মাহমুদ ইউসুফ: নবীনচন্দ্র, ইশ^রগুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, দ্বীজেন্দ্রলাল, বাল গঙ্গাধর, গোখলে, শ্যামাপ্রসাদ, নেহেরু, ইন্দিরা, শরৎচন্দ্র, ঠাকুর কবি রবীন্দ্রবাবুদের সাহিত্যে, বয়ানে মুসলমান মাত্রই গৃহপালিত অচ্ছুত, ম্লেচ্ছ, আবর্জনা, বহিরাগত, যবন, নেড়ে আরো কত কী? সেই চিন্তা-চেতনা আজো তারা বদলাতে পারেনি। বিগত আড়াইশ’ বছর যাবত ভারতে চলছে মুসলিম দলন। বর্তমানে তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে বার্মিজ বুদ্ধিস্টরা। মিয়ানমারে বহু বছর যাবত চলছে মুসলিম নিধন।
মিয়ানমারে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মর্যাদাও নেই এই রোহিঙ্গাদের। দেশটির ১৯৮২ সালের এক আইনবলে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেতে ১৮২৩ সালের আগে থেকে সেখানে বসবাসের প্রমাণ হাজির করতে হয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সদস্যদের। জাতিসংঘ বলছে, রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা মুসলিমরা বিশ্বের সবচেয়ে বঞ্চিত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর একটি। আর তাদের অধিকাংশের বসবাস মিয়ানমারের দারিদ্র্যপীড়িত পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে। দেশের ভেতর চলাচল ও কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে বিধি-নিষেধ। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা বলছে, ২০১২ সালে ধর্মীয় সহিংসতা শুরুর পর রাখাইন থেকে পালিয়ে গেছেন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। সাগরের দুর্গমযাত্রা উপেক্ষা করে তাঁদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা চলছে এখনো।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, কয়েকদিন পূর্বে হাতিপাড়া গ্রামে শান্তি মিটিং করার কথা বলে গ্রামের সবাইকে ডাকা হয়। সবাই জড়ো হওয়ার পর চারপাশ থেকে সৈন্যরা ঘিরে ফেলে। প্রায় একশ’ নারী-পুরুষ সেখানে ছিল। সৈন্যরা সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে উলঙ্গ করে। তারপর পুরুষদের চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে। আর নারীদের ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণ চালাতে থাকে। প্রতিবাদ করলে সৈন্যরা গুলি করে। অন্তত ১৫-২০ জন পুরুষ সেখানেই মারা যায়। বাকি পুরুষদের ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যায় তারা এ সময়। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা, গণধর্ষণ, গণগ্রেফতার, গণউচ্ছেদ, জবাই, গুলি, বিতাড়ন, সম্পদ দখল, অগ্নিকা-, উলঙ্গ করে নিষ্ঠুর নির্মমতা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার মিয়ানমারে।
সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের পাঠকপ্রিয় একটি বই যার শিরোনাম ‘মুসলমানদের মানবাধিকার থাকতে নেই’। সত্যিই তাই! খ্রিস্টানদের মানবাধিকার থাকবে, হিন্দুদের মানবাধিকার থাকবে, ইহুদিদের মানবাধিকার থাকবে, নষ্ট ভ্রষ্ট বাম-রাম-ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের মানবাধিকার থাকবে, মুশরিক-কাফিরদের মানবাধিকার থাকবে, কমিউনিস্টদের মানবাধিকার থাকবে, মুরং-সাঁওতাল-চাকমাদের মানবাধিকার থাকবে, উপজাতিদের মানবাধিকার থাকবে। কিন্তু মুসলমানদের মানবাধিকার থাকতে পারে না।
বাংলাদেশে কয়েক লাখ ভারতীয় বসবাস করছেন, যাঁদের বেশিরভাগ অবৈধ অভিবাসী এবং উদ্বাস্তু। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে পাঁচ লাখ ভারতীয় নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেমনÑ এনজিও, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, আইটি সংস্থায় তাঁরা কর্মরত রয়েছে। উপার্জিত অর্থ তাঁরা হুন্ডি হস্তান্তর পদ্ধতিতে ভারতে পাঠায়। ২০১২ সালে, বাংলাদেশ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনক্ষেত্র হিসেবে পঞ্চম দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সে বছর এই ভারতীয় অভিবাসীরা বাংলাদেশ থেকে ৩.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার উপার্জন করে ভারতে পাঠিয়েছে। এই অভিবাসীদের বেশিরভাগই পর্যটন ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন, তবে একবার ঢোকার পর এঁদের বের হওয়ার কোনো প্রবণতা দেখা যায় না। এভাবে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই লাখ লাখ ভারতীয় অভিবাসী প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের বাসিন্দা। (উইকিপিডিয়া থেকে ৫ ডিসেম্বর ২০১৬ ইসায়ি)। মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে ১৫ লক্ষের মতো পাসপোর্ট বা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতীয় রয়েছে। (দিনাজপুর নিউজ২৪.কম, ১৮ আগস্ট ২০১৬)। এইসব ভারতীয়দের নিরাপদ আশ্রয়স্থল, জীবিকাস্থল বাংলাদেশ। কিন্তু অসহায় রোহিঙ্গাদের জায়গা হচ্ছে না এদেশে। তাদের নৌকা ফিরিয়ে দিচ্ছে বিজিবি। অপর পাশ থেকে গুলি করছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা। ফলে সাগরে ভাসমান অবস্থায় ক্ষুধায়, বিনা চিকিৎসায়, শীতে মারা যাচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।
খবরের কাগজে আমাদের এক ইঞ্চি বিজ্ঞাপন দিতে হাজার হাজার টাকা গুনতে হয়। কিন্তু ইসলাম-মুসলিমদের শত্রুদের খবর পরিবেশন করতে মিডিয়া খুবই উৎসাহী। হলিউড-বলিউডের নায়ক-নায়িকাদের জন্য সংবাদপত্রে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকে। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ম্যাসাকারের খবরাখবর তারা গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে না। তাদের আশ্রয় দেয়ার বিপক্ষে গণমাধ্যম। কারণ ওরা যে মুসলিম, ওরা যে ইমানদার; ওদের মৌলিক অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার, খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার থাকতে নেই। এইসব সেক্যুলার মিডিয়ার কাছে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী, জঙ্গি, ইয়াবা ব্যবসায়ী! যাদের পরনে বস্ত্র নেই, পেটে ভাত নেই, চিকিৎসার অভাবে রোগে শোকে ধুঁকে ধুঁকে মরছে তারা কীভাবে সন্ত্রাসী হলো সেটা মিডিয়া বলে না। সামগ্রিকভাবেই গণমাধ্যম মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে অঘোষিত সংগ্রামে লিপ্ত। অমুসলিমের এজেন্ট হিসেবে দায়িত্বরত একশ্রেণির সংবাদকর্মী ও মিডিয়া মালিকরা।
অতীত দুনিয়ার যে প্রান্তেই মুসলিমরা বা অন্যকোনো সম্প্রদায় আক্রান্ত হতো অন্য দেশের মুসলিমরা এগিয়ে যেত তাদের উদ্ধার করতে। যেমন সিন্ধুতে নির্যাতিত মুসলিমদের রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন মুহাম্মাদ বিন কাসিম। অত্যাচারী শাসক রডারিকের কবল থেকে কাউন্ট জুলিয়ান ও ফ্লোরিন্ডাদের রক্ষায় এগিয়ে গিয়েছিলেন তারিক বিন যিয়াদ। একইভাবে উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নিষ্ঠুরতা থেকে বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে মুক্তি দিতে এগিয়ে আসেন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি। তারই কী বদলা নিচ্ছে বার্মিজ বৌদ্ধরা বখতিয়ারের উত্তরসূরীদের উচ্ছেদ করে?
নামজাদা ভাষাবিজ্ঞানী কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, সেন-রাজগণের কোপানলে দগ্ধ হয়ে পূর্ববঙ্গে নাথপন্থীরা ইসলামের আশ্রয় লইয়া জুড়াইয়াছিল। ইসলাম সেখানে উগ্রভাবে ধর্ম্মপ্রচার করে নাই। পূর্ববঙ্গের বৌদ্ধ জনসাধারণ সমধিক পরিমাণে সংখ্যায় গরিষ্ঠ ছিল। গোঁড়া হিন্দু সমাজের উৎপীড়নে ইহারা স্বত: প্রবৃত্ত হইয়া ইসলামের আশ্রয় গ্রহণ করে। (দীনেশ চন্দ্র সেন: প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, পলাশ প্রকাশনী, ১০ কবি জসীমউদদীন রোড, ঢাকা-১২১৭, প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০২, পৃ ২১-২২)
তখন মুসলমানরা ছিল একই রাষ্ট্রের, একই জাতিসত্তার অধীন। সেটা নিয়ন্ত্রিত হতো কখনো মদিনা থেকে, কখনো কুফা থেকে, পর্যায়ক্রমে দামেস্ক, বাগদাদ ও মিসর থেকে। সর্বশেষে সবাই ছিলাম উসমানিয়া খিলাফতের আওতাধীন। তখন মুসলিমদের পরস্পরের মধ্যে ছিল ইস্পাতসম দৃঢ় ঐক্য। এই ঐক্য ও সংহতিকে নষ্ট করার জন্যই ব্রিটিশরা ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। ইউরোপীয় খ্রিষ্টান মৌলবাদী ও সন্ত্রাসীগোষ্ঠী পৃথিবী থেকে মুসলিমদের পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করার জন্যই রাষ্ট্রপ্রথা পয়দা করার পদক্ষেপ নেয়। তারা সৃষ্টি করে শত শত রাষ্ট্র। খ-বিখ- করে মুসলিম জনসমষ্টিকে। নির্দিষ্ট সীমারেখায় বন্দি হয়ে পড়ে মুসলিম মিল্লাত। অথচ ইসলামের আগমন ঘটেছে মানবজাতিকে একতা বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য। ‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ করো; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ করো, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। (আল কোরআন : সুরা আল ইমরান : আয়াত ১০৩)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সব মুমিন একই ব্যক্তিসত্তার মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয় তখন তার গোটা শরীরই তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয় তাতে তার গোটা শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে। (নুমান (রা.) থেকে বর্ণিত, মিশকাত)
অতএব, ভৌগোলিক সীমারেখা বর্ডার ব্যবস্থা, দৈশিক বা রাষ্ট্রীয় পরিধিতে ইমানদাররা আবদ্ধ থাকতে পারে না। ইমানদারদের দেশ একটাই, জাতি একটাই। সে দেশের নাম হলো পৃথিবী, সে জাতির নাম হলো মুসলিম। তারা বিভক্ত হতে পারে না, তারা পরস্পর ভাই। একজন থেকে অন্যজন বিভক্তি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বহু শতাব্দী ধরে ইহুদিবাদ-ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ্যবাদীরা মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বীজ পুঁতে দিয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই কাশ্মির, প্যালেস্টাইন, মিন্দানাও, চেচেন, আরাকান আজ অগ্নিগর্ভ। সীমারেখার বাধা না থাকলে আরাকানের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা আজ মুসলিমদের ওপর হাত তোলার সাহস পেত না। ওদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলত বাঙালি জওয়ানরা। ব্রিটিশরা যেন বুঝে দীর্ঘ গবেষণার পরই মুসলিম অধ্যুষিত আরব, আফ্রিকা ও ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করে। তারই ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে গোটা মুসলিম সম্প্রদায়। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, “মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সে তার ভাইয়ের ওপর কোনো জুলুম করবে না বা অত্যাচারিত হতে দেবে না। যে তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে আল্লাহ তার বিপদ দূর করবেন। (আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) হ’তে বর্ণিত; সহিহ বুখারি)। তাই আর্থিক, মানসিক, শারীরিক যে যেভাবে পারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাহায্য সহযোগিতা করা সময়ের অপরিহার্য দাবি।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন