উসমান হুজবিরি (রহ.) এর মাজারের খাস কামরায় খাজা চিশতি সাঞ্জারী (রহ.) চিল্লা শেষ করে নিজ পীর হযরত উসমান হারুনী (রহ.) এর নির্দেশনায় আজমীরে এসে আস্তানা গাড়েন। তখনই ভারতবর্ষের মানচিত্রে আধ্যাত্মিক অনপনেয় ছাপ মেরে দেওয়া হয়। পরবর্তী সকল যুগের সব শাসক সে দৃষ্টিকোণ থেকে খাজা আজমিরীকে উন্নত ও আধুনিক ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের প্রতীক ‘সুলতানুল হিন্দ’ স্বীকার করে এসেছেন।
এই প্রথম উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক খাজা আজমিরীর মাজার, মসজিদ ও খানকাহকে প্রাচীন মন্দির আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভারতের আরও অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ, স্মৃতিসৌধ, মিনার, স্থাপনা দখল ও উচ্ছেদের ছক তৈরী হচ্ছে। ভারতের ৩০/৩৫ কোটি মুসলমানকে নির্মূলের ভাবনা কল্পনাও জোরদার হচ্ছে। যদিও মানুষ নিজেকেই সর্বশক্তির অধিকারী মনে করে বারবার ভুল করে থাকে।
তবুও একথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া কর্তব্য যে, মানুষ মূলত সবচেয়ে অসহায় ও দুর্বল সৃষ্টি। আল্লাহ সুযোগ শক্তি ও সামর্থ্য দান করেন বলে সে নিজেকে শক্তিমান মনে করে। যখন আল্লাহ তাকে ধরেন তখন তার এই পাকড়াও ধারণা কল্পনার বাইরে হয়ে থাকে। কোন্ কোন্ দিক দিক দিয়ে যে দাম্ভিকদের সর্বনাশের আসমানী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে তা কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই জানেন। ইচ্ছা করলে পৃথিবীর মাটির নিচে সমাহিত বড় শক্তিগুলোর ইতিবৃত্ত থেকেই মানুষ শিক্ষা নিতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন