শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ঘরে ঘরে ডায়রিয়া

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে হালিশহর-পতেঙ্গা : ৪ দিনে হাসপাতালে ২১২ জন

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৫ এএম

আক্রান্তদের নমুনায় কলেরার জীবাণু ঢাকা থেকে বিশেষ টিম যাচ্ছে আজ
চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরে এখন ঘরে ঘরে ডায়রিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চারদিনে পানিবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছেন ২১২ জন। বাসাবাড়ি এবং বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। আক্রান্তদের নমুনা পরীক্ষায় অন্তত ৪০ শতাংশের শরীরে মিলেছে কলেরার জীবাণু। এতে নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ বৃহত্তর হালিশহর, আগ্রাবাদ ও ইপিজেড এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে রীতিমত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে এসব এলাকার লাখো বাসিন্দা।

স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গত কয়েকদিনের প্রবল জোয়ারে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। এ সময় পানির উৎসে জোয়ারের পানির সাথে ময়লা-আবর্জনা ঢুকে পড়ায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তবে হঠাৎ করে কেন ডায়রিয়া ও কলেরার প্রাদুর্ভাব তা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে ঢাকা থেকে আইইডিসিআরের তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম আজ শুক্রবার চট্টগ্রাম আসছেন। তারা আক্রান্তদের নমুনা এবং হালিশহর এলাকা থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করবেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন।

গত সোমবার থেকে হঠাৎ করে বৃহত্তর হালিশহর, উত্তর আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম ইপিজেড ও আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। গণহারে লোকজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে শুরু করে। আক্রান্তদের মধ্যে নারী-পুরুষসহ শিশুরাও রয়েছে। জ্বরের সাথে পাতলা পায়খানা এবং বমি হচ্ছে অনেকের। কারো কারো শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে। শুরুতে আক্রান্তরা বাসাবাড়িতে কিংবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নিলেও পরে অবস্থা খারাপ হলে অনেকে ছুটেন হাসপাতালে। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ফৌজদারহাটের বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসার্স ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি) চারদিনে ভর্তি হয়েছেন ২১২ জন। গতকাল বিকেল পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৬৫ জন। সোমবার ৬৯ জন, মঙ্গলবার ৫৫ জন, বুধবার ৪৬ জন এবং গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৪৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মামুনুর রশীদ ইনকিলাবকে বলেন, এখনো পর্যন্ত কোন রোগীর মৃত্যু না হলেও আশঙ্কাজনক অবস্থায় অনেকে হাসপাতালে আসছেন। সব বয়সের রোগী আসছেন, তবে আক্রান্তদের মধ্যে ২০ থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশের নমুনায় ডায়রিয়ার পাশাপাশি কলেরার জীবাণু পাওয়া গেছে। প্রথম দিন ২০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে সাতজনের এবং দ্বিতীয় দিন ১৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১০ জনের শরীরে ভিব্রিও কলেরার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে নোংরা পানিতে জীবাণুর কারণে পানিবাহিত এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন ওইসব এলাকা প্রবল জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে। এতে অনেকের বাসাবাড়ির পানির রিজার্ভার জোয়ারে তলিয়ে গেছে। পানির উৎসের সাথে ময়লা-আবর্জনা ঢুকে পড়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এলাকার পানির নমুনা এবং আক্রান্তদের শরীরের নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্রকৃত কারণ জানা যাবে। বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখতে রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (আইইডিসিআর) চিঠি দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম চট্টগ্রাম আসছেন। তারা সরেজমিন পরিদর্শন করবেন, নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে পরীক্ষা করবেন। আক্রান্তদের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী এবং হাসপাতালের শয্যা প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়া হালিশহর, আগ্রাবাদ ও ইপিজেড এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। খাওয়ার আগে পানি ফোটানো, প্রয়োজনে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার এবং ভালো করে হাত ধোঁয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পানিবাহিত রোগ হওয়ায় ওয়াসার পানিতে কোন সমস্যা আছে কিনা তা খুঁজে বের করতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ওয়াসাকে বলা হয়েছে। ওইসব এলাকায় পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্তদের কারো মধ্যে ডায়রিয়া আবার কারো মধ্যে ডায়রিয়ার সাথে ‘ভিব্রিও কলেরা’ নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামক শনাক্ত হয়েছে। কলেরা হচ্ছে ‘ভিব্রিও কলেরা’ নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ক্ষুদ্রান্ত্রের একটি সংক্রামক রোগ। এ ব্যাধি উপসর্গবিহীন অথবা মৃদু অথবা মারাত্মক হতে পারে। কলেরার প্রধান উপসর্গ হল ঘন ঘন পাতলা পায়খানা। এছাড়া থাকতে পারে পেটব্যথা, পানিশূন্যতা, শারীরিক দুর্বলতা এবং চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় থাকলে শেষ পর্যন্ত পানিশূন্যতার কারণে মৃত্যু ঘটতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত এলাকায় সংক্রামক ঠেকাতে এ মুহূর্তে দরকার সচেতনতা। বিশেষ করে পানি ফুটিয়ে পান করা, খাওয়ার আগে বিজ্ঞানসম্মতভাবে হাত ধোঁয়া এবং রাস্তা-ফুটপাতের উন্মুক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকার কোন বিকল্প নেই। এছাড়া যেসব বাসাবাড়ির পানির রিজার্ভারে জোয়ারের পানি ঢুকেছে সেগুলো পরিষ্কার করারও পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।

এদিকে ব্যাপকহারে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ায় এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সরকারি ওই বিশেষায়িত হাসপাতালে যত রোগী যাচ্ছেন তার কয়েকগুণ বেশি রোগী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে আবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত¡াবধানে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর ফলে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নেই। বিআইটিআইডিতেও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। শয্যার তুলনায় রোগী বেশি হওয়ায় অনেককে ফ্লোরে রেখেই চিকিৎসা প্রদান করে যাচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। তবে দুয়েক দিন চিকিৎসা নেয়ার পর অনেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, এর আগে বিগত ২০১৮ ও ১৯ সালেও হালিশহর, উত্তর পতেঙ্গা, ইপিজেড ও আগ্রাবাদের বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, সিডিএর পানিবদ্ধতা নিরসনে ছয় হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের আওতায় মহেষখালসহ ওইসব এলাকার খাল সংস্কার হচ্ছে। খালের মুখে সøুইচ গেইট ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করার জন্য খালে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এতে জোয়ারের সময় দ্রæত পানি উঠে যাচ্ছে। আর ময়লা-আবর্জনার কারণে ভাটার সময় পানি নামছে ধীরে। এতে দুই দফা জোয়ারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ময়লা পানিতে ডুবে থাকছে এসব এলাকা। জোয়ারের পানির সাথে উঠে আসা ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব অলিগলি থেকে শুরু করে আবাসিক এলাকা। গত কয়েকদিনের প্রবল জোয়ারে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারের কারণে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন