কাতার বিশ্বকাপের সবচেয়ে তারকাখচিত দল ছিল ইংল্যান্ড। দলটির কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। এই ৫২ বছর বয়সী ম্যানেজারের হাত ধরেই পুনরায় জীবন পায় থ্রি লায়ন্সরা। এই শতাব্দীর শুরু থেকেই ইংলিশরা স্বয়ংস্পূর্ণ দল নিয়ে যেত বড় আসরগুলোতে, গণমাধ্যমের জোরে খেলা শুরু আগেই তাদের গায়ে লাগত সেরার তকমা। তবে মাঠের খেলায় তারা চাপ সামলাতে বরাবরই ব্যর্থ ছিল। গোরান এরিকসন, ফ্যাবিও ক্যাপেলো, রয় হডসনের হাত ঘুরে দায়িত্ব এসে পড়ে সাউথগেটের কাঁধে। সময়টা ২০১৬ সাল। আগের সব হ্যাভিওয়েট ম্যানেজাররা ব্যর্থ হওয়ার পর, সাউথগেটকে নিয়ে বাজি ধরার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে বছর তিনেক ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলে কোচিং করানো এই ম্যানেজার সময়ের সঙ্গে সবাইকে চমকে দিলেন। এলোমেলো দলটির দায়িত্ব যখন তিনি নেন, তখন থ্রি লায়ন্স শিবির তারকাশূন্য। যে ধরনের ফুটবলার ছিল তাদের দিয়েই ধীরে ধীরে একটা দল দাড় করিয়ে ফেললেন সাউথগেট। ২০১৮ বিশ্বকাপ ও ২০২০ ইউরোতে রীতিমত শিরোপার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল কেইন-ম্যাগুয়েররা। তবে ইউরোর ফাইনালে সাউথগেটের অতিমাত্রার রক্ষণশীল মনোভাব সামালোচনার মুখে পড়ে। আর কাতার বিশ্বকাপ শেষে ইংলিশ পন্ডিতরা রীতিমত ধুয়ে দিচ্ছে সাউথগেটকে।
একটা ব্যাপার সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। সাউথগেট যখন দায়িত্ব নিলেন তখন দল ছিল নিতান্তই এভারেজ ফুটবালদের নিয়ে গড়া। দলে ছিল না স্কোলস, জেরার্ড, ল্যম্পার্ড, রুনি, কোল বা ফার্ডিনান্ড মানের কোন ফুটবলার। তাই সাউথগেটের উপর প্রত্যাশ্রার চাপ ছিল না। তবে তিনি ইংল্যান্ডের মূল দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে যে তিন বছর অনুর্ধ্ব-২১ দলের দায়িত্ব সামলেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা দারুণভাবে কাজে লাগলো। খুব চমক লাগিয়ে দেওয়া ফুটবল তিনি কোন কালেই খেলাতেন না, তবে ফলাফল নিয়ে আসার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তার কৌশলে ছিল। রাশিয়া বিশ্বকাপে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংল্যান্ড সেমি-ফাইনাল খেলে। যে বৃটিশ গণমাধ্যম প্রতিবারই ইংল্যান্ডকে ফেবারিট বানাতো আসরের আগে, সেবার তারাও বেশ নিরব ছিল। সমর্থকরাও বিশাল ধাক্কা খেল থ্রি লায়ন্সদের কোয়ার্টার ফাইনাল জেতাতে। তবে যে ধরনের স্কোয়াড নিয়ে রাশিয়াতে গিয়েছিলেন সাউথগেট, তা নিয়ে শিরোপা জেতাটা কঠিন। ২০২০ সালের ইউরো অনুষ্ঠিত হলো এক বছর পরে। এবার সকলেই ধরে নিল ইংল্যান্ড শিরোপা জিতবে। সত্যিই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খুব কাছে চলে গিয়েছিল তারা। ফাইনালে দ্বিতীয় মিনিটে গোলও পেয়ে গেল, এরপরই খোলসে ঢুকে যায় থ্রি লায়ন্সরা। এই মাত্রাতিরিক্ত রক্ষণশীলতার মূল্য দিতে হলো সাউথগেটকে, শিরোপা খুয়ানোর মাধ্যমে।
সেই আসরের পূর্বে দারুণ ফর্মে ছিলেন দুই উইঙ্গার জর্ডান সানচো ও জ্যাক গ্রীয়েলিশ। তবে মূল আসরে তারা একদমই প্লেয়িং টাইম পেল না। সাউথগেট সেই আসরে ৩-৪-৩ ছকে খেলাতেন দলকে। যেখানে খেলা শুরু হওয়ার পর আক্রমণে থাকা দুই উইঙ্গার খুব একটা স্বাধীনতা পেত না নিজেদের মত খেলার। তাছাড়া দলে প্রচুর উইঙ্গার থাক্র পরও ম্যানেজারের মূল কৌশল আবর্তিত হতো হ্যারি কেইনকে ঘিরে। দ্বিতীয় আরেকটা সমস্যা খুব চোখে পড়ে। সাউথগেট প্লেয়ার রোটেশনে খুবই গধবাঁধা পন্থা অবলম্বন করতেন। নক-আউটে গোল হজমের পর দ্রুতই কোন রিঅ্যাকশন দেখাতেন না কোচ। ট্রেন্ট অ্যালেকজান্ডারের মত আক্রমণাত্বক ওয়াইড ফুলব্যাককে সাউথগেট সব সময় উপেক্ষা করে গিয়েছেন।
কাতার বিশ্বকাপের আগে নেশ্নস লিগে জঘন্য পারফরম্যান্স করে সাউথগেটের দল। এটা পরিষ্কার যে বর্তমান ফুটবলে এক গোলের ব্যবধানে এগিয়ে থেকে কেবল সেটা ডিফেন্ড করে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। সেই কাজটাতেই সাউথগেট বাজি ধরেন। একই সাথে যে দলে রাশফোর্ড, স্টার্লিং, ফোডেন, সানচো, সাকা ও গ্রীয়েলিশদের মত উইংধরে খেলার ফুটবলার থাকে, সেই দলের কৌশল কেন এতো রক্ষণশীল হবে। যেখানে আপনি চাইলেই প্রতিপক্ষের রক্ষণের বেড়া উড়িয়ে দিতে পারেন, সেখানে কেবল মিডফিল্ডের দাপট বজিয়ে রেখে খেলাটা অর্থহীন। কাতারে ফ্রান্সের সঙ্গে হেরে যাওয়া ম্যাচে চাইলেই সাউথগেট ৪-২-৩-১ ছকে যেতে পারতেন। তবে তিনি ৩ সেন্ট্রাল মিডমিল্ডার খেলালেন। একই সঙ্গে গতি কমে যাওয়া ও বর্তমানে আক্রমণে অদূরদর্শী ওয়াকারকে খেলালেন রাইটব্যাকে। অথচ ট্রেন্ট বসে ছিল বেঞ্চে, এমঙ্কি পিছিয়ে থাকার পরও।
সকল কৌশলের উত্থান ও পতন থাকে। সাউথগেট সেই নিম্নগামিতার দিকেই চলে এসেছেন। ইংল্যান্ডের এই মেধাবী দলটির সব ধরনেরই যোগ্যতা আছে বড় আসরের শিরোপা জেতার। যদি সাউথগেট তার কৌশলে আমূলে পরিবর্তন আনেন। তিনি কাতার থেকে ফেরার পর জানিয়েছেন কাজ চাল;ইয়ে যাবেন কিনা ইংল্যান্ডের ম্যানেজার হিসেবে, সেই সিধান্ত জাতাতে তার কইয়েকদিন সময় লাগবে। যদি তিনি পদত্যাগ করেন তবে অক্রমণাত্বক ধারণার একজন ম্যানেজারই থ্রি লায়ন্সদের দায়িত্বে আসা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন