বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

বাসর

ফরিদা হোসেন | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

বাসর ঘরে তখন মধ্যরাত।
বাইরে শুক্লপক্ষের জোছনার প্লাবন।
ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে পুরো ঘর।
পালঙ্ক দরজা জানালা সব-সব কিছু।

হাঁটুতে থুতনী রেখে বসে আছে নববধু লুনা।
পরনে ঝলমলে বিয়ের শাড়ী।
গা ভর্তি গয়না।
খোঁপায় বেলকুড়ির গাজরা দু’চোখের পাপড়ি একজনে বিশেষ কারো অপেক্ষা আর ঘুমে, ঢুলু ঢুলু...।

চাতালের ওধারে ছেলে মেয়েদের গানের আসর চলছে।
কিছু টুকরো কথা... কারো কারো। উপস্থিত হাসি...খান বাড়ির বাতাসকে যেন চঞ্চল করে তুলেছে।

দরজা খোলার শব্দ হলো।
চমকে ওঠার সাথে সাথে শিহরিত হলো লুনা।
চোখের পাতা বন্ধ করলো চেপে।
একটু পরেই এবার দরজা বন্ধ করবার শব্দ। সাথে সাথে কলকলিয়ে উঠলো একপাল মেয়ের হাসি আর চুড়ির রিনিঝিনি।
বুকের ভেতরটা কেমন ধুক ধুক করতে লাগলো-
একসময় পালঙ্কের দিকে এগিয়ে এলো বরবেশী জয়।
সুদর্শন। সুপুরুষ।
লুনা তখনো ঘামছে। অনুভব করছে একজনের উপস্থিতি।
এক সময় নববধু লুনার মাথার কাপড়টা সরিয়ে দিল জয়। কেমনভাবে যেন দেখতে লাগলো। চোখ বুজে কম্পিত বুকে অপেক্ষা করতে লাগলো লুনা একটি অনাঘ্রাত ¯পর্শের জন্যে।
কিছুক্ষণ পার হয়ে গেল। কিন্তু আর এগিয়ে এলোনা জয়।
এবার অনেক সাহস করে বিস্মিত এবং কম্পিত চোখ তুললো লুনা।

কোথায় যেন বাজ পড়লো-
নাকি সর্বনাশ সামুদ্রিক ঝড়ে তলিয়ে যাচ্ছে সব কিছু।
মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত...। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তলিয়ে যেতে যেতেই সম্বিৎ ফিরে পেল লুনা।
ওর বিস্মিত চোখ দেখলো-
অদ্ভুত ধরনের অপ্রকৃতিস্থ একজনকে।
কেমন অস্বাভাবিক দৃষ্টি নিয়ে ওকে দেখছে বর বেশী সুদর্শন মানুষটি।
লোল পড়ছে ঠোঁটের একপাশ দিয়ে।
অষ্পুট শব্দ করে পিছিয়ে গেল লুনা। কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে না তো।
একি করে সম্ভব...।

যে সুদর্শন সুঠাম দেহী যুবকটার ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল লুনা। প্রথম দৃষ্টিতেই ভালোবেসে ফেলেছিল ছবির অদেখা মানুষটিকে।
একি সেই...?
না-না-না, এ হতে পারে না কিছুতেই না।
বিছানা থেকে নেমে একছুটে দরজার দিকে গেল লুনা।
ওর মনে হলো এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে যাবে সে।
দরজার সাথে পিঠ দিয়ে একেবারে সেটে থাকলো লুনা। আতঙ্কে গোঙ্গানীর কতো কেমন এক ভয়ার্ত শব্দ বের হতে লাগলো ওর মুখ দিয়ে।

এক সময় পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে এলো জয়।
দাঁড়ালো একেবারে লুনার মুখোমুখী।
তখনো অদ্ভুতভাবে গোঙ্গাচ্ছে লুনা এবং একসময় কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে দরজার সামনে।

বাইরের হট্টোগোল তখন অনেকটা কমে এসেছে। নিভে গেছে কিছু কিছু রঙিন আলো।
বার কয়েক ডেকে ঘুমিয়ে পড়েছে এ বাড়ির প্রহরী কুকুর দুটোও।
সারা দিনের হৈ চৈ এ ওরাও যেন বড় ক্লান্ত।

লুনার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন প্রায় শেষ রাত।
দু’ একটা বাদুর বার কয়েকবার ডানা ঝাপটালেও সব পাখিদের ঘুম তখনো ভাঙেনি।
লুনার পরণে তখনো নববধুর সাজ।
গা ভর্তি গয়না।
বেনারসী শাড়ি।
কিন্তু চোখের পানি আর চন্দনের ফোটায় মাখামাখি হয়ে লেপ্টে গেছে সারা মুখে।
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। চোক খুললো অনেক কষ্টে।
চারদিকে তাকালো বার কয়েক।
এবং তারপরেই উঠে বসলো প্রায় লাফ দিয়ে ।
আবার শিহরিত হলো ভয়ে।
দেখলো পায়ের কাছে কেমন গুটি সুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে জয় নামের মানুষটি।

বিস্ময়ে হতবাক লুনা।
মাথার ভেতরটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো ওর।
মনে করতে চেষ্টা করলো।
কি ঘটেছিল কাল রাতে? কি করে আবার বিছানায় এলে? আসলেই কি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেছিল...? নাকি কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছিল লুনা...?
কেন যেন এমন হলো?
একসময় বিছানা থেকে নেমে ঘরের একপাশে সোফায় দু’পা তুলে জড়োসড়ো হয়ে বসলো লুনা।
মাথা তখনো ঝিমঝিম করছে।
ঘরের ভেতরের এতো জেলুস...ফুলের সুরভি...বিয়ে নামের এই ঝলোমল ঘনঘটা...। কী মানে আছে।
এর...? কেন-কেন এতোবড় প্রতারনা হলো? কেন কেন?
অশ্রান্ত কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো লুনা।
কি অপরাধ ছিল ওর?
জীবনের বহু অনাকাঙ্কিত আর অপেক্ষিত স্বপ্নের চরম অপমান আর পরাজয়ের গ্লাানিতে একেবারেই ভেঙ্গে পড়লো লুনা।

অপ্রত্যাশিত কান্না আর ক্লান্তিতে কেমন যেন অবশ হয়ে আসছিল পুরো শরীর।
বড্ডো তেষ্ণাও পেয়েছিল লুনার। কিন্তু শক্তি ছিলনা উঠে জগ থেকে পানি ঢেলে খাবার।
এক সময় ক্লান্ত-শ্রান্ত লুনা আবার এলিয়ে পড়লো সোফায়...।
সকাল হলো কয়েক ঘন্টা পরেই।
চারদিকের গাছ গাছালিতে নরম রোদের ঝিলিমিলি।
জেগে উঠেছে প্রহরী কুকুর দুটোও।
টুকটাক কথা বার্তা এবং সেই সাথে মেয়েলি হাসির শব্দ।
বার কয়েক টোকা পড়লো দরজায়।
ঘোরের মতো লাগলো লুনার। একটু পরেই ধড়ফড়িয়ে উঠে সচকিত হয়ে চারদিকে তাকালো।
না দরজা বন্ধ।

কিন্তু
কিন্তু একি।
ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলো লুনা। দেখলো ওর পায়ের কাছে, সোফার ওপরে মাথা রেখে, মাটিতে বসেই ঘুমিয়ে আছে জয়।
বিস্ময়ে স্তব্দ হয়ে গেল লুনা...।

কী হচ্ছে এসব?
কী মানে হয় এর?
কী করবে এখন সে?

সোফা থেকে নেমে নিচে মাটিতে জয়ের পাশে বসলো লুনা।
দেখলো কি নিষ্পাপ আর নিশ্চিন্ত একটা মুখ।
কি পরম নিশ্চিন্তে চোখ দুটো বোজা। কপালের ওপর পড়ে আছে একরাশ এলোমেলো চুল।
লুনা লক্ষ্য করলো এক হাতে সোফার ফোমটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে জয়। যেমন করে কেউ ভয় পেয়ে কাউকে আশ্রয় করে ধরতে চায়।
বুকের ভেতরটায় যেন কেমন করতে লাগলো লুনার।
এই কি সেই মানুষটা...?
গত রাতে বর বেশে যাকে দেখে একেবারেই অপ্রকৃতস্ত মনে হয়ছে ওর?
মনে হয়েছে এ যেন এক দুঃস্বপ্ন।
কি করবে লুনা এখন?
ওকি চিৎকার করে বিদ্রোহ করবে?

বাপ-মা মরা এতিম মেয়ে। অবহেলা আর অনাদরে মানুষ হয়েছে মামার বাড়িতে।
গলগ্রহের মতোই ছিল সে।
বাপের সাথে গুণের ও সুখ্যাতি ছিল লুনার।
অনেক ছেলের দৃষ্টি ছিল ওর দিকে। কিন্তু কোনদিন প্রশ্রয় দেয়নি কাউকে।
মন কখনো বেসামাল হতে চাইলেও অত্যন্ত কঠিন ভাবে নিজেকে সামলে নিয়েছে লুনা। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে।
মামা মামীর ইচ্ছার দাম দিয়েছে সবচে আগে।
আর সেই জন্যেই তাদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসেই এ বিয়েতে মত দিয়েছে সে। কিন্তু তাই বলে এতোবড় প্রতারণা...?
কি করে-?

কি করে মানুষ করতে পারে এতো বড় অন্যায়?
নড়ে চড়ে উঠলো জয়।
নিজেকে সামলে নিল লুনা।
চোখ খুলেই লুনার দিকে তাকালো জয়। ঘাড় কাত করে ওর দিকে তাকালো বার কয়েক।
তখনো গালের একপাশ দিয়ে লালা পড়ছিল একটু একটু করে।

লুনা টেবিলে রাখা একটা টিস্যু পেপার দিয়ে ঠোঁটের পাশটা মুছিয়ে দিল স্বযত্নে। আর অমনি চট করে ওর হাতটা ধরে ফেললো জয়। চমকে উঠলো লুনা।
একটু হাসলো জয়।
নিষ্পাপ শিশুর মতো সে হাসি। সে হাসি যেন কাঁপিয়ে দিল লুনাকে। বুকের কোথায় কি যেন একটা ঘটে গেল।
ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলো লুনা।
দরজায় টোকা পড়লো দু’বার। চমকে উঠলো দু’জনেই।

ভয়ানক দৃষ্টি নিয়ে লুনার শাড়িটা খামচে ধরলো জয়।
আর ঠিক তখনি মুহূর্তের মধ্যে ওলট পালট হয়ে গেল লুনার পৃথিবীটা।
খুঁজে পেল যেন জীবনের মানে।
হঠাৎ করে দু’হাতে অসুস্থ জয়ের মাথাটা বুকে আঁকড়ে ধরলো লুনা এবং অসংখ্য চুম্বনে ভরিয়ে দিল ওর চোখ মুখ।
লুনার মনে হলো কোথায় যেন জলতরঙ্গ বাজছে।
টুং টাং... টুংটাং...।
নাকি অশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি?
ভাবলো পরিবারের প্রতারনার শিকার হলেও একজন অসহায় নিষ্পাপ মানুষকে তো সে বুকের মাঝখানটিতে আশ্রয় দিতে পেরেছে।
আর এটাই যেন ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন