যেখানে বাস্তবতার সীমানা শেষ, জাদুর শুরু তো সেখানেই। তখন অস্ট্রেলিয়া ছড়ি ঘোরাচ্ছে আর্জেন্টিনার উপর। এটাই যখন কঠিন বাস্তব তখনই স্বর্গীয় বাঁ পায়ের জাদু। লিওনেল মেসির ঝলকে আর্জেন্টিনার গোল। তাতেই ঘুরে গেল ম্যাচের ভাগ্য। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল মেসির ক্যারিয়ারের ১০০০ তম ম্যাচ আর আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হিসেবে শততম ম্যাচ। কী দারুণভাবেই না এই মাইলফলকে পা রাখাটা উদযাপন করলেন ফুটবলের জাদুকর। দুর্দান্ত এক জয়ে আর্জেন্টিনাকে বলতে গেলে একা হাতেই টেনে তুললেন কোয়ার্টার ফাইনালে। ১৯৮৬ আসরের পর আরেকটি শিরোপা জয়ের দুর্নিবার আকাক্সক্ষা পুরণের পথে আলবিসেলেস্তারা পার হলো আরেকটি সিঁড়ি। মেসিও তা পেরুলেন মেসিসুলভ ঝলক দেখিয়ে, যখন আর্জেন্টিনা গোলের জন্য ধুঁকছে!
কাতারের আহমদ বিন আলী স্টেডিয়ামে আক্রমণের শুরুটা মেসির নেয়া ফ্রি-কিক থেকে। ডান-প্রান্তে, কর্নার ফ্ল্যাগ আর সাইড লাইনের খানিক সামনের জায়গায় ফ্রি-কিক নেন মেসি। অস্ট্রেলিয়ার রক্ষণের খেলোয়াড় হেডে বলটা ফেরালেও ক্লিয়ার করতে পারেননি, বল চলে যায় আলেক্সিস ম্যাকআলিস্টারের কাছে, তিনি দ্রুত বল দিয়ে দেন মেসির কাছে। তার সঙ্গে ওয়ান-টু পাসে ততক্ষণে মেসি ঢুকে পড়েছেন বক্সের ভেতর। ১৫ গজ দূর থেকে মেসির জাদুকরি বাম পায়ের শট তিন জন অস্ট্রেলিয়ান রক্ষণ প্রহরীর ফাঁক দিয়েও ঠিকই খুঁজে নয় কাঙ্খিত গন্তব্য। ম্যাথু রায়ান ডান দিকে ঝাঁপিয়েও বাঁচাতে পারেননি গোল। গোলটি দেখে মেসির এক সময়ের সতীর্থ পাওলো জাবালেতা রেডিও ধারাভাষ্যে বলছিলেন, ‘মেসিকে শুধু বলটা দাও, এটাই যথেষ্ট। বক্সের ভেতর কী দারুণ সমন্বিত খেলা দেখা গেল আর নিখুঁত ফিনিশিং।’ শুধু সাবেক সতীর্থই কেন, বর্তমান দলটির প্রতিটি সদস্যই মেসিতে বিমোহিত। এমনকি এই জয়ে যার অবদান অনস্বীকার্য সেই গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেসতো বলেই ফেললেন, ‘মেসি আর্জেন্টিনা দলের ৯৯.৯ ভাগ, আমরা বাকিরা ০.১ শতাংশ। আমাদের কাজ শুধু তাকে সহযোগীতা করা যা তার প্রয়োজন।’
কাতার বিশ্বকাপে এ নিয়ে চার ম্যাচে তিন গোল করলেন মেসি। এ গোলে দুটি চাওয়া পূরণ হলো ২০২১ সালে আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকার শিরোপা এনে দেওয়া এই ফরোয়ার্ডের। বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে পেলেন নিজের প্রথম গোল। রেকর্ডের একটি পাতায় ছাপিয়ে গেলেন কিংবদন্তি ডিয়পগো ম্যারাডোনাকেও। বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচ খেলে ৮ গোল করেছিলেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ম্যারাডোনা। ২৩ ম্যাচে মেসির গোল হলো ৯টি। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে মেসির চেয়ে বেশি গোল আছে এখন কেবল গাব্রিয়েল বাতিস্তুতার, ১০টি। একটি গোলে ‘বাতিগোল’কে ছোঁয়া এবং দুটিতে তাকে পেছনে ফেলে এ চূড়ায় ওঠার হাতছানি এখন পিএসজি ফরোয়ার্ডের সামনে।
১৯৭৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। দেশটি দ্বিতীয় ও সবশেষ বিশ্ব সেরার শিরোপা জেতে ১৯৮৬ সালে, কিংবদন্তি ডিয়াগো ম্যারাডোনার হাত ধরে। এবার আলবিসেলেস্তারা স্বপ্ন বুনছেন মেসিকে ঘিরে। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের পর ক্রীড়ার তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান অপ্টা আরও কিছু পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, যেখানে ম্যারাডোনা-মেসি বিশ্বকাপে সমানে সমান।
বিশ্বকাপে পঞ্চমবার খেলছেন মেসি। এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক আসরে ম্যারাডোনার সমান ৬৭ বার গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি। এছাড়া ওপেন প্লে-তে সুযোগ তৈরি করার সংখ্যাও দুইজনের সমান, ৪৮টি। প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ১০৩ বার করে বল স্পর্শ করেছেন মেসি ও ২০২০ সালের নভেম্বরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা ম্যারাডোনা।
বিশ্ব মঞ্চে ম্যারাডোনার চেয়ে একটি গোল বেশি হলেও গোল ও অ্যাসিস্ট মিলিয়ে এগিয়ে ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী ম্যারাডোনাই। গোল করায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন পর্যন্ত ১৫ বার জড়িয়ে মেসি, ম্যারাডোনা ১৬ বার। ম্যারাডোনার চেয়ে ড্রিবল বেশি করেছেন মেসি। আর্জেন্টাইন সাবেক অধিনায়ক ১৮৮ বার ড্রিবল করেন, আর বর্তমান অধিনায়কের ড্রিবল ১৯৪।
বার্সেলোনার হয়ে ১৮ বছর ৪৮ দিন আগে পেশাদার ফুটবলজীবনের প্রথম ম্যাচ খেলেছিলেন মেসি। দেশের হয়ে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে অভিষেক ২০০৫ সালে। হাজার ম্যাচে মোট ৭৮৯টি গোল করেছেন। এর মধ্যে বার্সেলোনার হয়ে ৭৭৮ ম্যাচে ৬৭২টি গোল করেন। আর্জেন্টিনার হয়ে ১৬৯ ম্যাচে রয়েছে ৯৪ ও প্যারিস সেন্ট জার্মেইর হয়ে ৫৩ ম্যাচে ২৩টি গোল রয়েছে তার। বিশ্বকাপের পাশাপাশি দেশের হয়ে কোপা আমেরিকায় ৩৪ ম্যাচে ১৩, বিশ্বকাপের কোয়ালিফাই রাউন্ডে ৬০ ম্যাচে ২৮ এবং আন্তর্জাতিক ৫১টি প্রীতি ম্যাচে ৪৪ গোল করেছেন। দেশের হয়ে আটটি হ্যাটট্রিক রয়েছে এ তারকার। পেশাদার ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে মেসির গোল গিয়ে দাঁড়াল ৭৮৯-তে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন