শার্দুল ঠাকুর ততক্ষণে স্টাম্প ভাঙার হৃদয়বিদারক শব্দটা শুনেছেন। পেছনে ফিরে একবার তাকিয়েছেনও। এরপর মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলেন সাকিব আল হাসানকে। দুই হাতের আঙুল নেড়ে সাকিব যা দেখাচ্ছিলেন, তার অনুবাদ একটাই হতে পারে- ধন্দে আছে ভারত। তা নয়তো কী! গতকাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটিতে সাকিব যেন ভারতীয়দের জন্য এক ধাঁধায় পরিণত হয়েছেন। ৯ মাস পর ওয়ানডে খেলতে নেমে তিনি ভেঙেছেন ভারতীয় টপ অর্ডার। কাঁপিয়েছেন মাঝের ওভারের পুরোটা সময়।
ততক্ষণে সাকিবের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো ৫ উইকেট শিকার করা হয়ে গেছে। তার সর্বশেষ ৫ উইকেটটি দেড় বছর আগের ঘটনা। গত বছরের জুলাইয়ে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। আজ আরও একটি ৫ উইকেট নেওয়ায় মিরপুর স্টেডিয়ামের গ্যালারিভর্তি দর্শক ‘সাকিব’, ‘সাকিব’ বলে চিৎকার করার আদর্শ উপলক্ষ পেয়ে গেলেন।
শুরুটা হয় ইনিংসের পাওয়ারপ্লের ঠিক পরের ওভারেই। নতুন কুকাবুরা তখনো উজ্জ্বল। ক্রিজে তখন দুই ডানহাতি রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি। সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতের তো বটেই সর্বকালের সেরাদের ছোট্ট তালিকায় দুজন সহজেই ঢুকে যাবেন। অধিনায়কত্বে অভিষিক্ত লিটন দাস দুই ভারতীয় তারকার সামনে তার সেরা অস্ত্র সাকিব আল হাসানকে বোলিংয়ে আনলেন। প্রথম স্পেলের দ্বিতীয় বলেই রোহিত বোল্ড। বাংলাদেশ-ভারতের এই ম্যাচের স্কোরবোর্ডে এটুকুই লেখা থাকবে। কিন্তু রোহিতের আউটটি ছিল বোল্ডের চেয়েও বেশি কিছু।
বাঁহাতি স্পিনের জাদু বলতে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে সে বলটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দুর্দান্ত ফ্লাইট ও বলের ঘূর্ণি দেখে যেকেউই ভাববে, বলটি উইকেট ছুঁয়ে ডানহাতি রোহিতের ব্যাটের আউটসাইড এজ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিমও বেরিয়ে যাওয়া বল ধরার ভঙ্গি করছিলেন। কিন্তু হলো উল্টোটা। বল এল রোহিতের ভেতরে। ব্যাট-প্যাডের বিশাল ফাঁক গলে স্টাম্প খুঁজে নিল সাকিবের আর্ম বলটি। ৩১ বলে ২৭ রান করা রোহিত অবিশ্বাস চোখে–মুখে মাঠ ছাড়লেন, আর সাকিব মিরপুরকে মাতালেন বুনো উল্লাসে।
এ তো গেল রোহিতের কথা। এবার কোহলিকে থমকে দেওয়ার গল্পটা শুনুন। সাকিবের একই ওভারের চতুর্থ বলের কথা। রোহিতের মতো প্রায় একই লেংথের বাঁহাতি স্পিন বলটি আগ্রাসি ভঙ্গিতে জায়গা বানিয়ে কাভারে মেরেছিলেন কোহলি। ফিল্ডার লিটনের অনেকটা দূর দিয়ে যাবে ধরে নিয়েই কোহলির বলটা বাতাসে মারা। কিন্তু লিটন চিতার মতো ঝাপিয়ে ক্যাচ লুফে নিয়ে কোহলিকে স্তব্ধ করে দিলেন। শুধু কোহলি নন, সাকিব, মুশফিকসহ পুরো বাংলাদেশ দলের চোখে-মুখে বিস্ময়। আর সেই বিস্ময়মাখা চেহারাগুলোর মধ্যে কয়েক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেলেন লিটন। সবাই তাঁকে জাপটে ধরে উদযাপনে ব্যস্ত। কোহলি মাঠ ছেড়ে যাওয়ার আগে দৃশ্যটা দেখছিলেন, তার চোখে তখনো অবিশ্বাস।
৩ উইকেট হারিয়ে ভারতের ৪৯। সেখান থেকে রানটা যে বেশি দূর এগোবে না, সেটি সহজেই অনুমান করা যাচ্ছিল। কারণ, সাকিবের আরও ৯ ওভার তখনো বাকি। লিটন এই ৯ ওভারকে এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ব্যবহার করলেন, তাতে ভারতের রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। রোহিত-কোহলির পর অনভিজ্ঞ ওয়াশিংটন সুন্দর, শার্দুল, দীপক চাহারকে বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে আউট করে ৫ উইকেট পূর্ণ করেন সাকিব। সাকিব শেষ করেন ৩৬ রানে ৫ উইকেট নিয়ে।
ভালো বোলিং করেছেন ইবাদত হোসেনও। নিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে নেমেই ৪৭ রানে ৪ উইকেট নিয়েছেন তিনি। গতি ও বাউন্স দিয়ে তিনি কাঁপিয়েছেন ভারতীয় মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের। বাংলাদেশ দলের এই দুই বোলারকে অবশ্য ভালো খেলেছেন কে এল রাহুল। ৭০ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে ভারতের মান বাঁচিয়েছেন তিনি। ভারতের রানটা ১৮৬ পর্যন্ত যেতে পেরেছে রাহুলের ইনিংসের সৌজন্যেই।
জয়ের জন্য বাংলাদেশ লক্ষ্য পায় ১৮৭ রান। দেশের মাটিতে এর চেয়ে কম লক্ষ্য নিয়ে রান তাড়া করতে নেমেও বাংলাদেশের হারের ঘটনা ছিল তিনটি। সবচেয়ে কম- ১০৬ রান। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সে রান তাড়া করতে নেমে গুটিয়ে গিয়েছিল ৫৮ রানেই। প্রতিপক্ষ সেবারও ভারত। লিটন দাসের তখনো আন্তর্জাতিক অভিষেকই হয়নি। তবে এদিন অমন কিছুর পুনরাবৃত্তি হতে দেননি মেহেদী মিরাজ-মুস্তাফিজরা। রান তাড়ায় ১০ম উইকেটে রেকর্ডগড়েই লিটনকে স্মরণীয় অধিনায়কত্বের স্বাদ দিলেন তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন