মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানুষ ও গণতন্ত্রের মুক্তি সমান্তরাল

আবদুল আউয়াল ঠাকুর | প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কদিন আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি ছবি বেশ মন কেড়েছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্যালোক উদ্ভাসিত হচ্ছে, ছবির বিষয়বস্তু এটাই। ছবি যে কথা বলে সেটা এ ছবি না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই। হেমন্তের সকালে কুয়াশা ভেঙে আলো ঠিকরে পড়ছে, এতে এমনিতে হয়তো আলাদা করে ভাবার কিছু ছিল না। তবে দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির খরবটি পাওয়ার পর মনে হলো এ ছবির আলাদা কিছু অর্থ হলেও হতে পারে। মানুষের মুক্তি, গণতন্ত্র আজ যে স্বেচ্ছাতন্ত্রের কুয়াশার চাদরে আবৃত, সেখান থেকে মুক্তির একটি পথও হয়তো বেরুচ্ছে। মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারযুগ শুরু হয়েছিল একজন বিচারপতির মানহানি হয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে। যদিও সেই বিচারপতি সম্মানজনক অবস্থায় বিদায় নিতে পারেননি। সে কথা থাক। মাহমুদুর রহমান মুক্তিও পেলেন সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে। এ দফায় ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সকালে ফজরের নামাজের সময় তাকে রাজধানীর কাওরানবাজারের আমার দেশ অফিস থেকে আটক করা হয়েছিল। এরপর তার বিরুদ্ধে ৭০টি মামলা রুজু করা হয়েছিল। তিন বছর সাত মাস কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্তি পেয়েছেন। তার এবং গণতন্ত্রের দাবিদারদের দীর্ঘ কারাবাসের মধ্য দিয়ে যেসব মৌলিক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে তার একটা বড় দিক হচ্ছে আদালতের স্বাধীনতা। অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে কার্যত মানুষের ও গণতন্ত্রের মুক্তি থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ কম। কারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে ন্যায়বিচারের কোনো বিকল্প নেই। ন্যায়বিচার নির্ভর করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর। এ কথার প্রতিধ্বনি করেছেন খোদ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বিচার বিভাগের বর্তমান অবস্থা আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও কার্যকরভাবে পৃথক হয়নি বিচার বিভাগ। বিচারকদের নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতি সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ এখনো নির্বাহী বিভাগের হাতে। পৃথককরণের আগে এ দায়িত্ব ছিল সংস্থাপন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। এখন সেটি নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বাধীন আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। মাজদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা থাকলেও বিচার বিভাগ পৃথকের ৯ বছরেও স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে না থাকায় দ্বৈত শাসন সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতির অবসানে ১৯৭২-এর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রবর্তন চান প্রধান বিচারপতি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্তরায় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আইনজীবীরা মনে করেন, যতদিন রাজনৈতিক বিবেচনায় সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগ করা হবে ততক্ষণ বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে না। নি¤œ আদালতে সরকারি প্রভাবের প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, নিম্ন আদালতের বিচারকগণ এখন পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যতক্ষণ নিম্ন আদালতের ওপর সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণ তদারকি প্রতিষ্ঠিত না হয় ততক্ষণ নিম্ন আদালতের কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্তরায় হিসেবে প্রধান বিচারপতি এবং সপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের মধ্যে মতের ঐক্য রয়েছে। সকলেই মনে করেন, বিচারপতি নিয়োগ এবং নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলির বিদ্যমান ব্যবস্থা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার একটি বড় অন্তরায়। বোধকরি সাম্প্রতিক জামিনে মুক্তির যে কটি ঘটনা ঘটেছে তার নির্মোহ পর্যালোচনা করলেও একই সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে যে, আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলেই প্রকৃতপক্ষে বোঝা যেত যাদের কপালে দুর্ভোগ হলো তারা আসলেই কতটা অপরাধী। সে কারণেই প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর যে গুরুত্ব দিয়েছেন তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে মানুষ ও গণতন্ত্রের মুক্তির পশ্ন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি নিয়ে এখনো নানা আলোচনা চলছে। তবে এ কথা ঠিক যে, এ ব্যাপারে হয়তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত উচ্চতর আদালতকেই নিতে হবে।
একটি দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি কী রূপে রয়েছে তা নির্ধারণ করা হয় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিরিখে। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবস্থা জানার জন্য কোনো অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। দেশের কারাগারগুলোতে এখন পর্যন্ত যারা বন্দী রয়েছেন তাদের প্রায় সকলেই রাজনৈতিক বন্দী। তাদের প্রধান অপরাধ তারা দেশে একট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চেয়েছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই মিডিয়ায় বিএনপির দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে তথাকথিত সন্ত্রাসের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের দায়ের করা এসব মামলার সূত্র-উৎস হচ্ছে ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর বিএনপি তথা গণতান্ত্রিক শক্তি দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে অবরোধ করেছিল। সেই অবরোধে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ নেতাকর্মীরা রাস্তায় নামতে না পারলেও তারাই নাকি সন্ত্রাস করেছে। এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যদি গণতন্ত্র রক্ষার বিবেচনায় রচিত হয় তাহলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এবং প্রতিষ্ঠায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং বেগম জিয়ার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। বোধকরি বিশ্বের রাজনৈতিক নেতাদের টিকে থাকার মতো কোনো সফলতার যদি বিবরণ তৈরি করা হয় তাহলে ও সেখানে বেগম জিয়ার সুনির্দিষ্ট অবস্থান রয়েছে। এক কঠিন বাস্তবতায় তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নিয়োজিত হয়েছিলেন। একসময়ে দলের অনেক প্রবীণ নেতা তাকে ও বিএনপি ছেড়ে সামরিক স্বৈরাচারের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। অনেকে তখন হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবে বেগম জিয়ার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অবিচলতাই শেষ পর্যন্ত বিজয় এনে দিয়েছিল। অনেক তাকে তুলনা করেন কোরজন এ্যাকুইনের সাথে। ফিলিপিনের দোর্দ- প্রভাবশালী স্বৈরাচার মার্কোসকে অপসারণে তার ভূমিকার কথা অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সেই আপসহীন নেত্রী বেগম জিয়াকে এখন আদালতের মুখোমুখি করা হচ্ছে গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকা-ের অভিযোগে। এ পর্যন্ত কত হাজার মানুষকে এ অভিযোগে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে, তার ঠিক প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া কষ্টকর হবে। দেশে প্রকৃত অর্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে হয়তো এসবের একটা সুরাহা করা যেত। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, হয়তো এসব করারই কোনো সাহস সংশ্লিষ্টদের থাকত না। এখন পর্যন্ত যা আলামত তাতে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনে কোনো লক্ষণ স্পষ্ট নয়। তবে আশাহত হওয়ারও বোধহয় কারণ নেই। আলো দেখা যাচ্ছে। বিবেচনাতেই বলা যায়, মৌলিক সমস্যার সমাধান মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে করতে হবে। সেভাবেই দেখতে হবে গণতন্ত্রকে। কারণ গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখন পুরো বিষয়কেই আওতাভুক্ত করা প্রয়োজন। একটি শক্তিশালী বিচার বিভাগ থাকলে এমনিতেই দেশ থেকে অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র তো সংবিধানের আলোকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে নাগরিকদের ভোটাধিকারের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কী হচ্ছে না এটা দেখভালের এখতিয়ারই রয়েছে বিচার বিভাগের।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপ সুনির্দিষ্ট একটি বার্তা দিচ্ছে নির্বাচনের। গত কয়েক মাস থেকে সবার মুখে রয়েছে নির্বাচনের প্রসঙ্গ। ভোট চাইতে নেতাকর্মীদের বলা হচ্ছে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যেতে। ‘সরকারি বিরোধী দল’ চিহ্নিত জাতীয় পার্টি প্রায় দুই মাস আগে সিলেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকা বিএনপি স্বাধীন ও শক্তিশালী নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব দিয়েছে। এদিকে অর্থমন্ত্রীও সাংবাদিকদের সরকারি দলে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর কথা জানিয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, সময় এবং সুযোগ পক্ষে থাকলে নাটকীয়ভাবে আওয়ামী লীগ আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারে। যাই হোক, সাধারণ মানুষ সব দলের অংশগ্রহণভিত্তিক গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনে ভোট দিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কারণ অনেক দিন তারা নির্বাধে ভোট দিতে পারছে না। অন্যদিকে আগামী জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশ্ব দরবারে অবস্থান, ইইউর জিএসপি প্লাস, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ইমেজ। বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক মহল, জাতিসংঘসহ দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো বাংলাদেশে ইনক্লুসিভ নির্বাচনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই তৎপরতা শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনকে যেমনি প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নবিদ্ধ দেখতে চান না তেমনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে সে জন্য নতুন প্রস্তাবনা দিয়েছেন। সংবিধানের আলোকে নতুন নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে দলের চেয়ারপারসনের দেয়া প্রস্তাব রাষ্ট্রপতিকে দেয়ার জন্য সময় চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সব রাজনৈতিক দলের কাছেও এ প্রস্তাব পাঠানো হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। এ জন্যই প্রস্তাবটি আমরা তার কাছে দেব। বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের পরপরই সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও দেশের সুধী সমাজ এবং বোদ্ধামহল মনে করছে, এই প্রস্তাব নিয়ে ভাবার রয়েছে অনেক কিছু। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রস্তাবকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন এটা ভালো দিক। সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। সার্চ কমিটি গঠন ও আইন না করা পর্যন্ত এটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকার ভেবে দেখতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকারও গঠন করা যেতে পারে। তারা মনে করেন, আইনের বাইরে অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় কমিশন গঠন করা হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। আমাদের সংবিধানেই নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে। তারা মনে করেন, বেগম জিয়ার দেয়া প্রস্তাবনার মাধ্যমে আলোচনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এই প্রথমবার দেশের আমলা-বিচারপতিদের বাইরে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্য থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিয়ত বাস্তবায়নেই সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সমঝোতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলেও ওই রায়ে অন্তত আরো দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন করার কথা বলা হয়। প্রস্তাবনার পরপরই সরকারের কোনো কোনো মহল যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তাতে মনে হয়েছে হয়তো তারা কপি আগেভাগে পেয়ে প্রতিক্রিয়া লিখেই রেখেছিল। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া মূলত একটি নতুন প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। বিষয়টি হলো, সরকার কি আদৌ নির্বাচন করতে চায়? কারণ নির্বাচন করতে হলে তাকে গণতন্ত্রপন্থিদের সাথে অবশ্যই আলোচনায় বসতে হবে। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে অবশ্যই নির্বাচন ঘোষণার আগেই এ নিয়ে সকলের সাথে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যাপারটি চাপিয়ে দেয়ার নয়। সরকারের দিক থেকে বারবার বলা হচ্ছে, সংবিধানের বাইরে তারা কোনো কিছু করতে পারেন না। এ বিবেচনা থেকেই মূলত আগামী নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার দিকটি ভাবা হচ্ছে। সে বিবেচনায় একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ব্যাপারটি কেবল রাজনৈতিক দিক থেকেই দেখার সুযোগ নেই। দেশের অর্থনীতির বিবেচনাতেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ব্যবসায়িক পরিবেশ ভালো না থাকায় দেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ছে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যারোমিটারেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ২০১৪ সালের অগ্রণযোগ্য নির্বাচনের পর থেকেই দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। নীতিগতভাবে এর সাথে সরকারও যে একমত তা পরিষ্কার হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে অবশ্যই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সাথে যারা যুক্ত থাকবেন তাদের ঐকমত্য প্রয়োজন। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী অতিবাহিত হতে যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র ব্যবস্থা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারেই ঐকমত্য হওয়া যায়নি। সে কারণে সংবিধানের আলোকে রাজনৈতিক দল ও জনমতের সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে এ জন্য উচ্চতর আদালতের শরনাপন্ন হওয়া যেতে পারে। যেহেতু অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সংসদ গঠিত হয়েছে তাই বিষয়টি সংসদের হাতে ছেড়ে দেয়ার মতো বাস্তবতা নেই। বর্তমান যে বাস্তবতা তাতে ঐকমত্য বা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিস্থিতি হুট করে হওয়ার নয়। এটি এক বৈঠকেরও বিষয় নয়। ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে, সংবিধানের আলোকে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা না হলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়াবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। বর্তমান পরিস্থিতি তখনকার চেয়ে আরো খারাপ। যেহেতু সকল মহলই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে রয়েছে, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর কথাও বলা হচ্ছে সে কারণে নির্বাচন কমিশনের বিষয়টি দ্রুতই ফয়সালা হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের একগুঁয়েমি গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় এটা বলা যায়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা গেলে এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো মানুষের ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা যেতে পারে। তবে প্রতিবেশী মিয়ানমারের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে বোধকরি তা ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। গত কদিন ধরে সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে তা কিন্তু সেদেশে সেনাশাসন থেকে সদ্যই মুক্তি পাওয়া গণতন্ত্র তাদের রক্ষা তো করছেই না বরং আরো বিপন্ন করেছে। সেখানে সামরিক শাসন থাকার সময়ে যারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের জান-মাল-ইজ্জত লুটে নিয়েছিল সেই সেনাবাহিনীকেই লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। অং সান সুচিসহ বিশ্বে অনেকেই রয়েছেন যারা শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। অথচ মিয়ানমারে চলমান গণহত্যা নিয়ে তারা কোনো কথা বলছেন না। বোঝা দায় নোবেল দেয়ার সময়ে কী মন্ত্র তাদের কানে ঢেলে দেয়া হয়েছে। এটি প্রমাণ করছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও মিয়ানমারের সরকার নয় বরং চীনের সরকার তাদের দরজা খুলে দিয়েছে নির্যাতিদের জন্য, যা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা সেভাবে পরিনি। বাংলাদেশে যে ধরনের বিভাজন নীতি চলছে আজকের প্রেক্ষাপটে সেটিও ভাবতে হবে। চূড়ান্ত বিবেচনায় এটাই সত্যি যে, ন্যায়বিচার সাম্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে কার্যত কোনো উন্নয়নকেই উন্নয়ন বলা যাবে না। সব কিছু মিলে মানুষের আত্মিক উন্নয়নই হলো শেষ কথা। কারণ মানুষের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়।
awalthakur@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন