সময়টা ২০০৪ সালের ১৬ জুন। সেদিন ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত ইউরো কাপের গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে একাদশের বাহিরে ছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এরপর ফিট রোনালদোকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বেঞ্চে বসতে হয়নি। তবে পরশুরাতে লুসাইল স্টেডিয়ামে, ৬৭৪৭ দিন পর আবারও একাদশের বাহিরে থাকতে হলো পর্তুগাল ও বিশ্বফুটবলের মহাতারকাকে! এটাই তো এক বিশাল ইতিহাস! দেখার অপেক্ষা ছিল ম্যানেজার ফার্নান্দো সান্তোসের এই বাজি কাজে লাগে কিনা। তবে এই বিশাল ঝুঁকি কেবল ফলাফলই আনলো না, একই সাথে বিস্ময়েরও জন্ম দিল। রোনালদোর বদলি হিসেবে একাদশে স্থান পাওয়া বেনফিকার ফরোয়ার্ড গনজালো রামোস করে ফেললেন কিছু অনন্য কীর্তি। চলমান কাতার বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক করলেন রামোস। শুধু তাই নয় ১৯৬৬ সালের পর এই প্রথম কোন পর্তুগীজ, বিশ্ব আসরের নক-আউটে পেলেন হ্যাটট্রিক। একই সঙ্গে পেপে, রাফায়েল লিয়াও আর রাফায়েল গুয়েরেরো পান একটি করে গোল। তাতেই শেষ ষোলর ম্যাচে প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ডকে ৬-১ ব্যবধানে বিধ্বস্ত করে আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল।
ম্যাচের শুরুতে দুই দলই রক্ষণ সামলে তারপর আক্রমণে যেতে চাচ্ছিল। তবে ম্যাচের বয়স যতই গড়িয়েছে খেলার দখল ততই নিজেদের অনুকূলে নিয়েছে সান্তোসের শীষ্যরা। ম্যাচের ১৭ মিনিটের মাথায় থ্রো থেকে বল পেয়ে বক্সের মধ্যে থাকা রামোসকে পাস দেন জোয়াও ফেলিক্স। বেনফিকা তারকা প্রথম পোস্টে থাকা গোলরক্ষকের পাশ দিয়েই জোরালো শটে গোল করেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না সুইস গোলরক্ষক সমোরের। গোলটিকে আসরের সেরা গোলের মর্যাদা পেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। ম্যাচের ৩৩ মিনিটের সময় কর্নার থেকে বক্সে বল ভাসিয়ে দেন ব্রুনো ফের্নান্দেস। শূন্যে শরীর ভাসিয়ে জোরালো হেডে বল জালে জড়িয়ে দেন পেপে, এবং বনে জান রজার মিলারের পর বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি বয়সের গোলস্কোরারে। তবে নকআউটে সব থেকে বেশি বয়সি গোল এখহ এ পোর্তো ডিফেন্ডারের। প্রথমার্ধের খেলা শেষ হবার চার মিনিট আগে সহজ সুযোগ নষ্ট না করেন রামোস।
বিরতির পর আরও বেশি আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করে ব্রুনো-ফিলিক্সরা। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে আরও দুটি গোল আদায় করে তারা। খেলার ৫১তম মিনিটের মাথায় বল নিয়ে ডান প্রান্ত ধরে ওঠেন দিয়োগো ডালোট। তার মাটি গড়ানো ক্রস থেকে বাঁ পায়ের টোকায় গোলরক্ষকের পায়ের নিচ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন রামোস। পাঁচ মিনিটের মাথায় রাফায়েল গুয়েরেরোর গোল। ঠিকতার তিন মিনিট পরে একটি গোল শোধ করে সুইজারল্যান্ড। শাকিরির কর্নার থেকে বল সতীর্থের মাথায় লেগে আসে আকাঞ্জির সামনে। বাঁ পায়ের টোকায় বল জালে জড়িয়ে দেন ম্যানসিটি ডিফেন্ডার। তাতে থোড়ায় কেয়ার পর্তুগিজদের। এরপর গোলের খিদে আরও বারে তাদের। ম্যাচের ৬৭ মিনিটের মাথায় দারুণ এক ফ্লিকে নিজের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন রামোস। ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলের পর এত কম বয়সে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বের কোনো ম্যাচে কেউ হ্যাটট্রিক করলেন। পুর্বে ২০০২ সালে জার্মানির মিরোসøাভ ক্লোসার পর, এই প্রথম কেউ বিশ্বকাপ অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করার সম্মান অর্জন করলেন।
ম্যাচের ৭৩ মিনিটের মাথায় রোনালদো যখন সাইড লাইনে দাড়ান বদলি হিসেবে নামতে, মাঠের গর্জন আরব সাগর পার করে যেন বঙ্গোপোসাগরের কিনারায় হাজির। এটুকুই যথেষ্ট বিশ্বফুটবলে তার অবদান বুঝানোর জন্য। নেমেই ৮৩ মিনিটের মাথায় একটি গোল করেন রোনালদো। কিন্তু অফসাইডে সেই গোল বাতিল হয়। অতিরিক্ত সময়ে বাঁ প্রান্তে বল ধরে বক্সে ঢুকে ডান পায়ের বাঁক খাওয়ানো শটে পর্তুগালের ছয় নম্বর গোল করেন রাফায়েল লিয়াও। দলকে অবিষ্মরণীয় জয় এনে দেওয়া রামোস ম্যাচের পর জানালেন, একজন প্রকৃত নেতার মতো দলের সকলের পাশে থাকেন কপ্তান রোনালদো। রামোস জানান, ‘দলের সকলের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। আমার সঙ্গেও, উনি আমাদের নেতা। সব সময় চেষ্টা করে আমাদের সাহায্য করতে।’ ফিগো, রুই কস্তাদের সোনালী প্রজন্ম বিদায় নেওয়ার পর এই রোনালদোর কাঁধে ভর করেই আজ বিশ্বকাপ শিরোপা প্রত্যাশী দলে রূপান্তরিত হয়েছে পর্তুগাল। এই পাঁচ বারের ব্যালন ডি-অর বিজয়ীর অবদান কিভাবে অস্বীকার করবেন তার উত্তরসূরীরা?
আগামী পরশুদিন মোরোক্কোর বিপক্ষে শেষ আটের ম্যাচে মাঠে নামবে উরন্ত পর্তুগিজরা। স্পেনকে হারিয়ে আফ্রিকান দলটি ইতিমধ্যেই জানিয়ে রেখেছে তাদের ভয়ংকর সুন্দর ফুটবল সম্পর্কে। তবে এই বিধ্বংসী পর্তুগালের সামনে আসলেই কি দারাতে পারবে মরোক্কো? জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও দুই দিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন