শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলাধুলা

মেসির হাতে বিশ্বকাপ

ইতিহাসের অন্যতম রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল জিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, আনন্দে ভাসছে গোটা বিশ্ব

রেজাউর রহমান সোহাগ | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ২:১২ এএম | আপডেট : ২:১৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২

১৯৮৬ সালের পর থেকে প্রতীক্ষা দীর্ঘ ৩৬ বছরের। ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনার হাত ধরে বিশ্বকাপ জয়ের পর কোনোভাবেই আর সেই কাপের দেখা মিলছিল না আর্জেন্টিনার। ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও মেক্সিকান রেফারি কোদে সালের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের কারণে অন্যায়ভাবে বিশ্বকাপ জয় থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে। তারপর থেকে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে চলছিলেন ম্যারডোনার যোগ্য উত্তরসূরি পৃথিবীর সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি। অবশেষে শুধু মেসির নয়, পৃথিবীর শত কোটি মানুষের স্বপ্নপূরণ করে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জয় করে নিয়েছে মেসির আর্জেন্টিনা।
গতকাল রাতে কাতারের রাজধানী দোহার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ইতিহাসের অন্যতম রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বসেরার মুকুট জিতেছে আলবিসেলেস্তারা। রোমাঞ্চেভরা ম্যাচটি নির্ধারিত সময়ে দুই গোলের ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও হয়নি। হয়নি অতিরিক্ত সময়ে এগিয়েও। মেসির জোড়া গোলে লিড ধরে রাখতে পারেনি আর্জেন্টিনা। কিলিয়ান এমবাপের হ্যাটট্রিকে বারবার লড়াইয়ে ফিরে আসে ফ্রান্স। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হয় ম্যাচের ভাগ্য। যেখানে এমিলিয়ানো মার্তিনেজের দুর্দান্ত গোলকিপিংয়ে সেই রোমাঞ্চ জিতে অবশেষে শিরোপায় চুমু দেন মেসি।
টাইব্রেকারে ফ্রান্সের কিংসলে কোমানের শট ঠেকান মার্তিনেজ। আর চুয়ামিনি মারেন বাইরে। ফলে এমবাপে ও কোলো মুয়ানির শট লক্ষ্যভেদ করলেও লাভ হয়নি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে টানা চারটি শটে লক্ষ্যভেদ করেন মেসি, পাওলো দিবালা, লিয়েন্দ্রো পারাদেস ও গনসালো মার্তিনেজ। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে টাইব্রেকারে হারল ফ্রান্স। এর আগে ২০০৬ সালের ফাইনালে ইতালির কাছে হেরেছিল তারা। অন্যদিকে টাইব্রেকারে আরও একবার দুর্দান্ত আর্জেন্টিনা। এখন পর্যন্ত সাতবার এ ভাগ্য পরীক্ষায় লড়াই করে একবার হেরেছিল আলবিসেলেস্তেরা। সেটাও সেই ২০০৬ সালে কোয়ার্টার-ফাইনালে জার্মানির কাছে। একই সঙ্গে মধুর প্রতিশোধও নিল আর্জেন্টিনা। রাশিয়ায় গত আসরে শেষ ষোলোতে এই ফ্রান্সের কাছেই হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। সেবার ৪-৩ গোলে জয় পেয়েছিল ফ্রান্স।
এই বিশ্বকাপ জয় ক্রীড়ামোদীদের কাছে যতটা না বেশি প্রত্যাশিত ছিল আর্জেন্টিনার জন্য, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আকাক্সিক্ষত ছিল মেসির জন্য। আর্জেন্টিনার এ বিশ্বকাপ জয়ে আনন্দের সাগরে ভাসছে সারা পৃথিবী। গোটা বাংলাদেশেও আনন্দ উৎসবে বিভোর। পৃথিবীজুড়ে এত আনন্দের মাঝেও শুধু একটি বেদনাবিধুর অপূর্ণতা- প্রিয় শিষ্যর এই বিজয় দেখে যেতে পারলেন না ফুটবল কিংবদন্তি ম্যারাডোনা। তবে মেসি এবং তার সতীর্থরা এই বিজয় উৎসর্গ করেছেন ম্যারডোনাকেও।
‘নাম্বারস, কালারস অ্যান্ড নয়েজ ফর আর্জেন্টিনা’- লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফাইনালের শুরুতেই কথাটা ধারাভাষ্যকারের। গ্যালারির দুই-তৃতীয়াংশ আকাশি-সাদা সমর্থকে প্রায় আকাশি রং ধারণ করেছে হলুদাভ লুসাইল। সে তুলনায় ফ্রান্সের সমর্থক নগণ্য। ম্যাচের প্রতিকী হয়েই যেন রইলো ছবিটি। মাঠের লড়াইয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে আর্জেন্টিনা শট নেয় ছয়টি, এর তিনটি ছিল লক্ষ্যে। সেখানে ঘর সামলাতে ব্যস্ত ফ্রান্স বিরতির আগ পর্যন্ত গোলের উদ্দেশ্যে কোনো শটই নিতে পারেনি। দলের সেরা তারকা কিলিয়ান এমবাপেকে প্রথমার্ধে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। আর মেসি-ডি মারিয়া জাদুকরি জুটিতে রাতটি নিজেদের করে নেয় আর্জেন্টিনা। অথচ সেই এমবাপেই প্রায় গড়ে ফেলেছিলেন ইতিহাস।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে পারেননি ডি মারিয়া। চোটের কারণে সাইডলাইনে বসে দলের হার দেখতে হয়েছিল তাকে। ২০২২ সালের ফাইনালেও তাকে নিয়ে ছিল শঙ্কা। তবে শেষ পর্যন্ত ফিরেছেন ফিট হয়ে। আর তার নৈপুণ্যে প্রথমার্ধেই জোড়া গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। একটি করেছেন, অপরটি করিয়েছেন। ম্যাচের ২২তম মিনিটে মেসির পেনাল্টি গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ডি-বক্সের মধ্যে ডি মারিয়াকে ফাউল করে বসেন উসমান দেম্বেলে। দেখে শুনে ঠাণ্ডা মাথায় লক্ষ্যভেদ করে দলকে এগিয়ে দেন মেসি। এবারের আসরে এটা তার ষষ্ঠ গোল। সবমিলিয়ে বিশ্বকাপে ১২তম।
৩৬তম মিনিটে দ্বিতীয় গোল পায় আর্জেন্টিনা। আলভারেজের পাস ধরে মেসি বল ঠেলে দেন সামনে থাকা ম্যাক অ্যালিস্তারকে। চাইলে নিজেই শট নিতে পারতেন ব্রাইটন তারকা, কিন্তু তা না করে নিখুঁত এক পাস বাড়িয়ে দেন ডি মারিয়াকে। বল জালে জড়াতে কোন ভুল করেননি পিএসজি তারকা। উদযাপন শেষে ডি মারিয়াকে কাঁদতে দেখা যায়। খেলছিলেন আর চোখ মুখছিলেন। হয়তো ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতি মনে পড়ছিল তার। ঊরুর চোটে পড়ে আর্জেন্টিনার সেই ফাইনাল খেলতে পারেননি। তার সেই আনন্দ অশ্রু নিয়েই মাঝ বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা।
বিরতি থেকে ফিরেও চলছিল মেসি-ডি মারিয়ার যুগলবন্দীর জাদু। বেশক’টি সুযোগ তৈরি করে যদিও গোলমুখ খোলা হয়নি তাদের। ৬৪ মিনিটে দারুণ খেলতে থাকা ডি মারিয়াকে উঠিয়ে রক্ষণের শক্তি বাড়ান স্কালোনি। মাঠে নামেন মার্কোস আকুনিয়াকে। তবে তাতে ফল হয়েছে উল্টো। ৭৯তম মিনিটে ব্যবধান কমায় ফ্রান্স। কোলো মুয়ানিকে ডি-বক্সের মধ্যে নিকোলাস ওতামেন্দি ফাউল করলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। সফল স্পটকিক থেকে গোল করেন এমবাপে। দুই মিনিট পর সমতায় ফেরে ফরাসিরা। এবারও সেই এমবাপে। থুরামের ক্রস থেকে নিঁখুত ভলিতে লক্ষ্যভেদ করেন এই পিএসজি তারকা। আসরে এটা তার সপ্তম গোল। গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে ছাড়িয়ে যান মেসিকে।
তখনও কে জানতো আরো কত রোমাঞ্চের বীজ বোনা আছে এই মরূর বুকে। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ, গোলের মোক্ষম সুযোগ তৈরি- শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা যখন ঠিক ১০৯তম মিনিটে ফের এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। লাউতারোর জোরালো শট প্রথম দফায় ঠেকিয়ে দিলেও মেসির ফিরতি শট আর রুখতে পারেননি লরিস। আলবিসেলেস্তে ভক্তদের গর্জনে ফের কেঁপে ওঠে গ্যালারি। তাতে গোল্ডেন বলের দৌঁড়ে ফের এগিয়ে যান মেসি। বিশ্বকাপে তার গোল হয় ১৩টি। তবে লুসাইল যেন পণ করে বসেছিল ফুটবল রোমান্টিকদের হৃদয়ের জোর পরীক্ষা নিতে। নইলে ছয় মিনিট পরই কেন সমতায় ফেরাবে ফরাসিদের! কোমানের শট ব্লক করতে লাফিয়ে ওঠেন মন্তিয়েল কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে তার হাতে গিয়ে লাগে বল। বক্সের ভিতর এই ঘটনা ঘটায় পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। যদিও তা নিয়ে আছে বিতর্ক। সেখান থেকে আরও একটি সফল স্পটকিকে লক্ষ্যভেদ করেন এমবাপে। তৃতীয় গোলে ফের এগিয়ে যান মেসির পিএসজি সতীর্থ। তাতে আরেকটি ভুলতে বসা ইতিহাস সামনে আনেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এই ফরোয়ার্ড। ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের পর বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক করলেন এমবাপে। ম্যাচের যোগ করা সময়ে শেষ দিকে অবিশ্বাস্য এক সেভ করেন মার্তিনেজ। অন্যথায় তখনই হেরে যেতে পারতো আর্জেন্টিনা। তবে সৃষ্টিকর্তা বুঝি মেসির জন্য এই চিত্রনাট্যটা লিখছিলেন নিজ হাতেই!
এবারের বিশ্বকাপে ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থেকে তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপার সন্ধানেই কাতারে পাড়ি জমিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেই স্বপ্নে জোর ধাক্কা লেগেছিল গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্য্যাচেই। সউদী আরবের বিপক্ষে তাদের অপ্রত্যাশিত হার যেন থমকে দিয়েছিল কোটি ভক্তের স্বপ্নকেও। তখন শঙ্কা ছিল গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে যাওয়ার। এরপর ঘুরে দাঁড়াতে অবশ্য সময় নেয়নি আলবিসেলেস্তেরা। একের পর এক দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে যোগ্যতর দল হিসেবেই পা রেখেছিল আইকনিক লুসাইলের ফাইনালে। টানা ছয় ম্যাচ (টাইব্রেকারসহ) জিতে শিরোপা জয় করলেন মেসিরা। এর আগে ২০১০ সালে সুইজারল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচ হেরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্পেন। উত্তরসূরীদের এমন পারফরম্যান্সে প্রয়াত আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ম্যারাডোনাও গর্ববোধ করছেন বলে মনে করছেন তার বড় ছেলে ডিয়াগো আরমান্দো ম্যারাডোনা সিনাগ্রা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন