কাতার বিশ্বকাপের সবচেয়ে তারকাবহুল দল কোন দুটি ছিল? নিঃসন্দেহে পর্তুগাল ও ইংল্যান্ড। শুধু তারকার ছড়াছড়িই না, দল দুটি ছিল অসম্ভব পরিপূর্ণ। শেষ আটে পৌছানোর আগে তাদের দলগত গোল সংখ্যা ছিল ১২টা করে। যা আসরের যৌথভাবে সর্বোচ্চ ছিল। অথচ এই দুই জাতিকে বিদায় নিতে হলো কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই। কেন, দলগত কোন্দল কি ছিল? মোটেই না। সমস্যা মূলত গোড়ায়। আধুনিক ফুটবলে একটা দলের সর্বেসর্বা হচ্ছেন ম্যানেজার বা কোচ। সেই পরিচালনাকারীতেই যত গলদ দল দুটির। পর্তুগীজ কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের অধীনে দলটি তাদের ইতিহাসের প্রথম বড় কোন শিরোপা জেতে। অন্যদিকে গ্যারেথ সাউথগেট ২০১৬ সালের শেষাংশে থ্রি লায়ন্সদের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নতুন জীবন পায় ইংলিশ ফুটবল। এই জায়গায় অসম্ভব মিল দুই কোচের। প্রথমজনের বয়স ৬৮ আর পরের জন ৫২বসন্ত পার করেছেন কদিন আগে। তবে তাদের মূল সমস্যা অতিমাত্রায় রক্ষণশীল কৌশল সাজানো। সাউথগেটের ফুটবলের ধরণ দেখেতো এক বৃটিশ ফুটবল কলামিস্ট বলেই বসেছিলন- উনি ফেরারি গাড়িকে চালাচ্ছেন গাধার মত। বিশ্বকাপের রাস্তা যেভাবে সাজানো ছিল তাতে, এই দুই দলের মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল সেমিতে। তবে অন্তত এক দলের ফাইনালে পৌঁছানোর পথে বাধা ছিল না। তবে তা আর হলো কোথায়? একদল লিসবন ও আরেক দল লন্ডনের বিমান ধরেছে সেমি ফাইনালের পুর্বেই।
সান্তোস দায়িত্ব পান পাওলো বেন্তো ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের পরে বরখাস্ত হওয়ার পরেই। তখন তার হাতে ছিল বলার মত চারজন ফুটবলার। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লুই ন্যানি, কেপলার পেপে ও জোয়াও মৌতিনহো। সাথে পেয়েছিলেন একঝাঁক নতুন খেলোয়াড় যারা খুবই অ্যাভারেজ ফুটবল খেলতো। সেই দল নিয়েই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়ন হন সান্তোস! এই বর্ষিয়ান কোচ দেখেছিলেন তার ফুটবলারদের কে দিয়ে দৃষ্টিনন্দন কোন খেলা উপহার দেওয়া সম্ভব না। সুতরাং তিনি ৪-৪-২ ছকে খেলান, যা ম্যাচের সময় ৪-২-২-২ ছকে বদল যেত। মৌতিনহোর সঙ্গে উইলিয়াম কার্ভালহো বা দানিলো পেরেইরার মধ্যে একজনকে নিয়ে তিনি সেন্ট্রাল ডিফেন্স সাজাতেন। তার সামনে থাকতো আন্দ্রে গোমেজ ও জোয়াও মারিও। একদম সামনে রোনালদো ও ন্যানি। সারা ম্যাচ ডিফেন্স করাটাই ছিল সান্তোসের কৌশল। ইউরো জয়ের পরই দলে নিয়মত হতে থাকে ব্রুনো ফের্নান্দেজ, গোঞ্জালো গুয়েদাজ, আন্দ্রে সিলভা ও বের্নার্ডো সিলভাদের মত আক্রমণাত্বক ফুটবলাররা। তবে ২০১৮ সালে রাশিয়াতে সেই খেলোয়াড়দের নিয়েও সান্তোস ব্যর্থ হন শেষ ষোলর বাঁধা ডিঙ্গাতে।
রাশিয়া বিশ্বকাপের পর হঠাৎ পর্তুগিজ দলে চলে আসে দিয়াগো জোটা, জোয়াও ফেলিক্স, রাফা সিলভা, পিজ্জি, ক্যানসেলো, নুনো মেন্দেজদের মত আক্রমণাত্বক ফুটলাররা। তবে পর্তুগিজ ম্যানেজার তখনও ধরে রাখলেন তার মান্ধাত আমলের কৌশল। সেই পরিকল্পনা হয়তো ২০১৬ সালের দুর্বল পর্তুগালের জন্য মানানসই। তবে আক্রমণাত্বক একটা দলের জন্য এই ধরণের ডিফেন্সিভ কৌশল মরণঘাতী।
তবে পতুগালের নতুন প্রজন্মের ফুটবলারদের একটা সমস্যা আছে, তারা বেশিরভাগই উইংয়ের চেয়ে মাঝখান দিয়ে আক্রমণ করতে পছন্দ করত। আর পুটবল বিঞ্জান বর্তমানে যেখানে পৌঁছেছে তাতে উইংয়ের সর্বচ্চো ব্যবহার ছাড়া টানা বড় ম্যাচে ভালো করা সম্ভব না। দলটির ফুটবলার্র অফেন্সিভ ফুটবলটাই খেলতে চাইতো। কিন্তু সান্তোস সেই পুরনো ধ্যানেই পরে ছিলেন। ছোটখাট দল বা প্রীতি ম্যাচগুলোতে পর্তুগাল আক্রমণাত্বক খেললেও, গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সান্তোস একদমই খোলসে ঢুকে যেতেন। তারচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিল শেষ আড়াই বছরে। এই সময় আগে লিড নিয়েও গোল হজম করে ফেলত দলটি। অর্থাৎ সান্তোসের রক্ষনশীল কৌশলও ধরে ফেলেছিল প্রতিপক্ষ কোচরা। সান্তোসের কপালের ভাঁজ হয়ে দাড়িয়েছিল প্রথমে গোল হজমের পর সেটা আর শোধ না করতে পারাটা। সেটা বড় ম্যাচে হর-হামেশাই হচ্ছিল।
এসবের মাঝে এই ৬৮ বছর বয়সীর খেলোয়াড় নির্বাচন ছিল অসম্ভব প্রশ্ন সাপেক্ষ। দলে পালহিনহা মানের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার থাকার পরও তার আস্থা কার্ভালহোর উপরেই। তার এই প্রিয়মুখী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মাস ছয়েক আগে রাফা সিলভা বয়স ৩০ পেরুনোর আগেই জাতীয় দল থেকে অবসরে যান। অথচ এই উইঙ্গার দারুণ খেলছিল এবার বেনফিকায়। অন্যদিকে এই উইঙ্গারের অবসরে যাওয়ার কিছুদিন পরেই জোটা ও পেড্রো নেটো চোটে পড়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান। তাই বাধ্য হয়ে বিশ্বকাপের সময় উইঙ্গার ছাড়াই ৪-৩-৩ ছকে খেলানো শুরু করেন সান্তোস। সেখানে দেখা যাচ্ছিল ফেলিক্স ও ব্রুনো ঠিক তাদের স্বাধীনতা পাচ্ছিল নো। গোল হজমের পরেই তারা সেই স্বাধীনতা পেত। ঘানার বিপক্ষে ফেলিক্স ও ব্রুনোই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেন ফ্রি-রোলে খেলার নিশ্চয়তা পেয়ে। তবে মরোক্কোর বিপক্ষে আর পারেনি তারা।
মরোক্কোর বিপক্ষে সান্তোসের প্রথমার্ধের কৌশল ছিল নিজেদের অর্ধেই বল ধরে রেখে লং পাসে প্রতিপক্ষের জমাট দেয়াল ভাঙ্গা। সেটা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে রাফায়েল লিয়াও ছিলেন দলের একমাত্র উইঙ্গার, যিনি এই আসরে একটা ম্যাচেও শুরুর একাদশে ছিলেন না। অথচ দল খেলেছিল ৪-৩-৩ ছকে! পর্তুগীজ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির সঙ্গে গতকালই বৈঠক হয়েছে সান্তোসের। এখনো আনুষ্ঠানিক সংবাদ না আসলেও জানা গিয়েছে এই বর্ষীয়ান কোচের উপর আর আস্থা রাখছে না ফেডারেশন। তবে বের্নার্ডো-ব্রুনো-ফেলিক্স-রামোসদের মত দূরন্ত ফুটবলারদের জন্য আক্রমনাত্বক একজন কোচই দরকার। সান্তস বা মোরিনহোর দর্শনে বিশ্বাসী কেউ নয়। কেবল তবেই ভবিষ্যতে বিশ্বকাপের আশা দেখতে পারে পর্তুগাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন