চার বছর আগে সোচির স্টেডিয়ামে এডিনসন কাভানির জোড়া গোলে সর্বনাশ হয়েছিল পর্তুগালের। সেকেন্ড রাউন্ডের সেই ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় পর্তুগালকে। পরশু মধ্যরাতে লুসাইল স্টেডিয়ামে কি সেই দুঃস্মৃতি মনে পড়ছিল রোনালদো-ব্রুনোদের? উরুগুয়ের বিশ্বমানের ফরোয়ার্ড ও মধ্যমাঠকে কি ধোকা দিতে পারবে ফেলিক্সরা? নাকি আবারো ফিস্ট স্টেডিয়ামের পুনরাবৃত্তি ঘটবে? এই ধরনের নানান প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল ফুটবলপ্রেমীদের মনে। উরুগুয়ে খুব বেশি ঝুঁকি নিবে না, অন্যদিকে পর্তুগিজ বস ফার্নান্দো সান্তোসতো বিখ্যাত তার রক্ষণশীল পরিকল্পনার জন্য। তাই ধারণা ছিল ম্যাচটা খুব একঘেয়ে হবে। তবে সবাইকে অবাক করে ম্যাচ হলো টানটান উত্তেজনার। সারা বিশ্বের বাঘা-বাঘা সাংবাদিকরা ম্যাচ শেষেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন- বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সেরা ম্যাচটি লুইসালে একটু আগে শেষ হলো! পরশু রাতের ‘এইচ’ গ্রুপের সেই মহাকাব্যিক ম্যাচটি ২-০ গোলে জিতে নেয় পর্তুগাল। ফলে ব্রাজিল আর ফ্রান্সের পাশাপাশি তৃতীয় দল হিসেবে শেষ ষোল নিশ্চিত করল পর্তুগাল। শেষ ম্যাচে হার এড়াতে পারলেই বা ঘানা না জিতলেয় গ্রুপ সেরা হবে নেভিগেটর্সরা।
ম্যাচের তখন ৫৪ মিনিট। বল নিয়ে বক্সের বাহিরে বাঁ দিকটাই ব্রুনো। বক্সের ভেতরে তখন গোলশিকারি রোনালদোর অবস্থান। বল উড়িয়ে মারলেন রোনালদোর মাথায়। রোনালদোর মাথা আলতো ছুঁয়ে, একবার ড্রপ খেয়ে উরুগুয়ের গোলকিপার রোচেতকে বোকা বানিয়ে সে বল ঠিকই জড়াল জালে। ব্যস, এগিয়ে পর্তুগাল! গোলের উদযাপনের সময় রোনালদো সতীর্থদের বারবার বললেন তিনি নিশ্চিত নন। খেলা শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক পর রোনালদো জানলেন, গোলটা তাঁকে নয়, দেওয়া হয়েছে ব্রুনোর নামে। কারণ, ফিফার দাবি রোনালদোর মাথাতেই বল লাগেনি! তবে ঝুম করা স্থির চিত্রে দেখা যাচ্ছিল, রোনালদোর চুল ছুঁয়ে গিয়েছে বল। তবে সে যাই হোক, পর্তুগাল এগিয়ে গিয়েছে সাবেক দুইবারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের বিপক্ষে। সেটাই যথেষ্ঠ ছিল পর্তুগিজ কাপ্তানের জন্য।
গোল না পাওয়ার আক্ষেপটা হয়তো ম্যাচের শেষদিকে ঘোচাতে পারতেন রোনালদো, পেনাল্টির মাধ্যমে আরেকটা গোল করে। তবে চোট থেকে বাঁচাতে কোচ সান্তোসের ৫ বারের ব্যাল ডি-অর জয়ীকে ৮২ মিনিটেই উঠিয়ে বেনফিকার ফরোয়ার্ড গনসালো রামোসকে নামিয়েছিলেন। যোগ করা সময়ে পর্তুগাল পেনাল্টি পেলে সেখান থেকে নিজের দ্বিতীয় গোল পেয়ে যান ব্রুনো ফের্নান্দেস। ফলে আসরে এই ম্যানইউ মিডফিলদারের এখন পর্যন্ত সংগ্রহ দুই গোল ও দুই এসিস্ট।
দিয়াগো আলোনসোর ৩-৫-২ ছকে খেলা উরুগুয়ে এই ম্যাচে নেমেছিল লুইস সুয়ারেজকে ছাড়াই, অন্য দুই প্রথাগত স্ট্রাইকার দারউইন নুনিয়েস ও কাভানিকে নিয়ে। মাঝমাঠের সঙ্গে আক্রমণভাগের কোনো সংযোগ না থাকার খেসারত দিয়েছেন দুজন। তেমন কিছুই করতে পারেননি। শেষমেশ দ্বিতীয়ার্ধে দুই স্ট্রাইকারকে উঠিয়ে সুয়ারেজ আর মাক্সি গোমেসকে মাঠে নামান আলোনসো। তাতে আরেকটু হলেই সুফল পাচ্ছিল উরুগুয়ে, গোমেসের একটা শট পোস্টে লাগে, ওদিকে সুয়ারেজও বেশ ক’বার গোল করার সুযোগ পেয়েছেন। উরুগুয়ে না পারলেও পর্তুগিজ মিডফিল্ডের কল্যাণে আস্তে আস্তে ম্যাচের হাল নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় সান্তোস বাহিনী। দানিলো পেরেইরাকে না নামিয়ে বর্ষীয়ান পেপেকে দিয়ে রক্ষণ করার সিদ্ধান্তটা সুফল বয়ে আনে পর্তুগালের জন্য। তাছাড়া রোনালদো যথক্ষণ মাঠে ছিলেন তার পুরোটাই নিচে নেমে মিডফিল্ডের সঙ্গে আক্রমণের যোগসূত্র রচনায় সাহায্য করেছেন দলকে।
এই জয়ে স্বস্তির পাশাপাশি চিন্তারও কারণ আছে পর্তুগালের জন্য। দলের মূল লেফটব্যাক নুনো মেন্দেস চোটে পড়ে ৪২ মিনিটে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছেড়েছেন। তার চোট যদি গুরুতর হয়, নকআউট রাউন্ডে বেশ ভালোই সমস্যা হতে পারে সান্তোসকে। কারন বদলি লেফটব্যাক গুয়েরেইরোর রক্ষণ ঠিক নুনোর মত কার্যকরী নয়।
ম্যাচটিকে ধরা হচ্ছিল বুড়োদের ম্যাচ। কারণ দুই দলের রোনালদো, পেপে, সুয়ারেজ, কাভানি ও গোডিন হচ্ছেন উল্লেখযোগ্য ফুটবলার। এদের সবাই জীবনের ৩৫ বসন্ত পার করেছেন আগেই। পেপেতো রজার মিলারের পর বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলা দ্বিতীয় বয়স্ক ফুটবলার! অথচ ম্যচ শেষ হলো দারুণ এক প্রদর্শনির পর। মাঠে আসা আশি হাজার দর্শক তৃপ্তির ঢেকুর তুলেই ঘরে ফিরেছেন। এই গ্রুপের দ্বিতীয় দল হয়ে পরের ধাপে যাওয়ার লড়াইয়ে আছে বাকি তিন দল। শেষ রাউন্ডে উরুগুয়ের শুধু ঘানার বিপক্ষে জিতলেই হবে না, প্রার্থনা করতে হবে যেন অন্য ম্যাচের ফল পক্ষে আসে। জার্মানি বিশ্বকাপের পরে তিন আসরে টানা দুই ম্যাচ জিততে না পারা পর্তুগাল পরশুরাতে তা করে দেখিয়েছে ১৬ বছর পর। গ্রুপের শীর্ষে থাকা পর্তুগিজদের সংগ্রহ ২ ম্যাচে ৬ পয়েন্ট, আর দুইয়ে থাকা ঘানার পয়েন্ট ৩। উরুগুয়ে ও দক্ষিণ কোরিয়ার পয়েন্ট ১ করে; তবে গোল ব্যবধানে পিছিয়ে তলানিতে লাতিন আমেরিকার দলটি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন