চট্টগ্রাম বন্দর ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ঘিরে সবকটি সড়কে যানজট এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এতে জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। নগরবাসীর পাশাপাশি দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা পতেঙ্গা সৈকতে আসা পর্যটকরা ত্যক্ত-বিরক্ত। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বাংলাদেশি পণ্যের ক্রেতারাও চট্টগ্রামে এসেই বিড়ম্বনার মুখোমুখি হচ্ছেন। বিমানবন্দর থেকে নগরীতে আসতেই তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে তাদের। প্রধান সমুদ্র বন্দর সেই সাথে বিমানবন্দর এলাকার সবকটি সড়কে এমন বেহাল দশায় চট্টগ্রামের ইমেজ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিদেশি বিনিয়োগ ও পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও সিটি আউটার রিং রোডের কাজ শেষ না করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল খুলে দেওয়া হলে ওই এলাকায় যানবাহনের চাপ বাড়বে। আর তাতে যানজট আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে চারটি সড়কের সংযোগস্থল হওয়ায় সেখানে অচলাবস্থার আশঙ্কা করে ইতোমধ্যে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে টানেলমুখী সড়কে পৃথক লেন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের প্রথম এবং এশিয়ার দীর্ঘতম এই সড়ক টানেলটির একাংশ আগামী অক্টোবরের শেষে অথবা নভেম্বরের শুরুতে খুলে দেওয়া হচ্ছে। পুরো টানেল চালু হবে ডিসেম্বরে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বন্দর-হালিশহর-পতেঙ্গা। চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডে কর্মরত সাত লক্ষাধিক শ্রমিক। বন্দর ইপিজেড ছাড়াও ওই এলাকায় রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি ভারী শিল্প কারখানা, বেসরকারি কনটেইনার ডিপো। আছে নেভাল একাডেমিসহ নৌবাহিনী, বিমান বাহিনীর ঘাঁটি। গুরুত্বপূর্ণ এ এলাকার সড়কে বিশৃঙ্খলা জনজীবনে দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যও লাটে উঠার উপক্রম হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সাগরতীরে আগামীর বন্দর হিসেবে পরিচিত বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। পতেঙ্গা সৈকতে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আউটার রিং রোড। দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল মীরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে শিল্পস্থাপন চলছে। এসব প্রকল্পকে ঘিরে চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে চীনের আর্থিক সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণ কাজও শেষ পর্যায়ে। নির্মাণ করা হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। তবে সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে সড়ক যোগাযোগে বেহাল অবস্থায় এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ তিন গুণের বেশি বাড়িয়েও এখনো শেষ হয়নি আউটার রিং রোডের নির্মাণ কাজ। প্রথমে তিনটি ফিডার রোড নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলেও নানা জটিলতার কারণে একটি বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু বাকি দুটি রোডও এখনো নির্মাণ করা হয়নি। এর ফলে নগরীর অন্য সড়কগুলোর সাথে সিটি আউটার রিং রোডের সংযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় ওই সড়কের সুফল মিলছে না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পেও ধীরগতি চলছে। দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও বাজেট বেড়েছে। কিন্তু চার বছরেও কাজ শেষ করা যায়নি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। টাইগারপাস এলাকায় কাজ করতে রেলের অনুমোদন মেলেনি এখনো। বারিক বিল্ডিং থেকে কাস্টম হাউস পর্যন্ত ওয়ার পাইপ লাইনও সরানো হয়নি। এর ফলে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ থমকে আছে। প্রধান সড়কে মেগা প্রকল্পের ধীরগতিতে নগরীর বিশাল অংশে এখন অচলাবস্থা চলছে। রাস্তায় আটকা পড়ছে শত শত যানবাহন। আধা কিলোমিটার সড়ক পার হতে ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। এতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, অপচয় হচ্ছে জ্বালানির। শ্রমিকের উপস্থিতি বিঘ্নিত হওয়ায় কারখানার উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। যানজট এড়াতে বিদেশি অতিথি ও সরকারের ভিআইপিদের বিকল্প সড়কে নগরীতে আনা নেয়া করতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় টানেল চালু হলে পতেঙ্গামুখী যানবাহনের চাপ বাড়বে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারমুখী যানবাহন সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলে প্রবেশ করবে। উত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির যানবাহন টানেলে যাবে পোর্ট কানেকটিং রোড হয়ে। কিন্তু দুটি সড়কে চরম বিশঙ্খলা। বন্দরের ভারী যানবাহনের সাথে অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল বাড়লে পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে। আর তাতে যানজট আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে চারটি সড়কের সংযোগস্থল। সবকটি সড়ক এখন অঘোষিত টার্মিনাল। এ অবস্থায় টানেল চালু হলে পতেঙ্গা এলাকায় যানজট নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে সিডিএর কর্মকর্তারা বলছেন, পতেঙ্গা এলাকায় টানেলের মুখে একাধিক বাইপাস নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে টানেল চালু হলে যানবাহনের চাপ কমাতে পোর্ট কানেকটিং রোড থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেয়া হবে।
এদিকে বন্দর ও বিমানবন্দরমুখী সবকটি সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে নগরীর বিশাল এলাকাজুড়ে তীব্র যানজট হচ্ছে। লাখ লাখ শ্রমিক এবং ওইসব এলাকার বাসিন্দারা সড়কে নেমেই দুর্ভোগের মুখোমুখি হচ্ছেন। তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রেতা, বিনিয়োগকারীসহ বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তারা চট্টগ্রাম এসেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ছেন। সড়কে বেহাল দশার কারণে অনেক পথ ঘুরে নগরীর হোটেলে আসতে হচ্ছে তাদের। এতে তারা ত্যক্ত-বিরক্ত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা মসৃণ ও সহজতর করা না হলে বিদেশে চট্টগ্রাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি হবে। আর এ ইমেজ সঙ্কট এখানকার উন্নয়ন বিনিয়োগ ও পর্যটনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পতেঙ্গা সৈকতের পাশাপাশি নেভাল সৈকত ও নৌবাহিনী পরিচালিত বোট ক্লাব অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ইতোমধ্যে পর্যটকদের নজর কেড়েছে। কিন্তু বেহাল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পর্যটকরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এতে অনেকে চট্টগ্রাম বিমুখ হচ্ছেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর কুয়াকাটামুখী পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। এতে কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন চট্টগ্রামের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এ খাতে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হলে পর্যটক আসবে না। ফলে এ খাতে যে সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগানো যাবে না।
চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন ও গবেষণা পরিষদের সভাপতি বন্দরের সাবেক পরিচালক কমোডোর (অব.) জোবায়ের আহমদ বলেন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, বে-টার্মিনালকে ঘিরে চট্টগ্রাম বন্দর তথা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়ছে। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকার অবকাঠামো খাতে চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এর সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সাথে সমন্বয়হীনতা দূর করা জরুরি। চট্টগ্রাম বন্দর এবং বিমান বন্দরমুখী সড়ক অবশ্যই সচল থাকতে হবে।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি প্রফেসর জেরিনা হোসেন বলেন, আউটার রিং রোডের পাশাপাশি সরকার উপকূলীয় এলাকায় মেরিন ড্রাইভওয়ে নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছেন। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশে^র অনেক দেশ উপকূলে পর্যটন, আবাসন, শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত এবং পরিকল্পিত উন্নয়ন। সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের আরো তৎপর হতে হবে।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-পশ্চিম) তারেক আহম্মদ বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ট্রাফিক বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। তবে বন্দর এলাকায় পর্যাপ্ত টার্মিনাল নির্মাণ ও পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন