হজ ও কুরবানির মতো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মওসুম আমাদের মধ্য থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছে। যা আমাদের মধ্যে তাওহীদ ও ইবাদতের পুণ্যময় বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। এ মওসুমটি পুরোটিই ছিল আল্লাহ তাআলার যিকির ও ইবাদতের এক বিশেষ মওসুম। আল্লাহ তাআলার তাকবীর ও বড়ত্ব বর্ণনার মওসুম। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তাঁরা যিলহজ্বের প্রথম দশ দিনে বাজারে গিয়ে তাকবীর পাঠ করতেন। তাদের অনুসরণে অন্যরাও তাকবীর পাঠ করত। এই উম্মতের বৈশিষ্ট্যই তো হচ্ছে আল্লাহ তাআলার হাম্দ ও যিকির। তারা সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার হাম্দ ও যিকিরের মধ্যে থাকবে।
সাধারণ যিকির ও তাসবীহের নির্দেশনার পাশাপাশি এ সময় ছিল বিশেষভাবে তাকবীরে তাশরীকের বিধান। নয় যিলহজ ফজর থেকে ১৩ যিলহজ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর একবার তাকবীরে তাশরীক পাঠ করার বিধান নারী-পুরুষ সবার জন্য ছিল। ‘তাকবীরে তাশরীক’ যে বাক্যসমূহকে নির্দেশ করে- তাতে যেমন তাকবীর আছে, তেমনি আছে তাহলীল ও হাম্দ।
তাকবীর অর্থ আল্লাহু আকবার বলা, তাহলীল অর্থ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা। আর হাম্দ হচ্ছে, আল্লাহর প্রশংসা- এই তিন মহান যিকিরের সমষ্টির নাম তাকবীরে তাশরীক : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বড়, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই আর তাঁরই জন্য সকল প্রশংসা।
আমাদের কর্তব্য আল্লাহ তাআলার যিকির ও তাওহীদকে আমাদের গোটা জীবনের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা। আল্লাহ তাআলাকে যে স্মরণ করে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁকে স্মরণ করেন, আল্লাহ তাআলাকে যে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তাকে পথ দেখান। আর আল্লাহ তাআলার ওপর যে ভরসা করে আল্লাহ্ই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণসমূহ অর্জন করা তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে যারা আল্লাহকে ভুলে যায়, আল্লাহ তাদের আত্মবিস্মৃত করে দেন। তারা তাদের কল্যাণ ও কল্যাণের পথ থেকেই গাফেল হয়ে যায়, নিজের পরিণাম চিন্তা থেকে উদাসীন হয়ে ক্ষণস্থায়ী পার্থিবতার মোহজালে আটকা পড়ে যায়। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা তাঁর ঈমানদার বান্দাদের সম্বোধন করে হুঁশিয়ার করেছেন : হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামী দিনের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে আল্লাহ তাদের আত্মবিস্মৃত করেছেন। তারাই তো পাপাচারী। (সূরা হাশর : ১৮-১৯)।
যিলহজের এই যিকির ও তাকবীরের মওসুম যেন আমাদের বিশেষভাবে আল্লাহকে স্মরণ করার, তাঁর প্রতি সমর্পিত হওয়ার, তার বড়ত্ব ও মহত্ত¡কে স্মরণ করার শুধু বার্তাই নয়, প্রশিক্ষণও দিয়ে গেল। আল্লাহ তাআলার যিকির ও ইবাদতের এই প্রশিক্ষণকে আমলে নিয়ে আমরা যদি আমাদের গোটা জীবনকে যিকরুল্লাহর জীবনে পরিণত করতে পারি তাহলে আমাদের জীবনটি ইনশাআল্লাহ যথার্থ জীবন হবে। যে জীবনে জীবনদাতার স্মরণ নেই, তাঁর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা নেই, তাঁর আদেশের মান্যতা ও আনুগত্য নেই সেই জীবনকে কিভাবে যথার্থ জীবন বলা যায়?
যে হৃদয়ে আল্লাহর স্মরণ নেই সে হৃদয় মৃত, যে ঘরে আল্লাহর স্মরণ নেই সে ঘর বিরান, যে সমাজে আল্লাহর স্মরণ নেই সে সমস্ত সমাজ নয়, গোরস্থান। এই মনুষ্য পৃথিবী থেকে যেদিন আল্লাহর যিকির শেষ হবে সেদিন এই পৃথিবীর সময় ফুরাবে। তার অস্তিত্বের আর কোনো দরকারই থাকবে না।
আমরা যদি চিন্তা করি, তাহলে আমাদের গোটা জীবনজুড়েই দেখতে পাই আল্লাহ তাআলার বড়ত্বের বহু দৃষ্টান্ত। দেখতে পাব আমাদের অক্ষমতা অসহায়ত্বের বহু প্রমাণ। মাঝে মাঝে নির্জনে আমরা যদি খোলা মন নিয়ে ভাবতে পারি, তাহলে বুঝতে পারব, আমাদের শক্তি ও ক্ষমতার দৌড়। এই অতি সীমাবদ্ধ যোগ্যতা তো তাঁরই দান। আমাদের কি কর্তব্য নয়, আমাদের সক্ষমতাটুকুর জন্য আল্লাহ তাআলার শোকরগোজারি করা আর অসীম অক্ষমতার ক্ষেত্রগুলোতে তাঁরই দয়ার ওপর ভরসা করা?
আমাদের মধ্য থেকে বিদায় নিতে যাওয়া মাহে যিলহজের পবিত্র দিনগুলো আমাদের মুসলিম সমাজে যে প্রাণের স্পন্দন জাগিয়ে দিয়েছিল তা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি তাহলে তা আমাদের জীবনের সকল অঙ্গনের জন্যই কল্যাণকর হতে পারে।
আমাদের পার্থিব জীবনের শান্তি ও স্বস্তি এবং আখিরাতের নাজাত ও মুক্তির জন্যই আমাদেরকে আমাদের মহান রবের সামনে সমর্পিত হতে হবে। আমাদের ব্যক্তি-জীবনের শান্তি ও সমাজ-জীবনের শৃঙ্খলার জন্য আমাদের আল্লাহ তাআলার স্মরণ ও আনুগত্যের দিকে ফিরে আসতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন